একাত্তরের চিঠিগুলোর কী উত্তর দেব আমরা?

Author Topic: একাত্তরের চিঠিগুলোর কী উত্তর দেব আমরা?  (Read 2382 times)

Offline Badshah Mamun

  • Administrator
  • Hero Member
  • *****
  • Posts: 2002
    • View Profile
    • Daffodil International University
মৃত্যুর আগে কেউই জানে না জীবনের মূল্য ও পরিণতি। কিন্তু শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা জেনেছিলেন। চিঠিটা পড়ুন:

‘‘প্রিয় আব্বাজান! টেকেরঘাট হইতে
তাং-৩০/৭/৭১
আমার সালাম নিবেন। আশা করি খোদার কৃপায় ভালই আছেন। বাড়ির সকলের কাছে আমার শ্রেণীমত সালাম ও স্নেহ রইলো। বর্তমানে যুদ্ধে আছি। আলীরাজা, মাহতাব, রওশন, রুনু, ফুলমিয়া, ইব্রাহিম সকলেই একত্রে আছি। দেশের জন্য আমরা সকলেই জান কোরবান করিয়াছি। আমাদের জন্য ও দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য দোয়া করবেন। আমি জীবনকে তুচ্ছ মনে করি, কারণ দেশ স্বাধীন না হইলে জীবনের কোন মূল্য থাকিবে না। তাই যুদ্ধকে জীবনের পাথেয় হিসাবে নিলাম।
আমার অনুপস্থিতিতে মাকে কষ্ট দিলে আমি আপনাদের ক্ষমা করিব না। পাগলের সব জ্বালা সহ্য করিতে হইবে। চাচা-মামাদের ও বড় ভাইদের নিকট আমার ছালাম। বড় ভাইকে চাকুরীতে যোগ দিতে নিষেধ করিবেন। জীবনের চেয়ে চাকুরী বড় নয়। দাদুকে দোয়া করিতে বলিবেন। মৃত্যুর মুখে আছি। যে কোন সময় মৃত্যু হইতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত আছি। দোয়া করিবেন মৃত্যু হইলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে পুত্র হারাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন। আর আমার জন্য চিন্তার কোন কারণ নাই। আপনার দুই মেয়েকে পুরুষের মত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। তবেই আপনার সকল সাধ মিটে যাবে।
দেশবাসী! স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য দোয়া কর। মীরজাফরী করিও না, কারণ মুক্তিফৌজ তোমাদেরকে মাফ করিবে না এবং এই বাংলায় তোমাদের জায়গা দেবে না।
সালাম! দেশবাসী সালাম!
ইতি, মোঃ সিরাজুল ইসলাম, ৩০-৭-৭১ ইং’’

এর আট দিন পর কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র সিরাজ সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের যুদ্ধের কমান্ডার হিসেবে জয়ী হন; কিন্তু সেটাই ছিল তাঁর শেষ যুদ্ধ। জয়ের উচ্ছ্বাসে স্লোগান দিতে গিয়ে অসাবধানে পজিশন ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েন, ঠিক তখনই পলায়মান শত্রুর ‘কাভারিং ফায়ারের’ একটি বুলেট এসে লাগল তাঁর চোখে। চিকিৎসার জন্য মিত্র বাহিনীর হেলিকপ্টারে ভারতে নেওয়ার পথেই শেষ নিঃশ্বাস নির্গত হয়। সন্ধ্যায় খাসিয়া পাহাড়ের কোলে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’-এর কাছাকাছি টেকেরঘাটে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয়। পরাধীন দেশের মাটি তিনি পাননি, কিন্তু স্বাধীনতার পরও কেন এক শহীদ বীরপ্রতীককে পড়ে থাকতে হবে সীমান্তের ওপারের নো ম্যান্স ল্যান্ডে?
প্রাণের চেয়ে বড় দান আর হয় না। তবে সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মনে করতেন, প্রাণের চেয়ে বড় দান আছে, তা হলো দেশভক্তি। সিরাজ দেশের জন্য প্রাণ ও ভক্তি দুটোই দিয়েছিলেন। তাই তো বলতে পারেন, ‘আমি জীবনকে তুচ্ছ মনে করি, কারণ দেশ স্বাধীন না হইলে জীবনের কোন মূল্য থাকিবে না। তাই যুদ্ধকে জীবনের পাথেয় হিসাবে নিলাম।’ সে সময় তাঁরা আত্মদানের মতো বিমূর্ত ভাষা বলতেন না, বলতেন ‘জান কোরবান’ করার কথা।
ছোট্ট একটি চিঠি, কিন্তু কেবল নিষ্ঠার শুদ্ধতাতেই নয়, নীতির শক্তিতেও অসামান্য। একাত্তরের চিঠির বেশির ভাগ চিঠিই মাকে সম্বোধন করা (প্রথমা প্রকাশন, ২০০৯)। সেই মা কেবল ব্যক্তিগত মা নন, যোদ্ধা ছেলে নিজে যেমন দেশের সন্তান হয়ে ওঠে, তেমনি জননীকেও ভাবে দেশমাতৃকার আদলে। ১৯ নভেম্বর, ১৯৭১ ‘যুদ্ধখানা হইতে তোমার পোলা’ নুরুল হক মাকে লেখেন, ‘আমার মা, আশা করি ভালোই আছ। কিন্তু আমি ভালো নাই। তোমায় ছাড়া কীভাবে ভালো থাকি! তোমার কথা শুধু মনে হয়। আমরা ১৭ জন। তার মধ্যে ছয়জন মারা গেছে, তবু যুদ্ধ চালাচ্ছি। শুধু তোমার কথা মনে হয়, তুমি বলেছিলে, “খোকা মোরে দেশটা স্বাধীন আইনা দে,’’ তাই আমি পিছুপা হই নাই, হবো না, দেশটাকে স্বাধীন করবই। রাত শেষে সকাল হইব, নতুন সূর্য উঠব, নতুন একটা বাংলাদেশ হইব...।’ জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে দেশমাতা আর জন্মদায়িনী যখন একাকার, তখন মায়ের ছেলেরাও অনায়াসে দেশের ছেলে হয়ে যায়।
কিন্তু সিরাজ মাকে সম্বোধন করে লিখতে পারেননি, কারণ মা ‘পাগল’। যোদ্ধা পুত্র তাই বাবাকে সম্বোধন করে লেখেন। তাতেও তাঁর উদ্বেল হূদয় তৃপ্ত হয় না; চিঠিটার শেষে তিনি দেশবাসীকেই ডাকেন:
‘দেশবাসী! স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য দোয়া কর। মীরজাফরী করিও না, কারণ মুক্তিফৌজ তোমাদেরকে মাফ করিবে না এবং এই বাংলায় তোমাদের জায়গা দেবে না।’
পরিবারের দায়িত্ব হিসেবে বাবাকে যা বলেন, তা অসাধারণ।
‘আমার অনুপস্থিতিতে মাকে কষ্ট দিলে আমি আপনাদের ক্ষমা করিব না। পাগলের সব জ্বালা সহ্য করিতে হইবে।’
ভাইয়ের নিরাপত্তা নিয়ে এক বাক্যের উদ্বেগের পরই বোনদের বিষয়ে বলেন, ‘আপনার দুই মেয়েকে পুরুষের মত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। তবেই আপনার সকল সাধ মিটে যাবে।’
একাত্তরের চেতনার দলিল ইতিহাসে যত না, তার থেকে বেশি মিলবে মুক্তিযোদ্ধাদের এসব চিঠিতে। চিঠিটা তিনি শেষ করেন জাতির প্রতি ডাক দিয়ে:
‘দেশবাসী! স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য দোয়া কর। মীরজাফরী করিও না, কারণ মুক্তিফৌজ তোমাদেরকে মাফ করিবে না এবং এই বাংলায় তোমাদের জায়গা দেবে না।’
পরিবার ও দেশের জন্য তাঁর এই নির্দেশনার মধ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশের সত্যিকার মুক্তির শর্ত নিহিত ছিল। কিন্তু একাত্তরের পরের ইতিহাস সেই সব নির্দেশনা অমান্য করারই ইতিহাস।
যে ‘যুদ্ধকে জীবনের পাথেয় করে’ নিয়েছিলেন সিরাজরা, সেই যুদ্ধ পেরিয়ে তাঁরা আসতে পারেননি বর্তমানে। কিন্তু তাঁদের কৃতকর্ম, তাঁদের স্মৃতি ও চিঠির অস্তিত্ব এক নিত্য বর্তমানে। যখনই পড়ি এই চিঠিগুলো, মনে ভাসে বাংকারে শায়িত, অথবা অন্ধকারে নদী পেরোনো অথবা প্রশিক্ষণ শিবিরের তাঁবুতে রাত জাগা কোনো যুবকের ছবি। জীবিতের ক্ষয় আছে, শহীদেরা অক্ষয়, তাঁদের বয়স কখনো বাড়ে না। একাত্তরের চল্লিশ বছর পরও তাঁরা যুবকই রয়ে যান আমাদের মনে।
