বিভিন্ন ধরনের সংকটে বাধাগ্রস্ত অর্থনীতি
লেখক: মুনমুন শবনম বিপাশা | সোম, ১৭ অক্টোবর ২০১১, ২ কার্তিক ১৪১৮
বিভিন্ন ধরনের সংকটের ভারে আমাদের দেশের অর্থনীতির মেরদণ্ড প্রায় ভঙ্গুর হতে চলেছে। বর্তমানে আমাদের অর্থনৈতিক সংকটের প্রধান কারণ হলো দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি, গ্যাস ও বিদ্যুত্সহ অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, উচ্চ সুদ হার, রাজনৈতিক অস্থিরতা, টাকার অবমূল্যায়ন, ব্যাংকে তারল্য সংকট, যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া। এসব সমস্যার কারণে দেশের শিল্প খাত তীব্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। ফলে অর্থনীতি পড়ে যাচ্ছে বিপাকে। এ সমস্যার সমাধান করতে পারলে আমাদের দেশও বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে। অন্যথায় অর্থনীতির বেহাল অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষও দরিদ্রতার দিকে ধাবিত হবে।
বাংলাদেশের বর্তমানে যে অবস্থা, তাতে দেখা যায় যে এমন কোনো খাত নেই যেখানে সংকট নেই। অনেক অর্থনীতিবিদের মতে, বর্তমানে অর্থনীতিতে ক্রান্তিকাল চলছে। আবার অনেকে বলছেন, বিনিয়োগে খরা দেখা দিয়েছে। কারও কারও মতে জ্বালানি ও বিদ্যুত্ সংকটে এদেশের শিল্পে সংকট দেখা দিয়েছে। তাই জ্বালানি ও বিদ্যুত্ সমস্যা কাটাতে পারলে সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের অর্থনীতিকে অক্টোপাসের মতো বিভিন্ন সমস্যার থাবা অস্থিতিশীল করে তুলছে। অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তোলার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবও একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে তা হলো পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে। বিশ্বব্যাংক বিস্তারিত তদন্ত করে বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিয়েছে সরকারকে। বিশ্বব্যাংকের তদন্তে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যোগাযোগমন্¿ীর কোম্পানি সাকো কাজ পাইয়ে দিতে ঘুষ চায়। মন্¿ী নিজেও সাকোর পক্ষে চাপ দেন। বিশ্বব্যাংক বলছে, পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি ও জালিয়াতির বিষয়ে সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তারা এ নিয়ে আর অগ্রসর হবে না। পদ্মা সেতুতে অর্থ পেতে হলে বাংলাদেশকে এ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বর্তমানের বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটের মূল কারণ এ দেশের রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি। অনিয়মই নিয়ম। দেশের স্বার্থে নয় বরং ব্যক্তিস্বার্থই মূল— এসবই সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির সময়ে আমরা দেখেছি তত্কালীন প্রতিমন্¿ী একেএম মোশাররফ হোসেনকে ‘নাইকো’ ১,৯০,৯৮৪ কানাডীয় ডলারের গাড়ি উপহার হিসেবে দিয়েছিল, সেই সঙ্গে ছিল বিভিন্ন ধরনের উপহার, ভ্রমণ, খানাপিনার ব্যবস্থা করা। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের যোগাযোগমন্¿ী সৈয়দ আবুল হোসেনও সেই পথে অগ্রসর হয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের তদন্তে বলা হয়েছে, বর্তমান যোগাযোগমন্¿ী ও তার মালিকানাধীন কোম্পানি সাকোর কর্মকর্তারা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছেন সাকো হলো পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ পাইয়ে দেওয়ার পেছনে নীরব প্রতিনিধি। কোনো কাজ পেতে হলে সাকোকে অর্থ দিতে হবে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সুজনের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহ্মদ সমপ্রতি বলেছেন, যোগাযোগমন্¿ীর দুর্নীতি নিয়ে যে প্রশ্নটা এসেছে, তা আসলে ঘুষ।
আমাদের মতো দেশের উন্নতি অনেকাংশে নির্ভর করে রাজনীতিবিদদের সিদ্ধান্তের ওপর। দেশের জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তারা কাজ করেন। অথচ যে দেশের জনপ্রতিনিধিরাই দুর্নীতি করেন, সে দেশ কি করে অর্থনৈতিক সংকটের অবসান ঘটাবে— এ এক বিরাট প্রশ্নসাপে বিষয়। কিছু ব্যক্তির দুর্নীতির কারণে যদি পদ্মা সেতুর কাজ আটকে থাকে, তাহলে এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে একটা দেশের জন্য, দেশের জনগণের জন্য।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক হলো বিদ্যুত্ ঘাটতি। কিছু পরিসংখ্যান আলোচনা করলেই এ সমস্যার প্রকট বোঝা যাবে। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুত্তায়ন বোর্ডের
