ব্যাংকিং খাতের সমস্যা গোটা অর্থনীতিকে চাপের মুখে ফেলে দিয়েছে
লেখক: মুনমুন শবনম বিপাশা | সোম, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০১২, ১ ফাল্গুন ১৪১৮
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অর্থনৈতিক খাতে বিভিন্ন ধরনের চাপের মধ্যে অন্যতম আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হলো ব্যাংকিং খাত। ব্যাংকিং খাতে চাপ সৃষ্টি হওয়ার ফলে আমাদের দেশের গোটা অর্থনীতিতেই এর প্রভাব পড়ছে। ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রথমত হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের অতিরিক্ত ঋণগ্রহণ, দ্বিতীয়ত, ব্যাংকিং সেক্টরে সৃষ্টি হয়েছে তারল্য সংকট, তৃতীয়ত, টাকার অবমূল্যায়ন অর্থাত্ টাকার বিনিময়ে ডলারের দাম বাড়ার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ও চতুর্থত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট। এসবের প্রভাব হিসেবে অর্থনীতিতে বিভিন্নমুখী চাপ সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে বেড়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কমেছে শিল্প বিনিয়োগের পরিমাণ, অন্যদিকে ঋণের সুদহার বেড়ে শিল্প সংকুচিত হওয়ায় জনগণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে গোটা অর্থনীতিতেই চাপ ছড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতিতে সামঞ্জস্যের বড় অভাব রয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্¿ণের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করছে। বছর শেষে তা সফল হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ হলো, সরকারকে ঋণের জোগান দিতে গিয়ে ব্যাংককে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি ঋণ ও মুদ্রার জোগান দিতে হচ্ছে। সরকার অতিরিক্ত ভর্তুকির চাপ সামলাতে ব্যাংকিং সেক্টরের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারছে না। বেশি দামে জ্বালানি তেল আমদানি করে তা কম দামে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রে বা রেন্টাল পাওয়ারে সরবরাহ করতে গিয়ে সরকার বেশি চাপের মুখে পড়ে যাচ্ছে। এ চাপ সামাল দিতে ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিচ্ছে প্রচুর পরিমাণে। সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ যেমন কমছে, তেমনিভাবে সৃষ্টি হচ্ছে অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি। অর্থ সংকটে পড়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চারটি ব্যাংকসহ বেসরকারি খাতের অনেক ব্যাংককেই কলমানি মার্কেট থেকে ধার নিয়ে দৈনন্দিন খরচ মেটাতে হচ্ছে। কিছু কিছু ব্যাংক প্রতিদিন মুদ্রাবাজার থেকে ৪শ’ থেকে ৫শ’ কোটি টাকা ধার করে চলছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সংস্থার মতে, সরকারকে অর্থ দিতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো চাপের মধ্যে রয়েছে। ব্যাংকগুলোর প্রধান সমস্যা হলো আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি দিচ্ছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১৮ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। অথচ ২২ নভেম্বর, ২০১১-এর হিসাবে এ ঋণের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ২০৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার কিছু পরিমাণে ঋণ পরিশোধ করেছে। ব্যাংকিং সেক্টর থেকে সরকার যে ঋণ নিচ্ছে এর মধ্যে সিংহভাগ টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ দেওয়ার জন্য নতুন নোট ছাপাচ্ছে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১১-এর জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার ব্যাংক থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। অথচ ২০১০-এর এ সময়ে ঋণগ্রহণ করেছিল ২ হাজার কোটি টাকা। অর্থশাস¿ অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ গ্রহণ করলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। কারণ এ ধরনের অর্থকে বলা হয় ‘হাই পাওয়ারড মানি’। এ ধরনের ১ টাকা বাজারে এলে প্রকৃত সরবরাহ বাড়ে ৪ টাকা ৮০ পয়সার মতো। ফলে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সরকার যে পরিমাণ অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে, বাজারে তার প্রভাব পড়েছে প্রায় ৪ দশমিক ৮০ গুণ। এভাবে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় দেশের মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়ছে।
সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে ঋণ করায় দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। গত নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১.৯৭ শতাংশ। এ হার এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। তাছাড়া অনেক দিন ধরেই দেশের মূল্যস্ফীতির হার দুই অংকের ঘরে। এদিকে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ায় সীমিত আয়ের মানুষের ওপর এর তীব্র নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ফলে জনগণকে জীবন নির্বাহে আগের তুলনায় বেশি খরচ করতে হচ্ছে। ফলে একদিকে কমে যাচ্ছে ক্রয় ক্ষমতা, অন্যদিকে কমে যাচ্ছে সঞ্চয় প্রবণতা। এতে ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি কমছে। কারণ মানুষ টাকা উঠিয়ে নিচ্ছে। ফলে ব্যাংকিং খাতে সৃষ্টি হয়েছে তারল্য সংকট। তারল্য সংকট থাকায় মাসখানেক ধরে কলমানি রেট ২০ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে। এদিকে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে মুদ্রানীতির অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার অর্থাত্ সিআরআর বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে তীব্র হয়ে উঠছে তারল্য সংকট। এক সময় ছিল যখন ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে প্রচুর ঋণ দিত। এখন ব্যাংকগুলো ঋণই দিতে চায় না। ব্যবসায়ীরা প্রায়ই বলছেন, তারল্য সংকটের জন্য ব্যাংকগুলো যতটুকু ঋণ দেয় তার সুদ অনেক বেশি। ফলে নতুন বিনিয়োগ অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ছে। যা যে কোনো দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ক্ষতির কারণ।
আইএমএফ প্রত্যেক দেশের জন্য অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমপরিমাণ রিজার্ভ রাখতে পরামর্শ দেয়। সে হিসাবে বাংলাদেশে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারকদের মতে, এ রিজার্ভ হওয়া উচিত ৯ বিলিয়ন ডলার। ২০১১-এর শেষের দিকে এ রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। অথচ এর আগের দুই বছর রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ছিল। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উত্স হলো রেমিট্যান্স, রফতানি আয় এবং বিদেশি ঋণ ও অনুদান। অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের দেশে রেমিট্যান্স বাড়ানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, তেমনিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি রফতানি আয় বৃদ্ধির। বরং জ্বালানি তেল, সার ও ভোগ্যপণ্য আমদানি করার জন্য রিজার্ভ থেকে খরচ করা হচ্ছে। ফলে প্রায় ২ বছর পর গত জানুয়ারি মাসের ৯ তারিখে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৮ বিলিয়নের ঘরে নেমে আসে।
বর্তমানে দেশে বাণিজ্যিক লেনদেনের ভারসাম্যে বেশ চাপ রয়েছে। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি আমদানি বৃদ্ধির কারণে লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ বাড়ছে। ফলে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে, অন্যদিকে সৃষ্টি হচ্ছে ডলার সংকট। বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড়ের ক্ষেত্রেও দুর্বলতা লক্ষণীয়। ২০১১ সালের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৩৩ কোটি ডলার বৈদেশিক সাহায্য লাভ করে। যা ২০১০ সালের তুলনায় ২৬ শতাংশ কম। একই সময়ে সরকারকে ৩২ কোটি ডলারের ঋণ শোধ করতে হয়েছে। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে আমদানি শেষে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ছিল ৭১ টাকা ২২ পয়সা। বর্তমানে ৮৪ টাকার ওপরে। যখন ব্যাংকিং সেক্টরে ডলারের দাম খুব দ্রুত বাড়তে থাকে তখন বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ডলার বাজারে ছেড়ে দেয়। যাতে করে ডলারের দাম খুব বেশি না বাড়ে। রিজার্ভ কমতে থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক খুব বেশি ডলার বাজারে ছাড়তে পারছে না। ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন রোধ করা যাচ্ছে না।
লেখক : প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি