যেমন বৈধভাবে সব ধরনের উৎপাদনকে সীমাহীন ও বিরামহীন রাখতে অদম্য প্রেরণা ও উৎসাহ দান করে, ঠিক তেমনি কঠোরভাবে যাবতীয় অপচয় আর অযথা খরচ বন্ধ করে সাম্য, ইনসাফ, আদালত প্রতিষ্ঠা করার পক্ষপাতীও। আল কোরআনে তাই অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই হিসেবে চিহ্নিত ও নিন্দিত করা হয়েছে। যে দেশে মানুষ হোটেল-রেস্তোরাঁর নিক্ষিপ্ত নোংরা খাবার খেয়ে বেঁচে-বর্তে আছে কোনো রকমে, সে দেশে অপচয় বন্ধ করা প্রথম কর্তব্য। অপচয় অনেকভাবেই হয়। আবার যাঁরা অপচয় করেন তাঁরা কিন্তু নিজে উৎপাদন করেন না। ওপরওয়ালার কৃপায় (?) তাঁরা বড়লোক। চলনে-বলনে, খাওয়াদাওয়ায় তাঁরা ১০ জনের চেয়েও বেশি অপব্যয় করে থাকেন।
ইসলাম চায় মানুষের চিন্তা-চেতনা চলমান কাজের দুনিয়ায় বাস্তবের মাটিতে প্রোথিত হোক। ইসলাম নিরেট বিশ্বাসনির্ভর কোনো মতবাদ নয়; বরং এ মর্মে বিশ্বাসকে মেনে আরব্ধ কাজের এক আপসহীন ফিরিস্তি পেশ করার নির্দেশ দেয়। মহান খলিফা হজরত ওমর তাঁরই এক রাজ্য অধিকর্তাকে মাথায় লাঠি তুলে দিলেন প্রহার করার জন্য। এ শাস্তি এ জন্য যে খাবার টেবিলে একটি সবজির স্থলে ওই গভর্নর দুটো সবজির নির্দেশ জারি করেছিলেন। পরে গভর্নর জানালেন, একটি তরকারিই তিনি নেবেন আর অপরটি হাফিসের নির্দেশিত এক দাওয়াই হবে।
সাম্যের একচ্ছত্র অধিনায়ক দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর বলতেন, আমি আটা না চেলে খাই অর্থাৎ ভুসিসহ খাই। তিনি আরো বলতেন, আমি চর্বি খাই না, যেদিন আমার দেশের সব নাগরিক চর্বিসহ খেতে পারবে, সেদিন তা আমিও খাব। তিনি (ওমর) দরজায় ও ঘরের মেঝেতে অতিমূল্যবান কাপড় শয্যায় প্রসারিত করাকে অপচয় ভাবতেন, এটি করতে নিষেধ করতেন এবং নিজেও তা করতেন না। সবচেয়ে বেশি অপব্যয়, অপচয় ও অযথা খরচ হয়ে থাকে বিবাহ অনুষ্ঠানগুলোতে। ইসলামে অপচয়সংক্রান্ত এত বেশি নিষেধ থাকার পর মুসলমানদের সামান্যতম অপচয় করার মানসিকতা তথা অভ্যাসে অভ্যস্ত থাকার কথা
যে সমাজে ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, যে সমাজে আজও অনেক দম্পতি মশারিবিহীন মশার কামড়ে রাত যাপন করে, অনেক লোক পাঁচ টাকার ওষুধ কিনে খেতেও দিশেহারা, যে সমাজে ৫০ শতাংশ কিশোর স্কুল ছেড়ে দৈনিক মাত্র ৫০ টাকার জন্য রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করছে, সে সমাজে শখ করে এমন অপচয় রীতিমতো লজ্জার ব্যাপার। সাম্য-সমতার নবী তাই শিক্ষা দিয়েছিলেন- 'অপ্রয়োজনে তুমি যে খাদ্য নষ্ট করবে, খাদ্যের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে তোমাকে অবশ্যই এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে।' এমনকি পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত পানিও না। সাম্যের বার্তাবাহক হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজ মসজিদখানা পর্যন্ত পাকা ও সুরম্য করেননি। কারণ তখন সমাজে যথেষ্টভাবে অভাব বিদ্যমান ছিল। যে মসজিদ সব সমাজকে এমনকি রাষ্ট্রকে পর্যন্ত পরিচালনা করত, সে মসজিদ তখন তৈরি হতো খেজুর পাতার ছাউনি দিয়ে। মহানবী বললেন, 'জমিকে অনাবাদি বা পতিত হিসেবে ফেলে রেখো না, যদি তুমি তাতে ফসল না ফলাও, তবে তোমার কৃষক ভাইকে দিয়ে দাও।' এভাবে মহানবী একদিকে উৎপাদন আর অন্যদিকে অপচয় রোধ করেন। যার প্রয়োজন তাকে দিতে চেয়েছেন এবং
হজরত আবু বকর (রা.) জানালেন, আমার মৃত্যুর পর আমার ব্যবহৃত কাপড় দিয়েই আমাকে কবরস্থ করবে, কারণ নতুন কাপড়ের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে নবাগতদের। এ ছিল ইসলামের তথা ইসলামের অমর বীর সেনানীদের কাঙ্ক্ষিত বিচিন্তিত প্রতিষ্ঠিত সাম্য। রাসুলুল্লাহ প্রায়ই প্রাণাধিক প্রিয় স্ত্রী আয়েশাকে বলতেন রান্নায় বেশি পরিমাণ পানি ঢেলে দিতে, যাতে কম সামগ্রীতে বেশি লোকের খাওয়া হয়।
মাওলানা শফিকুল ইসলাম