সাবেক পরিচালক বিডি রহমত উল্লাহের মতে, বর্তমান উত্পাদন ব্যবস্থায় চাহিদার তুলনায় এক ইউনিট বিদ্যুত্ ঘাটতি হলে যে পরিমাণ উত্পাদন হ্রাস পায় তার মূল্য ৩২ টাকা। এদেশে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ ঘাটতি রয়েছে। ফলে প্রতি বছর উত্পাদন কমছে ৮০০০ কোটি টাকা। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে, সিপিডির হিসাবে বিদ্যুত্ সমস্যার জন্য শিল্প খাতে তির পরিমাণ ৫০০০ এবং কৃষি খাতে তির পরিমাণ ৯৫০ কোটি টাকা। ব্যবসা-বাণিজ্যে বিদ্যুত্ সংকটের কারণে তির পরিমাণ ৭৫০০ কোটি টাকা। এ সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রপ্তানি শিল্পও। রপ্তানি আয়ের ৭৬ শতাংশ আসে পোশাক শিল্প থেকে। বিদ্যুত্ সংকট না থাকলে পোশাক উত্পাদন ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেত। ২০০৬ সালের প্রকাশিত রিপোর্টে সিপিডি বলেছে, এ ঘাটতি না থাকলে মোট দেশজ উত্পাদন বাড়ত ৩.৫ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশ যে শুধু বিদ্যুত্ সংকটে জর্জরিত তা নয়, বরং গোঁদের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে গ্যাস সমস্যা। গত আড়াই বছরে শিল্পে নতুন কোনো সংযোগ হয়নি। বিদ্যুত্ ও গ্যাস সমস্যা হলো আমাদের দেশের বিনিয়োগের মূল প্রতিবন্ধক। নতুন গ্যাস সংযোগ তো তৈরি হয়নি, বরং এর সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস ও বিদ্যুত্ সমস্যা বেড়েই চলেছে। ফলে এদেশে বড় ধরনের বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। গত দেড় থেকে দুই বছরে ১৫৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠান উত্পাদনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও গ্যাস ও বিদ্যুত্ সমস্যার জন্য উত্পাদন করতে পারছে না।
এর হাত থেকে রা পাচ্ছে না এদেশের আবাসন শিল্প। রিহ্যাবের হিসাব অনুযায়ী, আমাদের দেশে নির্মিত ২৫,০০০ ফ্যাটে বিদ্যুত্ ও গ্যাসের সংযোগ যায়নি। ফলে আবাসন ব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ আটকে আছে। ফ্যাট গ্রহীতাদের কষ্টে উপার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করেও ফ্যাটে উঠতে পারছে না। রপ্তানিমুখী শিল্পও গ্যাস ও বিদ্যুত্ সমস্যার জন্য স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। রপ্তানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়োশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী সমপ্রতি বলেছেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ বন্ধ হওয়াতে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ নেই। তার মতে, সেবা খাতে কিছু বিনিয়োগ হচ্ছে। সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। শ্রমঘন শিল্প সহায়ক অবকাঠামোর অভাব রয়েছে।
শিল্প বিনিয়োগের স্থবিরতা যে শুধু গ্যাস ও বিদ্যুত্ সংকটের কারণে সৃষ্ট তা নয়, বরং অনেক উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী, কিন্তু ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হার বিনিয়োগকে নির"ত্সাহিত করছে। সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে গেছে। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রদান কমছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হার বিনিয়োগে নিরুত্সাহিত হয়। আবার ডলারের বিনিময় মূল্য বেশি হওয়ার কারণে কাঁচামাল, যন্¿পাতি আমদানি ব্যয় দিন দিন বেড়েই চলেছে।
১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এ দেশে বহুবার সরকার পরিবর্তন হয়েছে। এ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ নতুন করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করে। পুরনো সরকার যায়, নতুন সরকার আসে। সব সময়ই আগের সরকার বর্তমান সরকারের জন্য রেখে যায় বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সংকট ও সমস্যা। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এসব সংকট-সমস্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করে নতুন সরকার। রাজনৈতিক দলগুলো নিজ স্বার্থ চিন্তায় এত মগ্ন থাকে যে তারা যে ব্রত নিয়ে যাত্রা শুরু করে তা এক অর্থে ভুলেই যায়। দেশস্বার্থ নয়, বরং নিজের পকেট ভরাই তাদের প্রধান কাজ হয়ে ওঠে।
লেখক : প্রভাষক, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি