জিলহজ মাস একটি সম্মানিত মাস। এ মাস হজের মাস। এ প্রথম ১০ দিন খুবই মর্যাদাসম্পন্ন। আল্লাহ বলেন, ‘শপথ ভোরের এবং শপথ ১০ রাতের।’ (আল ফজর : ১-২) আল্লাহ যে ১০ রাতের শপথ নিয়েছেন, তা হলো- জিলহজ মাসের প্রথম ১০ রাত ও দিন।
আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আল্লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘এই ১০ দিনের আমলের মতো অন্য কোনো দিনের নেক আমল আল্লাহর কাছে এত বেশি প্রিয় নয়।’ সাহাবিরা বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়? ‘না, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়, তবে ওই ব্যক্তি- যে জীবন ও সম্পদ নিয়ে জিহাদের জন্য বের হয়ে আর কোনো দিন ফিরে আসেনি।’ (সুনান আবু দাউদ-২৪৩৮, সুনান ইবনু মাজাহ-১৭২৭)
যারা হজে যান, তাদের জন্য এ ১০ দিনে গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো- হজের সাথে সম্পৃক্ত সব বিধান সহিহ সুন্নাহ অনুযায়ী যথাযথভাবে সম্পন্ন করা। যারা হজে যাননি, তাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো কোরবানি করা।
এখানে উল্লেখ্য, যারা কোরবানি দিবেন তারা কোরবানির আগ পর্যন্ত চুল, লোম ও নখ কাটবেন না। উম্মু সালামাহ রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা যখন জিলহজ মাসের চাঁদ দেখবে, তখন তোমাদের মধ্যে যে কোরবানি দিতে চায়, সে যেন কোরবানি করার আগ পর্যন্ত চুল, পশম ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।’ (সহিহ মুসলিম-১৯৭৭)
এই ১০ দিন ও রাতে একজন মুমিন বেশি বেশি করে জিকর করবেন, কুরআন তিলাওয়াত করবেন, দান সদকাহ করবেন। ঈদের দিন বাদ দিয়ে বাকি ৯ দিন রোজা রাখবেন।
রাসূল সা: জিলহজ মাসের ৯ দিন, আশুরার দিন এবং প্রতি মাসের তিন দিন রোজা রাখতেন। (সুনান আবু দাউদ-২৪৩৭) এ দিনগুলোতে বেশি বেশি তাকবির তথা ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে হবে।
ইমাম বুখারি রাহ: বর্ণনা করেন, আবদুল্লাহ বিন উমার রা: ও আবু হুরাইরা রা: জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন যখন বাজারে যেতেন তখন তাকবির বলতেন, আর লোকজন তাদের তাকবিরের সাথে তাকবির বলতেন। তিনি (ইমাম বুখারি রা:) আরো বলেন, উমার রা: মিনায় তার তাঁবুতে তাকবির দিতেন, মসজিদে অবস্থান করা লোকজন তা শুনে তাকবির দিতেন, বাজারের লোকজন তাকবির দিতেন। এসব তাকবিরে যেন মিনা প্রকম্পিত হয়ে উঠত।
জিলহজ মাসের নবম তারিখ হলো আরাফাহ দিবস। এ দিন হাজীগণ আরাফাত ময়দানে অবস্থান করেন। আয়েশা রা: বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ আরাফাহ দিবসের চেয়ে অন্য কোনো দিন এত অধিক সংখ্যক বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন না। তিনি নিকটবর্তী হন। অতঃপর তাদেরকে নিয়ে ফেরেশতাদের সামনে গর্ব করেন এবং বলেন, এরা কী চায়?’ (সহিহ মুসলিম-১৩৪৮)
আরাফাহ দিবসে হাজীগণ সূর্য উঠার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাত ময়দানে অবস্থান করেন। এ সময় তারা বিভিন্ন ধরনের জিকর করেন। কুরআন তিলাওয়াত করে থাকেন, রাসূল সা:-এর ওপর দরুদ পড়েন। বেশি বেশি করে আল্লাহর কাছে অতীতের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইবেন। ভবিষ্যতে আরো বেশি ভালো কাজ করার জন্য আল্লাহর কাছে তাওফিক চাইবেন। এ দিনের সর্বোত্তম দোয়া কোনটি? এ প্রসঙ্গে রাসূল সা: বলেন, ‘সর্বশ্রেষ্ঠ দোয়া হলো আরাফাহ দিবসের দোয়া। আমি ও আমার আগে নবীগণ সর্বশ্রেষ্ঠ যে কথাটি বলতাম, তা হলো- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লাশারি কালাহু লাহুলমুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলাকুল্লি শাইয়িন কাদির।
