গৃহকর্মে নিয়োজিতদের প্রতি সদয় হোন

Author Topic: গৃহকর্মে নিয়োজিতদের প্রতি সদয় হোন  (Read 1296 times)

Offline shilpi1

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 135
    • View Profile
বাংলাদেশে গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের নির্যাতনের বিষয়টি ক্রমে সামাজিক সমস্যা হিসেবে আভির্ভূত হচ্ছে। আমাদের দেশে শিশুদেরকে সাধারণত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। ফলে শিশুর প্রতি নির্যাতনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্যও করা হয় না।

গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের উপর নির্যাতনের চিত্র জানার সুযোগ খুব কমই হয়। কেননা বিষয়গুলো নির্দিষ্ট পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং নির্যাতিত শিশুরাও তাদের নির্যাতনের কথা বাইরে প্রকাশ করতে চায় না।

এটা কেবল তখনই প্রকাশ পায় যখন অতিমাত্রার নির্যাতনের কারণে শিশুদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয় কিংবা যখন তারা কোনো  গণমাধ্যম বা আইনশৃংখলা রক্ষা বাহিনীর শরণাপন্ন হয়।

গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত শিশু শ্রমিকদের অবস্থা বাংলাদেশের সামগ্রিক শিশু নির্যাতনের পরিস্থিতির চাইতে ভয়াবহ। ২০০৩ সালের শিশু শ্রমিকদের উপর বেইসলাইন সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে গৃহকর্মে নিয়োজিত ৬-১৭ বছরের শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা মোট ৪ লক্ষ।

যার মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে রয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৩২ হাজার জন শিশু।

এই পরিসংখ্যান থেকে সহজে প্রতীয়মান হয়, এককভাবে দেশের সবচাইতে বৃহৎ ঝুকিপূর্ণ শ্রম সেক্টর হচ্ছে গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুশ্রম, যার ৭৮ ভাগই হচ্ছে কন্যাশিশু।

এদের মধ্যে ৯৪ ভাগ শিশুই সার্বক্ষণিক অর্থাৎ ২৪ ঘন্টা আর ৬ ভাগ শিশু খন্ডকালীনভাবে কাজ করে থাকে। কর্মজীবী এই শিশুরা সবসময় সস্তা, অদৃশ্য এবং দেশের সাধারণ ঘটনা প্রবাহে এরা সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে অবস্থান করে।

দারিদ্রতা এবং গৃহকর্মে শিশুশ্রম এই দেশে দীর্ঘদিন থেকে সমান্তরালে চলে আসছে। ফলে বেশির ভাগ মানুষই এটাকে কখনও কোন সমস্যা হিসাবে গণ্য করেনি এবং এখনও করেনা। বরং সবাই এটাকে একটি অবধারিত চিত্র হিসাবেই ধরে নিয়েছে।

গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুশ্রম, এক প্রকার অদৃশ্য শ্রমক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত। যেখানে বাধ্যতামূলক নিযোগ পদ্ধতির মাধ্যমে শ্রমের অপব্যবহার, দীর্ঘ শ্রম ঘন্টায় শিশুকে নিয়োজিত রাখা হয়। মৌখিক দূর্ব্যবহার, অনৈতিক কার্যকলাপ এবং যৌন নিপীড়ন ইত্যাদি মানসিক চাপ, যা শিশুদের প্রতিনিয়ত সহ্য করতে হয়।

অধিকাংশ শিশুরাই কন্যাশিশু, যারা চাকুরিদাতার সঙ্গে একই স্থানে অবস্থান ও কাজ করে। শিক্ষার সুযোগ তাদের নেই বললেই চলে। তাদেরকে চাকুরিদাতার বাড়ির মধ্যেই আবদ্ধ থাকতে হয় এবং নিজের সঙ্গী, বন্ধু-বান্ধব বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ করার সুযোগ হয় না বললেই চলে।

প্রায়ই পত্রিকায় দেখা যায় গৃহকর্মে শিশু নির্যাতনের ভয়াহ, লোমহর্ষক ও বীভৎস চিত্র। শহর এলাকায় গৃহকর্মে নিয়োজিত কন্যাশিশুরা সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে চারজন কন্যাশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। যেহেতু গৃহকর্মে নিয়োজিত বেশিরভাগ শিশুই মেয়ে শিশু এবং কিশোরী সেহেতু অবহেলা, অপব্যবহার ও যৌন নিপীড়ন থেকে নিজেদের রক্ষা করা তাদের জন্য বেশ কঠিন। খুব কম সংখ্যক শিশুর দূরবস্থতার কথা গণমাধ্যম কিংবা আইন রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট পৌছায়।

ফলে তাদের প্রকৃত সংখ্যা ও অবস্থা নিরূপণ করা কঠিন। তাই গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের নিয়োগকর্তাদের জন্য একটি আচরণবিধি থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে।

গ্রহকর্মে নিয়োজিত কিছু শিশুর সঙ্গে আমার কথা হয়, এরকম একজনের অভিব্যক্তি ছিল- আমরা মালিকের শিশুর স্কুল ব্যাগ, পানির পট ইত্যাদি বহন করে স্কুলে যাওয়ার পথে রাস্তা পার হই, তাতে আমাদের কেউ সহায়তা করেন না কিন্তু অনেক শিশুকে অভিভাবকগণ যতœ করে রাস্তা পার করে নিয়ে যান। এক্ষেত্রে একটু সমস্যা হলে আমাদের মারধর ও বকাঝকা করেন।’

আরেকজন শিশু কান্নায় জর্জরিত হয়ে বলেন, মালিকের বাসায় খাবার তৈরীতে আমরা পুরোপুরিভাবেই যুক্ত থাকি কিন্তু যখন খাবার দেয়া হয় তখন সবাই একসঙ্গে খেয়ে নেয় কিন্তু আমাদের দেয়া হয় সবার শেষে, যেখানে আমাদের জন্য আর তেমন কিছুই থাকে না।

গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের নিজের সন্তানের মত ভাবতে না পারলে এই সমস্যার সমাধান কখনো করা যাবে না। গণমাধ্যমে গৃহকর্মে শিশুদের নিয়োগ ও তাদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারিভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে চাইল্ড লাইন নামক টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে গৃহকর্মে নিয়োজিতদের নিপীড়নমূলক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে সহায়তা করে। শ্রীলংকায় ‘একটি কর্মে নিযুক্ত শিশু একটি বিধ্বস্ত ভবিষ্যত’ ধারণার ওপর ভিত্তি করে সচেনতামূলক কর্মসূচি রয়েছে, যা বিভিন্ন তামিল, সিংহলী ভাষায় গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার করা হয়। বাংলাদেশেও এ ধরণের কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।

গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত বিষয়ক অভিযোগ আসামাত্রই যাতে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী গুরুত্ব প্রদান করে এবং তড়িৎ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। শিশুদের আত্ম-মর্যাদা, গ্রহণযোগ্য কর্ম-পরিবেশ, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন, বিনোদন, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা, সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশা, নিপীড়ন, অবহেলা ও শোষণের হাত থেকে সুরক্ষা পাবার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি।