সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরঃ বিষাদ, বঞ্চনা আর বিদ্রোহের কবি

Author Topic: সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরঃ বিষাদ, বঞ্চনা আর বিদ্রোহের কবি  (Read 2819 times)

Offline Saeed Ahsan Khalid

  • Newbie
  • *
  • Posts: 14
  • Test
    • View Profile

সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফর বা ২য় বাহাদুর শাহ্ (অক্টোবর ২৪, ১৭৭৫ - নভেম্বর ৭, ১৮৬২) মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট। সোয়া তিন শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী, দিল্লীর মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বশেষ প্রতিনিধি, মরমী কবি ও সুফী সাধক সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফরের জীবন ইতিহাসের বড় ট্র্যাজেডি হয়ে আছে। তার রচিত কবিতা ও গজল এই ভাগ্যবিডম্বিত সম্রাটের নির্বাসিত জীবনের একাকীত্ব, বিষাদ আর অসহায়ত্তের অনবদ্য সাক্ষ্য বহন করছে। যে কয়েকজন প্রবাদপুরুষ অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে দেশপ্রেম ও চরম আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছিলেন, এই বাংলার মাটিতে স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ বপন করেছিলেন তন্মধ্যে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন সম্রাট বাবর, আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের উত্তরসূরী শেষ মুঘল সম্রাট, মুঘল সাম্রাজ্যের মহাদুর্দিনে তিনি ভারতবর্ষের ক্ষমতা গ্রহণ করেন।

সম্রাট হলেও তিনি ছিলেন নামমাত্র সম্রাট। বাহাদুর শাহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পেনশনভোগী ছিলেন। তিনি বার্ষিক ১ লাখ টাকা ভাতা পেতেন। ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও সম্পদ সব কিছু হারিয়ে সম্রাট প্রাসাদের চার দেয়ালের অভ্যন্তরে জীবন কাটাতে বাধ্য হলেন। এ সময় অমর্যাদার মনোবেদনা ভুলে থাকার জন্য তিনি গজল ও মুশায়েরায় নিমগ্ন থাকতেন ; লালকেল্লায় সাহিত্যের আসর বসিয়ে সময় কাটাতেন। তিনি নিজেও কবিতা লিখতেন। জীবনের কষ্ট ও বিষাদ তাঁর কবিতার মূল বিষয়। তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে দু:খ ও বিষাদের সাথে দেশ ও জাতির পরাধীনতার কথা বিধৃত। একটি কবিতায় আছেঃ

“Umer e daraz mang ka lae the char din,
Do arzo me kat gae; do intezar me.”

যার অর্থ:

"চার দিনের জন্য আয়ু নিয়ে এসেছিলাম। দু’দিন কাটল প্রত্যাশায় আর দু’দিন অপেক্ষায়।"

বাহাদুর শাহ সিংহাসনে আরোহণের ২০ বছর পর সূত্রপাত হয় ঐতিহাসিক সিপাহি বিদ্রোহের। পলাশী যুদ্ধের পর ১০০ বছর কেটে গেছে তত দিনে। ১১ মে সিপাহিরা দিল্লি অধিকার করে বহু ইংরেজকে হত্যা ও বিতাড়ন করেন। দেশপ্রেমিক সিপাহিরা এ দিন লালকেল্লায় প্রবেশ করে নামেমাত্র মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতের স্বাধীন সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। সিপাহিরা সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ নেন। এ দিন গভীর রাতে লালকেল্লায় একুশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে ৮২ বছরের বৃদ্ধ সম্রাটকে দেওয়ান-ই খানোস এ সম্মান জানানো হয়। বাহাদুর শাহ জাফর সিপাহিদের বিপ্লব তথা ভারতবর্ষের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন¬ এ সংবাদে একের পর সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ হতে থাকে। ইংরেজরা অতি নির্মমভাবে বিদ্রোহ দমন করে। এক ঘণ্টার এ যুদ্ধে ৪১ জন দেশীয় সিপাহি নিহত হন। আর বন্দি হন বেশ কয়েকজন। রাজপুত্রদ্বয়ের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বৃদ্ধ, নির্যাতিত সম্রাটের নিকট পাঠিয়ে দেয়া হলো। পুত্র যুগল ও অন্যান্য প্রিয়জনের করুণ ও নির্মম পরিণতি প্রত্যক্ষ করে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। বন্দি দেশি সিপাহিদের আন্টাঘরের ময়দানে (বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্কে) সবার সামনে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়া হয়। দেশি প্রজারা যাতে ভয় পায় সে জন্য ফাঁসির ব্যবস্থা করা হয়েছিল জনসমক্ষে। তবে সেদিন অকুতভয় এ বীরসেনানিরা স্বেচ্ছায় তুলে নিয়েছিলেন ফাঁসির রজ্জু। সিপাহি বিপস্নবের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহের স্মৃতিতে ভিক্টোরিয়া পার্ক নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক, মুক্তিকামী মানুষের শৌর্য-বির্যের প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশের পুরনো ঢাকায় এখনো সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে বাহাদুর শাহ পার্ক।