আরাফাত ময়দানের বাইরে যারা আছেন, অর্থাৎ যারা হজ করছেন না, এ দিন তাদের করণীয় হচ্ছে রোজা রাখা। রাসূল সা:কে আরাফাহ দিবসের রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘এ রোজা গত বছর ও আগামী বছরের গুনাহ মার্জনা করে দেয়।’ (সহিহ মুসলিম-১১৬২)
আরাফার রোজা নিয়ে একটি মতপার্থক্য লক্ষণীয়। কেউ কেউ বলেন, এটা রাখতে হবে আমাদের দেশের চাঁদ দেখা অনুযায়ী, ৯ জিলহজ। আবার অনেকে বলেন, আরাফার রোজা রাখতে হবে আরাফাহ দিবসে অর্থাৎ হজের দিন। কিন্তু দু’টি মতের মধ্যে সঠিক কোনটি? আরাফাহ দিবসের রোজার সম্পর্ক আরাফাত ময়দানে হাজীদের অবস্থানের সাথে। তাই রোজা রাখতে হবে আরাফাহ দিবসে। নিজ নিজ দেশের ৯ জিলহজ নয়।
এ রোজার দর্শন হচ্ছে, হাজীগণ আরাফাত ময়দানে অবস্থান করে নানা ধরনের ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করছেন। আরাফাত ময়দানের বাইরে যাদের অবস্থান তারা রোজার মাধ্যমে তাদের সাথে শরিক হবেন। পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশের বাইরে সব দেশের মুসলমানেরা এ দর্শনের ভিত্তিতে আরাফাহ দিবস তথা আরাফাত ময়দানে হাজীদের অবস্থানের দিনই রোজা রাখেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিতর্ক নেই। আমাদের এ অঞ্চলে বিষয়টি নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়।
মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে যেদিন ৯ জিলহজ, সেদিন হাজীগণ আরাফাত ময়দানে থাকেন না। অতএব এটি আরাফাহ দিবসই নয়। তাই এ দিনের রোজা হাদিসে বর্ণিত আরাফাহ দিবসের রোজা নয়।
আইয়্যামে তাশরিক হলো, জিলহজ মাসের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ। এ দিনগুলো ঈদের দিন বলে বিবেচিত হয়। রাসূল সা: বলেছেন, ‘আরাফাহ দিবস (হাজীদের জন্য), কোরবানির দিন এবং আইয়্যামে তাশরিক হলো আমাদের ইসলাম অনুসারীদের জন্য ঈদ।’ (সুনান তিরমিজি-৭৭৩ ও সুনান আবু দাউদ-২৪১৯) তিনি আরো বলেছেন, ‘আইয়্যামে তাশরিক হলো পানাহারের দিন।’ অপর বর্ণনায় রয়েছে ‘এবং আল্লাহর জিকরের দিন।’ (সহিহ মুসলিম-১১৪১)
যেহেতু আইয়্যামে তাশরিকের তিন দিনও ঈদের দিন বলে বিবেচিত এবং এ তিন দিন পানাহারের দিন, তাই এ তিন দিনেও দুই ঈদের দিনের মতো রোজা রাখা যায় না। রাসূল সা: বলেছেন, ‘এ দিনগুলোতে তোমরা রোজা রাখবে না। কেননা, দিনগুলো হলো পানাহার ও মহান আল্লাহর জিকরের দিন।’ (মুসনাদে আহমাদ-১০৬৬৪)
আইয়্যামে তাশরিকে তাকবির তথা আল্লাহু আকবার বলতে হয়। এ তাকবির দুই ধরনের; সাধারণ তাকবির ও বিশেষ তাকবির। সাধারণ তাকবির হলো; জিলহজ মাসের প্রথম দিন থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত যেকোনো সময় তাকবির বলা। ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, আবদুল্লাহ বিন উমার রা: ও আবূ হুরাইরা রা: বাজারে গিয়েও সশব্দে তাকবির (আল্লাহু আকবার) বলতেন, তাদের তাকবির শুনে অন্যরা তাকবির বলতেন।’ বিশেষ তাকবির হলো- প্রতি ফরজ সালাতের পর বলার তাকবির। এটি শুরু হবে আরাফা দিবসের ফজরের পর এবং শেষ হবে ১৩ তারিখ আসরের পর।
এ তাকবির হলো, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ। এ তাকবির নারী ও পুরুষ সবারই বলতে হবে। জামাতে সালাত আদায় করলেও বলবেন, একাকী সালাত আদায় করলেও বলবেন। ফরজ সালাতের পর পঠিত তাকবিরের নির্ধারিত সংখ্যা কোনো হাদিসে উল্লেখ করা হয়নি। তাই বেশি বেশি তাকবির বলাই উত্তম। তাকবিরের সংখ্যা নির্ধারণ করার পক্ষে কোনো দলিল নেই।
Source :http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/247887