জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি’ ২০১১ ও ফতোয়া প্রসঙ্গে দুটি কথা (১)

Author Topic: জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি’ ২০১১ ও ফতোয়া প্রসঙ্গে দুটি কথা (১)  (Read 1503 times)

Offline najnin

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 134
  • Test
    • View Profile
দুই বছর আগে জাতীয় নারী নীতি’২০১১-র খসড়া নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছিল। বিশেষ করে ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা ফজলুল হক আমিনীর এ নীতি কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী বলে এটাকে স্থগিত করার দাবী নিয়ে হরতাল ডেকে বসেছিলেন। যেহেতু কিছু মানুষ দাবী করছেন যে এই নারীনীতিতে কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী কিছু ধারা আছে, স্বাভাবিকভাবেই আমাদের জানা দরকার আসলেই কি আছে এতে।

প্রথমেই পত্রপত্রিকায় বিভিন্নজনের বক্তব্যে “সিডও” নিয়ে কথা হচ্ছে এবং এটাকেই মূলত কুরআন ও সুন্নাহ্‌র পরিপন্থী বলা হছে এবং সরকারের নারীনীতিও প্রণীত হয়েছে “সিডও”র অনুসরণে, তাই এ নিয়ে দুটো কথা বলি। আবার বর্তমানে হেফাজতে ইসলামও "সিডও"কে নিয়ে সমালোচনা করছেন। তবে উনারা যে বিষয় নিয়ে অভিযোগ করেছেন সেরকম কোন ক্লজ আমি "সিডও"তে খুঁজে পাইনি। এছাড়া কুরআন, সুন্নাহবিরোধী যেকোন কিছুই বাংলাদেশ সংরক্ষণ করেছে।

১ নং রেফারেন্সে সিডও (CEDAW)-র ধারাগুলোর সার সংক্ষেপগুলো দেখা যাবে। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে “The Convention on the Elimination of All forms of Discrimination Against Women (CEDAW)” সনদ গৃহীত হয় এবং ১৯৮১ সালে এটাকে কার্যকর করা হয়। বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে এ সনদ সাক্ষর করে এবং নিয়মঅনুযায়ী চার বছর পরপর এ সংক্রান্ত রিপোর্ট জাতিসংঘে পেশ করে। সারা বিশ্বে মোট ১৮৬টি দেশ এই সনদ সাক্ষর করে, তবে খোদ যুক্তরাষ্ট্রই (মানবাধিকারের কর্ণধার) এটিকে এখনো অনুমোদন দেয়নি। এছাড়া ইরানও অনুমোদন দেয় নাই। দেশে দেশে নারী ও নারীশিশুদের নানারকম নিরাপত্তামূলক ও নায্য অধিকারমূলক আইন প্রণয়নের প্রসঙ্গে সিডও-র মূল ধারাগুলো হচ্ছেঃ

১। আন্তর্জাতিকভাবে সেক্স ট্রাফিক ও স্থানীয় যৌন হয়রানি কমানো
২। শিক্ষা ও ভোকেশনাল ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা
৩। ভোটাধিকার নিশ্চিত করা
৪। জোরপূর্বক বিয়ে ও বাল্যবিবাহ বন্ধকরণ ও সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিতকরণ
৫। মা ও তার শিশুকে পর্যাপ্ত মেটারনিটি সেবা দেয়া
৬। কোনরকম বৈষম্য ছাড়া নারীদের কাজের ও ব্যবসার সুযোগ নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশে প্রথম পর্যায়ে ধারা ২, ১৩ ও ১৬-র কিছু কিছু অংশ সংরক্ষণ করে সনদ সাক্ষর করা হয়। এখনো পর্যন্ত ধারা ২ সংরক্ষিত অবস্থায় আছে কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধী মনে করে(রেফারেন্স ২)। এটা জাতিসংঘের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া তথ্য। তবে নারীনীতি ২০১১ তে বলা আছে ধারা ১৬ (ক)-ও এখনো পর্যন্ত সংরক্ষিত।

