মুসলিম চেতনায় হজ্জের তাrপর্য
ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
আল্লাহর সাথে সম্পর্কের গভীরতা হচ্ছে তাকওয়া ও ইবাদাতের চেতনায় উদ্বুদ্ধ মুসলমানদের অমূল্য সম্পদ। আর হজ্ব সেই তাকওয়া ও ইবাদাতের এক রূপময় কর্মশালা এবং ঈমানের অনুপম মাহাত্ম্য অর্জনের এক সমৃদ্ধ পাঠশালা। হজ্ব নামক এ পাঠশালাতেই আল্লাহর সাথে গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের সম্পর্ক, আনুগত্যের নানামুখী সুষমায় সিক্ত হয় তাদের মন, আল্লাহর সামনে দীনতা-হীনতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঔজ্জ্বল্য পায় তাদের হৃদয়।
হজ্বের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখিরাতের নানাবিধ কল্যাণের বিপুল সমারোহ ঘটিয়েছেন বলেই সেইসব কল্যাণ অর্জনকে তিনি হজ্বের ল্যমাত্রা হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। তিনি কুরআনে ঘোষণা করেছেন, “আর তুমি মানুষের মধ্যে হজ্বের ঘোষণা দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ীণকায় উষ্ট্রসমূহের পিঠে চড়ে, তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে; যাতে তারা প্রত্য করতে পারে তাদের জন্য নির্ধারিত সকল কল্যাণ।†(সূরা হাজ্ব : ২৭, ২৮)
সুদীর্ঘকাল ধরে এসকল কল্যাণের ফল্গুধারা মুসলিম মানসকে করেছে সমৃদ্ধ, চেতনাকে করেছে উজ্জীবিত, ইবাদাতকে করেছে সুষমামণ্ডিত এবং প্রাত্যাহিক জীবনকে করেছে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যে অলংকৃত। হজ্ব নামক ইবাদাতের সুবিশাল পাঠশালার সেসব কল্যাণের মহাসম্ভার থেকে আমরা প্রধানতম বিষয়গুলোকে নিচে আলোচনার জন্য বেছে নেব।
প্রথমত: মহান আল্লাহর দেয়া শরীয়তের প্রতি নিরংকুশ সমর্থন ও আÃসমর্পণ
আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, “তোমার রবের কসম, তারা মুমিন হবে না যতণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর তুমি যে ফয়সালা দেবে সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোন দ্বিধা অনুভব না করে এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেয়।†(সূরা আন্-নিসা : ৬৫) দ্বিধাহীন আনুগত্যের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহারণ হল হজ্ব। পবিত্র স্থানসমূহের মধ্যে হাজীদের বিচরণ, বায়তুল্লায় তাদের তাওয়াফ, হাজাবে আসওয়াদে চুম্বন ও জামারাতে কংকর নিপে ইত্যাদিসহ হজ্বের সকল কর্মকাণ্ডেই স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় শরীয়তের প্রতি আনুগত্য পোষণ আÃসমর্পণ ও সর্বান্তকরণে শরীয়তের সকল বিধি-বিধান মেনে নেয়ার জীবন্ত উদাহরণ।
হজ্বের এ পবিত্র ভূমিতে এসেই আল্লাহর নবী ইবরাহীম ও ইসমাঈল আ. তাদের নিজেদের জন্য অনাগত সন্তানদের জন্য অনুগত মুসলিম হওয়ার দোয়া করেছিলেন, “হে আমাদের রব, আমাদেরকে আপনার অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধরদের মধ্য থেকে আপনার অনুগত জাতি বানান। আর আমাদেরকে আমাদের ইবাদাতের বিধি-বিধান দেখিয়ে দিন এবং আমাদেরকে মা করুন। নিশ্চয় আপনি মাশীল, পরম দয়ালু।†(সূরা আল-বাকারাহ : ১২৮)
হজ্বের সেই পবিত্রভূমিসমূহে আজো তাই হাজীগণের আগমন ঘটে নিরংকুশ আনুগত্যের সে মহড়া দেয়ার জন্যই। আর উমার ইবনুল খাত্তাব রা. হাজাবে আসওয়াদকে চুম্বন করতে গিয়ে এ দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিধ্বনি করেছেন এ বলে সে, “নিশ্চয়ই আমি জানি তুমি একটি পাথর, তুমি কোন তি করতে পারনা এবং কোন উপকারও করতে পারনা, রাসূল সা. তোমাকে চুম্বন করছেনÑ এটা যদি আমি না দেখতাম, তাহলে তোমাকে চুম্বন করতাম না।†(সহীহ বুখারী ৩/৪৬৩)
দ্বিতীয়ত : তাওহীদ তথা একত্ববাদের চর্চা ও প্রতিষ্ঠা
মহান হজ্বব্রতের সকল বিধান ও কর্মকাণ্ডই তাওহীদ তথা একাত্ববাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষের চিন্তা-চেতনা ও কর্মে একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করাই হজ্বের অন্যতম ল্য। আল্লাহ বলেন, “আর তোমরা হজ্ব ও ওমরাহ আল্লাহর জন্য সম্পন্ন কর।†(সূরা আল বাকারাহ : ৯৬)
কা'বাকে শিরকমুক্ত করার প্রসঙ্গটি এনে আল্লাহ বলেন, “আর স্মরণ কর, যখন আমি ইবরাহীমকে সে ঘরের (বায়তুল্লাহর) স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম, আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না, আর আমার ঘরকে পাক-সাফ রাখবে তাওয়াফকারী, রুকু-সিজদাকারী ও দাঁড়িয়ে সালাত আদায়কারীদের জন্য।†(সূরা আল হাজ্ব : ২৬)
হজ্বের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নের েেত্র তাওহীদকেই প্রিয়নবী সা. তাঁর জীবনের মধ্যমণি বানিয়েছেন ও এর জন্যই সর্বস্ব উৎসর্গ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। পবিত্র হজ্ব পালনে রাসূলুল্লাহ সা. এর নিুবর্ণিত কর্মধারা ও আমল একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে এ বিষয়টি মূর্ত হয়ে উঠে।
১. তালবিয়া : তালবিয়া হচ্ছে হজ্বের শ্লোগান। আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য ও তাগূতকে অস্বীকার করার উদ্দেশ্যেই ইহরামের নিয়্যত করার সাথে সাথেই তালবিয়া পাঠ হাজীদের জন্য নিয়ম করে দেয়া হয়েছে। তালবিয়ার ঘোষণায় একথা শনৈ: শনৈ: অনুরণিত হতে থাকে যে, “ইবাদাত-আরাধনা, জীবন-মরণ সবকিছুই একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত।†জাবের রা. বলেন, ‘তাওহীদ দিয়েই রাসূল সা. তালবিয়া শুরু করলেন ও বললেন, “আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির। আমি হাজির, তোমার কোন শরীক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা, নেওয়ামত ও রাজত্ব তোমার, তোমার কোন শরীক নেই।†(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২১৮)
২.
