একাত্তরের চিঠি
স্মৃতির মাস ডিসেম্বর। এ মাসে বাঙালি ঝাপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেকেই আত্মীয় পরিজনের কাছে চিঠি লেখেন। বিজয়ের চার দর্শক উপলক্ষে হৃদয়স্পর্শী চারটি চিঠি পত্রস্থ হলো।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি
নয়াদিলি্ল
ডিসেম্বর ৬, ১৯৭১
প্রিয় প্রধানমন্ত্রী,
৪ঠা ডিসেম্বর তারিখে মাননীয় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আপনি যে বার্তা পাঠিয়েছেন তা পেয়ে আমি ও ভারত সরকারের আমার সহকর্মীবৃন্দ গভীরভাবে অভিভূত হয়েছি। বার্তাটি পেয়ে ভারত সরকার আপনার নিবেদিতপ্রাণ নেতৃত্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য আপনার অনুরোধ পুনর্বিবেচনা করেছে। আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে বিদ্যমান বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে ভারত সরকার স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আজ সকালে এ বিষয়ে পার্লামেন্টে আমি একটি বিবৃতি প্রদান করেছি।
অনুলিপি প্রেরণ করা হলো।
বাংলাদেশের জনগণকে প্রচুর দুর্ভাগ পোহাতে হয়েছে। আপনাদের যুবসমপ্রদায় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য এক আত্মোৎসর্গীকৃত সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। ভারতের জনসাধারণও অভিন্ন মূল্যবোধের প্রতিরক্ষায় যুদ্ধ করছে। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে মহান উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই সহমর্মিতা প্রচেষ্টা ও ত্যাগ দুই দেশের মৈত্রীকে আরও সুদৃঢ় করবে। পথ যতই দীর্ঘ হোক না কেন এবং ভবিষ্যতে দুই দেশের জনগণকে যত বড় ত্যাগ স্বীকারই করতে বলা হোক না কেন আমি নিশ্চিত যে জয় আমাদের হবেই।
এই সুযোগে আপনাকে, আপনার সহকর্মীগণকে এবং বাংলাদেশের বীর জনগণকে আমার প্রীতিসম্ভাষণ ও শুভকামনা জ্ঞাপন করছি।
আমি এই সুযোগে আপনার মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের প্রতি আমার সর্বোত্তম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
আপনার একান্ত
[ইন্দিরা গান্ধী]
BANGLADESH LIBERATION COUNCIL
বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম পরিষদ
কামরুল ভাই,
আমাদের যে সমস্ত Painter রা ওখান থেকে এসেছেন, তাদের সবার নাম-ঠিকানা কি আপনার কাছে আছে? সবার নাম এবং ঠিকানাগুলো অবিলম্বে দরকার।
Painter দের সবার জন্যে কিছু টাকা-পয়সার আয়োজন হচ্ছে। তাদের সবার সঙ্গে অবিলম্বে আমার একটু যোগাযোগ হওয়া দরকার। আমি একমাত্র আপনার আর মুস্তাফা মনোয়ার ছাড়া আর কারও ঠিকানা জানি না। সবার নাম এবং ঠিকানা হয়তো আপনার কাছ থাকতে পারে, তাই লিখলাম।
আমি দু-এক দিনের মধ্যে আপনার সঙ্গে দেখা করব। কমার্শিয়াল পেইন্টাররাও যদি কেউ এসে থাকে, তাদের নাম ঠিকানা দরকার।
[জহির রায়হান]
[চলচ্চিত্রকার ও কথাশিল্পী শহীদ জহির রায়হান ১৯৭২ সালেল ৩০ জানুয়ারি মিরপুরে তার বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে যেয়ে তিনি নিখোঁজ হন। এই চিঠিটি তিনি পটুয়া কামরুল হাসানকে লিখেছিলেন। কামরুল হাসানমুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের হিংসমুখ এঁকে যুদ্ধের বয়াবহতা প্রমাণ করেছিলেন।]
প্রিয় মোয়াজ্জেম সাহেব,
তসলিম। আশা করি খোদার রহমতে কুশলে আছেন। কোনোমতে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে [মুরগি যেমন তার ছানাগুলো ডানার তলে রাখে] বেঁচে আছি। পত্রবাহক আপনার পূর্বে দেওয়া আশ্বাস অনুযায়ী আপনার কাছেই যাচ্ছে। স্বাপদসংকুল ভরা এ দুনিয়ার পথ। নিজের হেফাজতে যদি রাখতে পারেন। তবে খুবই ভালো নতুবা নিরাপদ স্থানে [চিতলমারীর অভ্যন্তরে কোনো গ্রামে] পেঁৗছানোর দায়িত্ব আপনার। বিশেষ লেখার কিছু দরকার মনে করি না। মানুষকে মানুষে হত্যা করে আর মানুষের সেবা মানুষেই করে। হায়রে মানুষ! আমার অনুরোধ আপনি রাখবেন জানি- তা সত্ত্বেও অনুরোধ থাকল।
ইতি আপনাদের
আবদুস হাসিব চৌধুরী
[চিঠিটি মুক্তিযোদ্ধা আবদুস হাসিব চৌধুরীর লেখা। ১৯৭১ সালে তার ঠিকানা ছিল আমিনা প্রেস, কোর্ট মসজিদ রোড, বাগেরহাট। এ চিঠির প্রাপক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। বাগেরহাট পি.সি. কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক।]
বুলবুল,
আমি ফলদা আছি। সামাদ এলে তাকে ওখানেই রেখে দিবেন। এখানে আমি কোথায় কোন জিনিস রাখা হয়েছে তার খোঁজ খবর নিচ্ছি। কয়েক দিনের মধ্যে ভুয়াপুর আক্রমণ হবার সম্ভাবনা নেই। কাজেই জনগণকে সাহস দিয়ে রাখবেন। আমি খুব অস্বস্তি বোধ করছি। যা যা করা দরকার তা করিও। ডাক্তার দিয়ে পায়ে বেনডিচ [ব্যান্ডেজ] করিও। লতিফকে এখানে পাঠিয়ে দিও।
ইতি
এনাযেত করিম
[চিঠির লেখক মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত করিম। কাদেরিয়া বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় হেডকোর্য়াটার, ভুয়াপুরের প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন। এর প্রাপক বুলবুল খান মাহবুব ছিলেন কাদেরিয়া বাহিনীর উপদেষ্টামন্ডলীর অন্যতম সদস্য। চিঠির ঠিকানা ছিল: আব্দুস ছাত্তার খান [বাবু] গ্রাম ও ডাকঘর অর্জুনা, উপজেলা: ভুয়াপুর, জেলা: টাঙ্গাইল।]
Source :
http://www.bd-pratidin.com/?view=details&type=gold&data=Airline&pub_no=588&cat_id=3&menu_id=51&news_type_id=1&index=2