ঘটনা ১: একবার এক ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ফোন এলো। তাদের সেখানে অর্থপেডিক্স এর রোগী দেখতে হবে। যাবো কি যাবো না দোটানায় সাহস করেই ফেললাম। খুব যত্ন করে গাড়ি করে নিয়ে গেলো। চেম্বারে বসতেই ক্লিনিক মালিক এসে সালাম দিলো।
স্যার কেমন আছেন? আমাদের এখানে ২০/২৫ জন রোগী হয় প্রতি শুক্রবার। আপনি আসলে ভালো হবে । তবে একটা কথা...।
জি বলেন ।
এখানে যেই ডাক্তার ই আসুক না কেন রোগীদের কমপক্ষে ২০০০ টাকার টেষ্ট দেন। কারন আপনারা না দিলে এই মফস্বলে চলা আমাদের মুসকিল ।
মেজাজ টা খিচড়ে গেলো । শালা কয় কি? আমি বললাম,
ভাই, অহেতুক টেষ্ট দিব কেন?
বললেন, টেষ্ট না দিলে রোগীরাও ভাবে ডাক্তার কোন টেষ্টই দিলনা।
ঐদিন ১০/১৫ টা রোগী দেখলাম। এবং আমি আমার মত করেই দেখলাম। যেটা না হলেই না ওরকম ছাড়া টেষ্ট দিলাম ই না। ১০/১২ জন রোগী বাকী থাকতেই ক্লিনিক মালিক ঐ রোগীদের বললেন সামনের সপ্তাহে আসেন। আরো ভালো ডাক্তার আসবে।
বুঝতেই পারছেন, পরের ঐ এক সপ্তাহই । এর পরে আর ডাকেননি তিনি।
*দশদিন ডাক্তার কে নিয়ে যা তা লিখেন। ১ দিন অন্তত এই স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে অনুসন্ধান করুন। অনেক দিছু বেরিয়ে আসবে। কিভাবে এরা রোগীর টাকা বা ডাক্তারের পরিশ্রমকে পুজি করে টাকার কুমীর হচ্ছে।
ঘটনা ২: তখন সার্জারি ওয়ার্ডে ইন্টার্নশিপ করছি । রাত ৩ টার দিকে পুলিশ একটা রোগী নিয়ে এলো। রাস্তার পাশে পরে ছিল এক্সিডেন্ট করে। সাথে কেউ নেই । কিছুখন পরেই কয়েকজন শুভাকাঙ্খী চলে এলো। এরা হাসপাতালের আসেপাশেই থাকে। বিভিন্ন ঔষধের দোকানের লোক ( অন্য ভাষায় দালাল) । এসে রোগী কে বললো আপনার মোবাইল আছে ? তাহলে আপনার বাসায় ফোন দেন । বলেন আমরা আছি। মানুষতো মানুষের জন্য ই করে। ঔষধ নিয়ে চিন্তা নেই । আমরা যা লাগে দিচ্ছি । কাল দাম দিয়ে দিয়েন।
ঐগুলারে দেখেই মাথা গরম হয়ে গেল। কিন্তু কিছু বলার নেই। ইন্টার্ন হোস্টেল না থাকার কারনে বাইরে থাকতে হয় । কারো সাথে ঝামেলা হলে মোবাইল ছিনতাই হয় তার, বাসায় চুরি হয়, রাস্তায় ধমকিও খেতে হয়। তাই তাকে কিছু বলতে পারলাম না। কিন্তু আমাদের নিজদের contribution এ করা poor fund থেকে সব কিছু দিলাম। শুধু TT inj. বাদে, কারন ওটা হাসপাতালে supply নেই।
৪.৩০ পর্যন্ত সেই রোগী ম্যানেজ করলাম। পরদিন সকালে রাউণ্ডে গেলে রোগীর লোক বললো স্যার কাল রাত্রে কি এতো খরচ হয়েছে? ৪৫০০ টাকা বিল এসেছে। আমি বিস্ময়ে থমকে গেলাম। একটা TT inj. এর দাম তো ১০০-১৫০ টাকার বেশী হওয়ার কথা না । কিন্তু কিছুই করার নেই এদের বিরুদ্ধে।
হাসপাতালে রোগীদের জন্য খুব অল্প খরচে সরকার সব ব্যবস্থা করে। কিন্তু ঐ যে , দেশে তো দুই জাতির মানুষ। ডাক্তার আর নন ডাক্তার। ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করা যাবেনা তাই তারা তাদের ভাই ঐসব মানুষের কথা বিশ্বাস করে । ফলে অল্প খরচে সব কিছু সহ প্লাস্টারের ব্যাবস্থা করে দিবে বলে ২৫০০ টাকা রাখে। তাড়াতাড়ি ওটির ব্যাবস্থা করে দিবে বলে ৫/৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়, এমন কি লাশ নিয়ে পর্যন্ত চলে বানিজ্য। একেক জন কর্মচারীর ৫/৬ তলা বাড়ি থাকে। আর সে বাড়িতে ভাড়া থাকি আমরা ডাক্তাররা ।
ঘটনা ৩ : কয়েকদিন ধরেই মায়ের হাটুতে ব্যাথা। যেতে পারছি না বাড়িতে । ফোন এ যা শুনেছি আর ১ বছরের অর্থপেডিক্স অভিজ্ঞতায় যা মনে হয়েছে, Degenerative Osteoarthritis of knee...কারন উপসর্গ গুলো সেরকম ই। আমি ছোট ডাক্তার । আমার কথায় বিশ্বাস আনা কষ্ট। তাই মাকে বললাম। ওমুক স্যার তো প্রতি শুক্রবার আসেন । ওনাকে দেখাও। মা একজন এম এস করা অর্থপেডিক্স সার্জন এর কাছে গেলেন । তিনি তাকে ASO, S. Uric aci, RA test, X ray knee B/V সহ ১৫০০ টাকার টেষ্ট দিলেন। আর যেহেতু আমি ডাক্তার সেটা তিনি জানেন তাই ১৫% দয়া (discount) করলেন। উল্লেখ্য ঐ ডায়াগনস্টিক সেন্টার টা তারই । ওখানে যারা টেষ্ট করে তারা কিছুদিন আগে পানের দোকান করতো। আর এতো টেষ্ট দেয়ার যৌক্তিকতা টাও ধরতে পারছিনা । পাশাপাশি তিনি মাকে suggest করলেন একটা injection নিতে হবে । দাম ১১০০ টাকা পড়বে। ডাক্তার হওয়ার সুবাদে এই ফাঁক গুলো ধরতে পারি। অন্য কেউ তো বুঝতোই না।
অনেক প্রতিবন্ধকতার ভেতর দিয়ে এই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা সরকার যেটুকু খরচ করে আরো অনেক অনেক ভালো হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু এর প্রতিটা শিরায় শিরায় দুর্নীতি। ডাক্তার থেকে 4th class employee . আর এই কারনেই পুরো অবস্থাটা যে যার মত দোষ দিয়ে খালাস টাইপের না। স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হলে প্রয়োজন অনেক বড় কিছু সংলাপের ব্যাবস্থা আর উদ্যোগ। এই উদ্যোগ টা কোথাও না কোথাও থেকে আসুক। শুধু ডাক্তারদের উপর নিয়মনীতি চাপিয়ে দিলেই এর সমাধান আসবে না। সমাধানের পথ খুজতে হবে সবাইকেই। আন্তরিক ভাবে।