স্মার্টফোনের প্রসারে দ্রুত জনপ্রিয়তা বাড়ছে মোবাইল গেইমের
বিশ্বজুড়ে বিলিয়ন ডলারের এই মোবাইল গেইম বাজারে সফলভাবে কাজ করছে কয়েকটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানও। আরো অনেক প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসায় এগিয়ে আসছে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন আল-আমিন কবির ও তুহিন মাহমুদ
'টিপ ট্যাপ অ্যান্ট' গেইমটি খেলেননি এমন আইফোন ব্যবহারকারী খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। আঙুলে টিপে পিঁপড়া মারার কাহিনী নিয়ে তৈরি গেইমটির গ্রাফিকসের মান এত উন্নত যে একে সিলিকন ভ্যালির তৈরি গেইম বলেই মনে হয়। মজার খবর হচ্ছে, গেইমটি তৈরি করেছে দেশি প্রতিষ্ঠান 'রাইজ আপ ল্যাবস'। বিশ্বের অনেক দেশেই এ গেইম জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছে। রাইজ আপ ল্যাবসের মতো বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন জনপ্রিয় গেইম তৈরি করছে। অনেক গেইমের বিক্রি ছাড়িয়ে গেছে প্রত্যাশাও।
যেভাবে বাংলাদেশে শুরু২০০৫ সালের দিকে দেশে গেইম তৈরির কাজ শুরু হয়। সে বছর যাত্রা শুরু করে আইটিআইডাব্লিউ। তবে এ প্রতিষ্ঠানকে সফলতা পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে বেশ কিছুদিন। শুরুর দুর্দিন কাটিয়ে এই প্রতিষ্ঠানে এখন অর্ধশতাধিক নির্মাতা কাজ করছেন। আইফোন অ্যাপলিকেশন, গ্রাফিক ডিজাইন এবং ওয়েবসাইট উন্নয়নের কাজও হচ্ছে এখানে। এসব কাজের ৮০ শতাংশেরও বেশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া বলে জানা গেছে। গেইম তৈরির আরেক 'শাপলা অনলাইন' যাত্রা শুরু করে ২০০৯ সালে। মোবাইল গেইমের পাশাপাশি ব্রাউজার ও ওয়েবভিত্তিক গেইমও তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটি। 'রাইভালটি', 'ব্যান্ডটাইকুন' ও 'কমান্ডস্টার' তাদের তৈরি আলোচিত গেইম। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত আরগু ভেনচারও গেইম তৈরি করে খ্যাতি পেয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের তৈরি 'পপ টু স্পেল কিডস'-এর জনপ্রিয়তা কম নয়। ব্রাউজারভিত্তিক গেইম (মোবাইল, কম্পিউটার ও ফেইসবুকের মাধ্যমে খেলা সম্ভব) তৈরি করে এগিয়ে যাচ্ছে 'ফান রক মিডিয়া'। তাদের তৈরি গেইমের মধ্যে রয়েছে 'কমান্ডস্টার', 'রাইভালটি' ও 'ব্যান্ডটাইকুন'। এ ছাড়া নর্থ বেঙ্গল আইটি, রেলিসোর্স টেকনোলজিস, সালেহা আইটি, অ্যালবাট্রস টেকনোলজিসসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান দেশেই আন্তর্জাতিক মানের গেইম তৈরি করছে। তবে ২০০৯ সালের অক্টোবরে শুরু রাইজ আপ ল্যাবসের তৈরি গেইম 'টিপ ট্যাপ অ্যান্ট'-এর সফলতা ছাড়িয়ে গেছে সবাইকে।
টিপ ট্যাপ অ্যান্ট : একটি সাফল্যের গল্প'টিপ ট্যাপ অ্যান্ট' গেইমের সাফল্য নিয়ে রাইজ আপ ল্যাবসের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এরশাদুল হকের সঙ্গে কথা হয় কালের কণ্ঠের। তিনি বলেন, "একে একে বিভিন্ন প্রাণী আসতে থাকবে এবং আঙুল দিয়ে টিপে সেগুলো মারতে হবে- শুরুতে এমন কাহিনী নিয়ে 'টিপ ট্যাপ অ্যান্ট' তৈরির পরিকল্পনা থাকলেও পরে শুধু পিঁপড়া নিয়ে গেইমটি তৈরি হয়। প্রথমে চারুকলার বন্ধুদের নিয়ে পিঁপড়ার নকশা করা হয়। এরপর কম্পিউটারে প্রোগ্রামিংয়ে একে গেইমের রূপ দেওয়া হয়। অনেক বিনিদ্র রাতের ফসল গেইমটি অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন ভেলকি লেগে গেল! শুরু থেকেই প্রচুর ডাউনলোড। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই রেটিংয়ে দশের ঘরে চলে আসে। বেশি ডাউনলোড হয় ইউরোপের দেশগুলো থেকে। এশিয়ার মধ্যে প্রথম জনপ্রিয়তা পায় সিঙ্গাপুরে। পরে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়ও তালিকায় দুই নম্বরে উঠে আসে। এই এক গেইম থেকেই রাইজ আপ ল্যাবসের আয় হয় ৭০ হাজার মার্কিন ডলার। বাবার কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে শুরু করেছিলেন। ছোট্ট এক কামরা থেকে রাইজ আপ ল্যাবসের এখন উত্তরায় ১৬ হাজার বর্গফুটের অফিস। এখানে কাজ করেন ৬০ জন ডেভেলপার। তাঁদের তৈরি অ্যাপলিকেশনের সংখ্যাও এখন শতাধিক। এগুলোর মধ্যে 'ট্যাপ ট্যাপ ট্যাপ মার্বেল', 'লাভার ফ্রগ', 'ঘোস্ট সুইপারফল রেইনি', 'আইওয়্যারহাউস', 'গ্লুবার', 'শুট দ্য মানকি', 'ফ্রুইটিটো' ও 'বাবল অ্যাটাক'ও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
দেশে তৈরি আরো গেইমদেশি আরেক প্রতিষ্ঠান মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশনের পরিচালনা প্রধান সাঈদুল ইসলাম জানান, অনলাইন মার্কেটপ্লেসের পাশাপাশি তাঁরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্যও গেইম তৈরি করেন। যেমন- চ্যাম্পস২১-এর জন্য তাঁরা 'লিটল তন্ময়', 'ম্যাডমেটিক্স' ও 'মানকি জাম্প' তৈরি করেছেন। নকিয়ার অভি স্টোরের 'টিক ট্যাক টয়' ও 'গো গো টাইগার'ও তাঁদের তৈরি। শুরুর দিকের প্রতিষ্ঠান আইটিআইডাব্লিউয়ের তৈরি আলোচিত গেইমগুলোর মধ্যে রয়েছে 'ডুডল ডিনো ফার্ম', 'ডুডল ফিশ ফার্ম', 'গ্লো ডুডল ফল', 'গ্লো ফিশি', 'গ্লো জাম্প', 'ডুডল মনস্টার ফার্ম', 'মনস্টার জাম্প' ও 'ক্রিসমাস ফার্ম'। আরেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান জেনুইটি সিস্টেম থেকে এ পর্যন্ত ৩৭০টি ওয়েব অ্যাপলিকেশন তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে অনেক গেইমও আছে। 'ড্রিফট ম্যানিয়া', 'হকি ফাইট', 'মাইক ভি'র মতো জনপ্রিয় গেইমগুলোও বাংলাদেশে তৈরি। মোবাইল অ্যাপলিকেশন থেকে বছরে আয় হওয়া প্রায় ২৩ কোটি মার্কিন ডলারের বেশির ভাগই এসব গেইম বিক্রি থেকে আসা।
ট্যাপিং গেমে শীর্ষে ট্যাপ টু আনলক থ্রিবাংলাদেশের রিয়েল গেম ইন ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড হাব লিমিটেডের (আরটিসি) তৈরি 'ট্যাপ টু আনলক থ্রিডি' গেইমটি এখন ট্যাপিং গেইমের তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে (সূত্র: itunes.apple.com/us/app/tap-to-unlock-3d/id630398076?mt=8)। গত ১৪ এপ্রিল অ্যাপ স্টোর ও আইটিউনে আসা গেইমটি ইতিমধ্যেই ইউজার রেটিংয়ে ৪ পেয়েছে। ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করা আরটিসির তৈরি গেইমের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে 'মানকি অ্যান্ড বানানা', 'শেক-ব্রেক-মেক প্রো' এবং 'হাংরি ফ্রগি'। এ ছাড়া আইফোন ও অ্যানড্র্রয়েডের জন্য বিভিন্ন গেইমস ও অ্যাপলিকেশন তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটি।
রয়েছে ফ্রিল্যান্স গেইম নির্মাতাওঅল্প সময়ের মধ্যেই মোবাইল অ্যাপলিকেশন তৈরির কাজ বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এ কাজে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় না বলে ফ্রিল্যান্সিংও এতে যুক্ত হচ্ছে। মার্কেটপ্লেস ওডেস্কের বাংলাদেশ অ্যাম্বাসাডর এবং মোবাইল অ্যাপলিকেশন ও গেইম ডেভেলপার মাহমুদ হাসান সানি বলেন, সাধারণ ফ্রিল্যান্সিং কাজের তুলনায় গেইম ডেভেলপমেন্টে অনেক বেশি আয় করা যায়। অনেকেই ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গেইম ডেভেলপ করে সাফল্য পেয়েছেন।
দরকার বাড়তি নজরসফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস বা বেসিস সূত্রে জানা গেছে, শুধু মোবাইল গেইমিং নিয়ে কাজ করছে বেসিসের তালিকাভুক্ত ১৩টি প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা মোবাইল গেইম, অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে কাজ করছে। দেশের মেধাবী ও দক্ষ জনবল কাজে লাগিয়ে বিশ্বের নামিদামি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করছেন এসব উদ্যোক্তা। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার বা নীতিনির্ধারকদের কোনো নজর নেই বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। দক্ষ জনবল তৈরি করতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গেইমিংসংশ্লিষ্ট বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি বলেও মত দেন অনেকে। ওডেস্ক কান্ট্রি অ্যাম্বাসাডর মাহমুদ হাসান সানি বলেন, প্রাথমিকভাবে গেইম তৈরি করে বাজারে ছাড়ার জন্য সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কিট (এসডিকে) কিনতে নূ্যনতম এক হাজার ৫০০ ডলার থেকে শুরু করে প্রায় পাঁচ হাজার ডলারের প্রয়োজন হয়। একজন ফ্রিল্যান্সার বা নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্য এটি অনেক ব্যয়বহুল। তাই ইচ্ছা ও কাজ জানলেও অনেকে গেইম ডেভেলপমেন্টে এগিয়ে যেতে পারছেন না। বাইরের দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মোবাইল গেইম ডেভেলপমেন্টের চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা প্রশিক্ষণ রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি বা বেসরকারিভাবে এ ধরনের কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান যদি এ ধরনের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয় তাহলে বাংলাদেশে গেইম ডেভেলপমেন্ট সেক্টরটি অনেকাংশে এগিয়ে যাবে।
Source:
http://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&type=gold&data=news&pub_no=1243&cat_id=3&menu_id=217&news_type_id=1&index=0#.UZMyqkqdDcc