দেশটা বধ্যভূমিময়। আজকের তরুণ, যে মাটিতেই পা রাখো, জানবে আশপাশে কোথাও নিশ্চয়ই আছে কোনো না কোনো শহীদের গায়েবি কবর। তাই মাটির দিকে তাকিয়ো, জানিয়ো তোমার বা তোমার চেয়ে কম বয়সী কারও রক্ত-অস্থি-মাংস-চক্ষু সেই মাটিতে মিশে আছে। এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে এই ভাবনা আমাকে থরথর করে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। মনে হলো, ওখানে যে শুয়ে আছে, সে তো আমার চেয়েও কম বয়সী! একাত্তরের জাতকেরা এখন স্বাধীনতার সমান কিংবা কিছু বেশি বয়সী। তাদের মনেও নিশ্চয়ই এই অনুভূতি জাগে, কবরে শায়িত তাদের বাবা তাদের চেয়ে কত ছোট! কেবল বয়স পেরোনোর যোগ্যতাতেই আমরা এগিয়ে, কিন্তু তাদের সমান অবদান রাখার সুযোগ আমাদের কি হবে! আমাদের সময়ের তরুণেরা কি পারবে মুক্তিযুদ্ধের ফেলে আসা রণাঙ্গনে, মাটিচাপা বধ্যভূমিগুলোতে, লাখ লাখ ধর্ষিতার পিঠের নিচের অন্ধকার বাংলাদেশে, গোপন বন্দিশালায়, এক কোটি শরণার্থীর দেশত্যাগের মর্মান্তিক যাত্রাপথে, আহত-পর্যুদস্ত মুক্তিযোদ্ধা আর ভুক্তভোগীদের স্মৃতির মণিকোঠায় কোনো দিন পৌঁছাতে? যেখানে যন্ত্রণার শিখা অনির্বাণ জ্বলে। যে জীবন একাত্তরের, তার সঙ্গে কি আমাদের হবে দেখা?
যদি দেখা হয়, যদি জানা হয়, তাহলে তারা প্রশ্ন করবে, মেহনতি মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হকের ‘রাত শেষে সকাল হইব, নতুন সূর্য উঠব, নতুন একটা বাংলাদেশ হইব...’ এই বিশ্বাস কেন ব্যর্থ হয়েছে? শহীদ সিরাজের আকাঙ্ক্ষা মতো কেন বাংলাদেশের মেয়েরা পুরুষের সমান শিক্ষা ও অধিকার পায়নি? হত্যা, ধর্ষণ, শোষণ-লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জিতেও কেন হত্যা-ধর্ষণ, শোষণ-লুণ্ঠন কমিয়ে আনা যায়নি? কেন মীরজাফররা এখনো বাংলার মাটিতে প্রতাপের সঙ্গে বিরাজ করছে? কেন শিশুরাষ্ট্র বাংলাদেশ রূপকথার পিটারপ্যানের মতো শিশুই রয়ে গেল; আর পরিণত হলো না। হিসাব মেলে না। একাত্তরের অসম্পূর্ণ হিসাব মেলানোর দায় আজকের তরুণদের সামনে।
প্রয়াত সেক্টর কমান্ডার বীরোত্তম কর্নেল (অব.) নুরুজ্জামানকে একদিন টিভিতে দেখি। দেশের ভেতরে যুদ্ধ থেকে ফিরে শরণার্থী-শিবিরে এক অন্ধ বৃদ্ধকে পেয়েছিলেন। বৃদ্ধটির সন্তান যুদ্ধে গেছে। অনেক দিন নিখবর। কমান্ডারকে কাছে পেয়ে তাঁর সে কী উচ্ছ্বাস। তিনি কর্নেলের হাত ছুঁলেন, চোখ ছুঁলেন। তারপর সেই স্পর্শ নিজের দৃষ্টিহীন চোখে মাখিয়ে নিয়ে বললেন, ‘বাবা, তোমার এই হাত যুদ্ধ করেছে, তোমার চোখ দেশের মাটি-গাছ-পাখি দেখেছে। বাবা, আমি চোখে দেখি না। তুমি তো দেশ থেকে এসেছ, তুমি বলো আমার দেশ কি এখনো তেমন সবুজ, আমার মাটি কি এখনো তেমন সজল? এখনো কি সেখানে পাখিরা ডাকে?’ অন্ধ বৃদ্ধ সন্তানের জন্য কাঁদেননি, কেঁদেছিলেন বিধ্বস্ত দেশের শোকে? ঘটনার ৩৬ বছর পর সেই কথা বলতে বলতে বৃদ্ধ কর্নেলের গাল ভেসে যাচ্ছিল অশ্রুতে। তিনি ফোঁপাচ্ছিলেন। একাত্তরের চিঠিগুলো পড়ে তেমন দমকানো কান্না আসে। অশ্রুও কখনো কখনো ক্ষারের মতো কাজ করে। আমাদের জাতীয় আত্মার ময়লা ধুতে এমন ক্ষার এখন অনেক প্রয়োজন।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
Source : http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-12-14/news/208556
Md. Abdullah-Al-Mamun (Badshah)
Senior Assistant Director
Daffodil International University
01811-458850
cmoffice@daffodilvarsity.edu.bd
www.daffodilvarsity.edu.bd

www.fb.com/badshahmamun.ju
www.linkedin.com/in/badshahmamun
www.twitter.com/badshahmamun

Offline arefin

  • Hero Member
  • *****
  • Posts: 1173
  • Associate Professor, Dept. of ETE, FE
    • View Profile
So touchy. RIP all of our freedom fighters. Amin
“Allahumma inni as'aluka 'Ilman naafi'an, wa rizqan tayyiban, wa 'amalan mutaqabbalan”

O Allah! I ask You for knowledge that is of benefit, a good provision and deeds that will be accepted. [Ibne Majah & Others]
.............................
Taslim Arefin
Assistant Professor
Dept. of ETE, FE
DIU