এবার দেখি আমাদের নারীনীতি ২০১১ তে কি কি বলা আছে।

বাংলাদেশ সরকারের নারী ও শিশু মন্ত্রনালয়ের ওয়েবসাইটে এর খসড়া কপিটি পাওয়া যাবে(রেফারেন্স ৪)। যেহেতু মূল বিতর্কের বিষয়বস্তু হচ্ছে এ নীতিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার দিয়ে কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তাই যে যে পয়েন্টগুলোতে নারীর সমান অধিকার বা সমান অংশীদারিত্ব বা সমান অংশগ্রহণ এসব শব্দগুলো আছে, সে পয়েন্টগুলো আমি এখানে দিলাম।

১৬.১ বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় ও গণজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
১৬.৫ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মূল ধারায় নারীর পূর্ণ ও সম অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
১৬.৮ নারী পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করা।
১৬.১২ রাজনীতি, প্রশাসন ও অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে, আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ড, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া এবং পারিবারিক জীবনের সর্বত্র নারী পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা।

১৭.১ মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার সকল ক্ষেত্রে, যেমন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ যে সমঅধিকারী, তার স্বীকৃতি স্বরূপ নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ করা।
১৭.২ নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (CEDAW) এর প্রচার ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১৭.৩ নারীর মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদ্যমান আইন সংশোধন ও প্রয়োজনীয় নতুন আইন প্রণয়ন করা।
১৭.৪ বিদ্যমান সকল বৈষম্যমূলক আইন বিলোপ করা এবং আইন প্রণয়ন ও সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশন বা কমিটিতে নারী আইনজ্ঞদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
১৭.৫ স্থানীয় বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন ধর্মের, কোন অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নারী স্বার্থের পরিপন্থী এবং প্রচলিত আইন বিরোধী কোন বক্তব্য প্রদান বা অনুরূপ কাজ বা কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করা।
১৭.৬ বৈষম্যমূলক কোন আইন প্রণয়ন না করা বা বৈষম্যমূলক কোন সামাজিক প্রথার উন্মেষ ঘটতে না দেয়া।

২৩.২ অর্থনৈতিক নীতি (বাণিজ্যনীতি, মুদ্রানীতি, করনীতি প্রভৃতি) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা।
২৩.৫ সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারীত্ব দেয়া।
২৩.৭ নারী-পুরুষ শ্রমিকদের সমান মজুরী, শ্রম বাজারে নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণ ও কর্মস্থলে সমসুযোগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা।

২৫. নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জরুরী বিষয়াদি যথা;
২৫.১ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জীবনব্যাপী শিক্ষা, কারিগরী শিক্ষা, আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ, তথ্য ও প্রযুক্তিতে নারীকে পূর্ণ ও সমান সুযোগ প্রদান করা।
২৫.২ উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা।

৩১.৩ কৃষিতে নারী শ্রমিকের মজুরী বৈষম্য দূরীকরণ এবং সমকাজে সম মজুরী নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা।

৩২.৩ রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে পর্যায়ক্রমে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
৩২.৪ নির্বাচনে অধিকহারে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুপ্রাণিত করা।
৩২.৯ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার উচ্চ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী নিয়োগ করা।

৩৩.১ প্রশাসনিক কাঠামোর উচ্চ পর্যায়ে নারীর জন্য সরকারি চাকরিতে প্রবেশ সহজ করার লক্ষ্যে চুক্তিভিত্তিক এবং পার্শ্ব প্রবেশের (Lateral entry) ব্যবস্থা করা।

৩৪.৯ পরিবার পরিকল্পনা ও সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা।
৩৬.১ প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশের নিরাপত্তায় নারীর অবদান স্বীকার করে পরিবেশ সংরক্ষণের নীতি ও কর্মসূচীতে নারির সমান অংশগ্রহণের সুযোগ ও নারী প্রেক্ষিত প্রতিফলিত করা।
৩৬.৩ কৃষি, মতস্য, গবাদি পশুপালন ও বনায়নে নারীকে উতসাহিত করা ও সমান সুযোগ প্রদান করা।

রেফারেন্সসমূহঃ

১। সিডওঃ http://www.cedaw2010.org/index.php/about-cedaw/summary-of-provisions

২। Reservation of CEDAW: http://www.un.org/womenwatch/daw/cedaw/reservations.htm

৩। সম্পূর্ণ সিডও সনদঃ http://bit.ly/hvmH1m

৪। জাতীয় নারী নীতি ২০১১ঃ http://www.mowca.gov.bd/

(ক্রমশ)