তালবিয়ার শব্দমালায় এক আল্লাহর সান্নিধ্যে হাজিরা দেয়া ও তাঁর লাÑশরীক হবার ঘোষণা বারবার উচ্চরিত হয়, আলোড়িত হয় একত্ববাদ অবিচল দৃঢ়তায়। তালবিআ যেন সকল পৌত্তলিকতা, প্রতিমা-পূজা অথবা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন সত্তার সমীপে দীনতা-হীনতা ও আনুগত্য প্রকাশের বিরুদ্ধে এক অমোঘ ঘোষণা, যে ঘোষণার সার্থক রূপায়ন ঘটতে দেখা যায় রাসূলুল্লাহ সা. এর জীবনে শিরক ও মুশরিকদের সকল অসার কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে ও অনুসারী সকল সাহাবাকে মুক্ত করে নেয়ার মাধ্যমে।
২. ইবাদাত পালনে ইখলাস ও ঐকান্তিক নিষ্ঠা যেন অর্জিত হয় এবং রিয়া ও প্রদর্শনেচ্ছা থেকে যেন দূরে থাকা যায় সে জন্য মহান রবের দরবারে আকুতি প্রকাশ তাওহীদমুখীতারই অন্তর্গত। আনাস রা. থেকে একটি সারফু হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “হে আল্লাহ, এমন হজ্ব চাই যা হবে রিয়া ও লোক দেখানো থেকে মুক্ত।†(সুনান ইবন মাজাহ : ২৮৯০)
৩. তাওয়াফ শেষে যে দু'রাকাত সালাত আদায় করতে হয় তাতে সূরা ইখলাস ও সূরা আল-কাফিরুন পাঠের সুন্নাত তাওহীদের প্রতি গুরুত্বেরই বহি:প্রকাশ। জাবের রা.-এর হাদীসে এসেছে, “রাসূল সা. এ দু'রাকাতে তাওহীদভিত্তিক সূরা ও ‘কূল ইয়া আইয়ুহাল কাফিরুন' পাঠ করলেন।†(সুনান আবিদাউদ, হাদীস নং-১৯১৯, সুনান আত-তিরমিযী, হাদীস নং ৮৬৯)
৪. সাফা-মারওয়ার সায়ী করার প্রাক্কালে তাওহীদ বিষয়ক দুআ' একত্ববাদের সাথে রাসূলুল্লাহ সা.-এর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে প্রকটভাবে ফুটিয়ে তোলে। জাবের রা. এর হাদীসে এসেছে, “অত:পর রাসূল সা. সাফায় আরোহন করলেন, কা'বা দৃষ্টিগ্রাহ্য হলো, তিনি কিবলামুখী হয়ে আল্লাহর একত্ববাদের কথা বললেন এবং তাঁর মাহত্ব্যের ঘোষণা দিলেন। তিনি বললেন, “আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাই নেই। তিনি একক তাঁর কোন শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, প্রশংসাও তাঁর। তিনি সকল বিষয়ের উপর মতাবান...।†(সহীহ মুসলিম ১২১৮)
৫. আরাফার দু'আ ও যিক্রসমূহে ও তাওহীদের বাণী উচ্চারিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “উত্তম দু'আ হলো আরাফার দিবসের দু'আ। আর আমিও আমার পূর্ববর্তী নভীদের সর্বোত্তম কথাটি হলÑ “আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোন ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, প্রশংসাও তাঁর। তিনি সকল বিষয়ের উপর মতাবান।â€
তৃতীয়ত: আল্লাহর নিদর্শন ও সীমারেখাসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন
মহান আল্লাহ তাঁর নিদর্শনসমূহ ও নির্ধারিত সীমারেখার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি যেসব বিষয়কে সম্মান করার নির্দেশ দিয়েছেন সেগুলোকে যথার্থভাবে সম্মান করা আল্লাহর নিষ্ঠাবান বান্দা হওয়ার শর্ত ও কল্যাণার্জনের পথ হিসাবে বিবেচিত।
পবিত্র কুরআনে হজ্বের কিছু আহকাম উল্লেখ করার পর আল্লাহ বলেছেন, “এটাই এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখার সম্মান রা করে, তার রবের কাছে তা উত্তম।†(সূরা আল হাজ্ব : ৩০) নির্ধারিত সীমারেখা বলতে পূর্বের আয়াতে বর্ণিত হজ্বের কাজগুলোকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, “ওটাই এবং যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহ সম্মান করে, তা তাদের হৃদয়ের তাকওয়ার অন্তর্গত।†(সূরা আল-হাজ্ব : ৩২) রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “এ উম্মাত ততণ পর্যন্ত কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যতণ পর্যন্ত তারা এ হারাম (অর্থাৎ কাবা) কে যথার্থবাবে সম্মান করবে, আর যখন তারা সম্মান হারাবে, তখন তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।†(সুনান ইবন মাজাহ)।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর