বিশ্বে এ সময়ে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ বৈষম্য বা অসমতা। আজ বৈশ্বিক বৈষম্য যে পর্যায়ে রয়েছে, তা সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল উনিশ শতকের শেষ দিকে। এবং সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয়, এটা বেড়েই চলছে। বৈষম্যের সঙ্গে অবধারিতভাবে আসে বঞ্চিত হওয়ার অনুভূতি, যা তৈরি করে বিচ্ছিন্নতাবোধ ও ক্রোধের। এমনকি রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদ ও জেনোফোবিয়াও (বিদেশী সম্পর্কে অহেতুক ভয়) তৈরি হয়। যখনই মানুষ নিজেদের কমতে থাকা সম্পদের ভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করে, তখন তাদের উদ্বেগ রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানীদের জন্য ফয়াদা লোটার পরিস্থিতি তৈরি করে। তারা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিশ্বে অস্থিরতা তৈরি করে।
বর্তমানে ধনী ও গরিবদের মধ্যে যে ফারাক রয়েছে, তা চিন্তা করলে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফাম পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে, বিশ্বের শীর্ষ আট ধনী ব্যক্তি যে পরিমাণ সম্পদের মালিক, তা দরিদ্রতম ৩৬০ কোটি জনগোষ্ঠীর সম্পদের সমান। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স দেখিয়েছেন, বর্তমানে ওয়াল মার্টের মালিক ওয়ালটন পরিবারের কাছে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৪২ শতাংশের চেয়ে বেশি সম্পদ।
এটা নিশ্চিত, চরম দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক দশকগুলোয় দারুণ সাফল্য অর্জন করা গেছে। দিনপ্রতি ১ দশমিক ৯০ ডলারের নিচের আয় দিয়ে যারা জীবন যাপন করে, তাদের চরম দরিদ্র বলা হয়। ১৯৮১ সালে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ চরম দারিদ্র্যে বসবাস করত। ২০১৩ সালের মধ্যে— সর্বশেষ বছর যেটার বিস্তৃত তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে— এ সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১১ শতাংশে। টুকরো টুকরো নজির বলছে, চরম দারিদ্র্য এখন ৯ শতাংশের কিছু বেশি।
সম্প্রতি অর্থনীতিবিদ অ্যাঙ্গাস ডিটন তুলে ধরেছেন, ধনী দেশগুলোতেও কিন্তু চরম দারিদ্র্য একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। তিনি বলছেন, এখনো কয়েক লাখ মার্কিনি— কালো, সাদা ও হিস্পানিক— দিনপ্রতি ২ ডলারের নিচে মাথাপিছু আয়ে জীবন যাপন করছে। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় (নিরাপত্তাসহ) এর চেয়ে ঢের বেশি। এ পরিস্থিতিতে এ ধরনের আয় অন্য দেশ— যেমন ধরা যাক, ভারতের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে অধিকতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
এ সমস্যার প্রতিফলন দেখা যায় নিউইয়র্ক সিটিতে। এখানে জ্ঞাত গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ২০০২ সালের ৩১ হাজার থেকে বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৬৩ হাজারে (সত্যিকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যারা কখনো কোনো আশ্রয় গ্রহণ করেনি, তাদেরসহ, এ সংখ্যা প্রায় ৫ শতাংশ বেশি)। আবাসন ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে এ ট্রেন্ডটি বাড়তির দিকে রয়েছে। গত কয়েক দশকে মজুরির তুলনায় বাড়ি ভাড়া বেড়েছে তিন গুণ বেশি দ্রুততায়।
হাস্যকরভাবে এমন অনেক পণ্য ও সেবা রয়েছে, যেগুলোর প্রতি ইউনিটের জন্য ধনবান অপেক্ষাকৃত কম ব্যয় করতে হয়। এ ধরনের উদাহরণ ধাই ধাই করে বাড়ছে। যেমন— এর একটি উত্কৃষ্ট উদাহরণ আকাশভ্রমণ। ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লায়ার প্রোগ্রামগুলোর (যারা জন্য ঘন ঘন আকাশপথে যাত্রা করেন) কল্যাণে ধনবান ভ্রমণকারীদের প্রতি মাইল আকাশভ্রমণের জন্য অপেক্ষাকৃত কম ব্যয় করতে হয়। এটা উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলোর জন্য যুক্তিসঙ্গত হতে পারে। কারণ তারা ঘন ঘন আকাশভ্রমণকারীকে নিজেদের সেবা ব্যবহারে উত্সাহিত করার জন্য এটা করতে পারে। এটা আরেকভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, আর সেটা হলো, আদতে বাজারে সম্পদশালীদের পুরস্কৃত করা হয়।
আমাদের এ বিশ্বায়িত বিশ্বে, বৈষম্য সমস্যার সমাধান শুধু বাজার ও স্থানীয় কমিউনিটির ওপর ছেড়ে দিলে হবে না। স্থানীয় বৈষম্য বৃদ্ধির ফলাফল আমরা দেখতে পাচ্ছি। ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে, স্থিতিশীলতা ভারসাম্য হারাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের প্রয়োজন নতুন নিয়ম-কানুন, পূর্ণ বিতরণ ব্যবস্থা। এমনকি বৈশ্বিক চুক্তি এখন আর শুধু নৈতিকতার বিষয় নয়; ক্রমবর্ধমানভাবে, এটা এখন বেঁচে থাকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।