মাদারীপুর অর্পিত সম্পত্তি দপ্তরের তহশিলদার কপিলকৃষ্ণ গোলদার মাদারীপুর প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফরিদা বেগমসহ ছয়জনকে আসামি করে একটি সিআর মামলা দায়ের করেন (সিআর মামলা নম্বর ৫০৯/২০০০)। তহশিলদার কপিলকৃষ্ণ গোলদার আসামিদের বিরুদ্ধে এই মর্মে অভিযোগ করেন যে তর্কিত সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হওয়া সত্ত্বেও ওই সম্পত্তি গ্রাস করার লক্ষ্যে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে তাঁদের পক্ষে জমিটি ক্রয়ের একটি জাল দলিল তৈরি করেছেন, যা দণ্ডবিধির ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১ ধারায় দণ্ডযোগ্য অপরাধ।
বিজ্ঞ প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আসামি ফরিদা বেগমের স্বামীসহ (২ নম্বর আসামি আ· মজিদ মিয়া) ছয়জন আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আমলে নেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দায়ের করেন। ১ নম্বর আসামি (ফরিদা বেগম) এবং ৩ নম্বর আসামি ও অন্যরা স্বেচ্ছায় বিজ্ঞ আদালতে হাজির হলে তাঁদের হাজতে প্রেরণ করা হয়। এর পরপরই আসামি ফরিদা বেগমের স্বামী আ· মজিদ মিয়া (২ নম্বর আসামি) মারা যান। মানবিক কারণে ফরিদা জামিন পান।
এরপর বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন উপরিউক্ত সিআর মামলার (নম্বর ৫০৯/২০০০) সামগ্রিক কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ করে আসামিরা হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিভিশনাল পিটিশন দায়ের করেন। তাঁদের যুক্তি, তাঁরা আইনগতভাবেই তর্কিত সম্পত্তি আইনানুগ মালিকের কাছ থেকে অর্জন করেছেন। এমনকি দেওয়ানি আদালত থেকে তাঁদের মালিকানা প্রাপ্তির ডিক্রিও অর্জন করেছেন। এ-সংক্রান্ত দলিলপত্রও তাঁরা পিটিশনের সঙ্গে সংযুক্ত করেন। (৫৯ ডিএলআর, ৩২৮)
হাইকোর্ট বিভাগের রায়ঃ সরকারি কর্মচারী কপিলকৃষ্ণ গোলদার দণ্ডবিধির ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধের অভিযোগে ফরিদা বেগমসহ অন্যদের বিরুদ্ধে যে সিআর মামলাটি (মামলা নম্বর ৫০৯/২০০০) দায়ের করেছিলেন, তা আইন অনুযায়ী চলতে পারে না। কিন্তু এ রকম একটি ভ্রান্ত মামলার কারণে ওই মামলার আসামি ফরিদা বেগমের জীবনে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছিল। ফরিদা বেগম হাজতে থাকাকালে তাঁর স্বামী ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন। একজন সরকারি কর্মচারী, যাঁর মূল দায়িত্ব যথোপযুক্ত আইনানুগ প্রক্রিয়ায় অর্পিত সম্পত্তি রক্ষা করা, খেয়ালের বশে ফৌজদারি মামলা দায়ের করে কোনো নাগরিকের অপূরণীয় ক্ষতি করা তাঁর দায়িত্ব নয়। এরূপ অবহেলা ও ঔদাসীন্য দণ্ডবিধির ২১১ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ওই অভিযোগে কপিলকৃষ্ণ গোলদারের বিরুদ্ধে ফরিদাসহ অন্য ভুক্তভোগীরা মামলা করতে পারেন। তাঁরা আলাদাভাবে ক্ষতিপূরণের জন্যও মামলা দায়ের করতে পারেন।
আমার ব্যক্তিগত অনুমান, আমাদের দেশে দায়ের করা ফৌজদারি মামলাসমূহের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ মামলা উল্লিখিত (৫৯ ডিএলআর, ৩২৮) মামলাটির মতো। আমাদের দেশের গরিব মানুষদের হয়রানি করার জন্য মিথ্যা অভিযোগে দায়ের করা হয়ে থাকে। সবার পক্ষে ফরিদা বেগমের মতো উচ্চ আদালতে যাওয়া সম্ভব হয় না। নানা প্রতিকূলতার কারণে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২১১ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধের অভিযোগ এনে পাল্টা মামলা করাও সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় কেবল সংশ্লিষ্ট আদালতই পারে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা অভিযোগ আনয়নকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।
ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশঃ মিথ্যা নালিশ আনয়নকারী সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ করা যায়। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা আমলযোগ্য নয়, এ রকম কোনো মামলায় মিথ্যা প্রতিবেদন দিলে তাঁর বিরুদ্ধেও এ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ প্রদান করা যায়।
রিভিশনঃ দায়রা জজ আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৩৫-এর ৪৩৯(এ) ধারা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ রিভিশন করতে পারেন।
আপিলঃ ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০(৩) ধারা অনুযায়ী, দায়রা জজ আদালতে আপিল করা যায়।
আমাদের দেশের বিজ্ঞ আদালতসমূহ যদি সতর্কতার সঙ্গে নিয়মিতভাবে মিথ্যা মামলাসমূহের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা অভিযোগ আনয়নকারী পক্ষকে কারাদণ্ড ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ প্রদান করেন, তাহলে প্রথম দিকে আদালতে কাজের পরিধি বাড়লেও একটা পর্যায়ে মিথ্যা মামলা দায়েরের সংখ্যা দ্রুতগতিতে হ্রাস পাবে। ফলে একদিকে যেমন স্তূপীকৃত মামলার সংখ্যা হ্রাস পাবে, অন্যদিকে মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ অন্তত তাদের আর্থিক ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারবে।
অমিত কুমার দে
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বরগুনা
তথ্যসূত্র : prothom-alo.