সম্রাটকে বিচারের নামে প্রহসনের আদালতে দাঁড় করানো হয়। হাজির করা হয় বানোয়াট সাক্ষী। বিচারকরা রায় দেন, দিল্লির সাবেক সম্রাট ১০ মে থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠনের দায়ে অপরাধী। তার শাস্তি চরম অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। কিন্তু তার বার্ধক্যের কথা বিবেচনা করে প্রাণ দণ্ডাদেশ না দিয়ে তাঁকে বার্মার (বর্তমান মায়ানমার) রেঙ্গুনে (বর্তমান ইয়াঙ্গুন) নির্বাসনে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়। ১৮৫৮ সালের ৯ ডিসেম্বর সম্রাট ও তার পরিবারকে বহনকারী জাহাজ রেঙ্গুনে পৌঁছে। ব্রিটিশ বাহিনীর ক্যাপ্টেন নেলসন ডেভিসের বাসভবনের ছোট গ্যারেজে সম্রাট ও তার পরিবার-পরিজনের বন্দিজীবন শুরু হয়। সম্রাটকে শুতে দেয়া হয় একটা পাটের দড়ির খাটিয়ায়। ভারতের প্রিয় মাতৃভূমি থেকে বহু দূরে রেঙ্গুনের মাটিতে সম্রাটের জীবনের বাকি দিনগুলো চরম দু:খ ও অভাব অনটনের মধ্যে কেটেছিল। ইংরেজ সরকার নির্বাসিত সম্রাট ও তার পরিবারের ১৬ জন সদস্যের জন্য খোরাকি বাবদ দৈনিক এগার টাকা এবং প্রতি রোববারে বার টাকা করে দিতেন। আর মাসের পহেলা দিনে সাবান, তোয়ালে কেনার জন্য মাথাপিছু দু'টাকা করে দিতেন। কোনো লোককে তাদের সাথে দেখা করতে দেয়া হতো না। চাকর-বাকররা পাস নিয়ে তাদের কাছে যেতে পারতো। কারাগারের অভ্যন্তরে এক বদ্ধ প্রকোষ্ঠে, শতরকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মধ্যেই তিনি রচনা করেছিলেন অসংখ্য সুবিখ্যাত পংক্তিমালা, গজল, শায়েরি। সম্রাটের ইচ্ছা ছিল স্বদেশের মাটিতে সমাহিত হওয়া। জন্মভূমির প্রতি ছিল প্রচণ্ড অনুরাগ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জীবনের শেষ সময় ঘনিয়ে আসছে। স্বদেশের মাটিতে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ কিংবা সমাহিত হওয়ার সাধ কোনোটাই পূরণ হবে না। নিদারুণ দু:খে তিনি লিখেছেন একের পর এক কালোত্তীর্ণ কবিতা। এই মর্যাদাহীন ‘সম্রাট’ উপাধি কে উপহাস করে বিষাদ কণ্ঠে তিনি বলছেনঃ

“ya mujhe afsar-e-shahana banaya hota,
ya mera taj gadayana banaya hota”


ইংরেজি অনুবাদে অর্থ হলঃ

“You should have made me the chief of the kings or
Instead you should have given me a crown that a beggar may wear.”


নিম্নোক্ত কবিতাটি সম্রাটের কবরের এপিটাফে খোদিত আছে যেটিতে সম্রাটের ভাগ্যবিডম্বিত অন্তরাত্মার করুণ চিত্র ফুটে উঠেঃ

“kitnaa hai bad-nasiib “Zafar”
dafan ke liye do Ghaz zamiin bhii na milii kuu-e-yaar me”

অর্থঃ

“এতই হতভাগা জাফর, যে তার দাফনের প্রয়োজনে,
স্বজনের দেশে দু’গজ মাটি- তাও মিললনা।"

সম্রাট অন্য এক কবিতায় খেদোক্তি করে নিজের জীবনের অসারতার কথা বর্ণনা করছেনঃ

“Na kisi ki aankh ka noor hoon,
Na kisi ke dil ka quaraar hoon
Jo kisi ke kaam na aa sake,
Main voh ek musht-e-ghobaar hoon
Mera rang roop bigad gaya,
Mera yaar mujhse bichhad gaya
Jo chaman fizaa mein ujad gaya,
Main ussi ki fasle bahaar hoon”

যেটির ইংরেজি অনুবাদ করলে দাড়ায়ঃ
“I am no one's light of the eye,
Neither am I any heart's solace
One that can never be useful to anyone,
I am that handful of dust
My appearance has been ruined,
My lover has been lost
I am the crop of the spring,
Of the garden that wilted in its bloom”


অভাব, অনটন, উপেক্ষা আর অবহেলায় বিডম্বিত সম্রাট পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলেন। এমন বিড়ম্বনাপূর্ণ জীবনের অবসান হয় ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ নভেম্বর, শুক্রবার ভোর ৫টায়। সম্রাটকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে রেঙ্গুন শহরের এক নির্জন এলাকায় অতি দীন-হীনভাবে, খুবই তাচ্ছিল্যের সাথে সমাহিত করে ইংরেজ সরকার। কবরটি বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য, যা একসময় নষ্ট হয়ে যাবে, ঘাসগুলো গোটা জায়গা আচ্ছাদিত করে ফেলবে। কোথায় সর্বশেষ মুঘল সম্রাট শায়িত আছেন, তার চিহ্নও কেউ খুঁজে পাবে না। পরে তার আসল কবর আবিষ্কৃত ও সমাধিসৌধ নির্মিত হয়। সম্রাটের প্রিয়তমা স্ত্রী জিনাত মহল মারা যান ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে। সম্রাটের পাশেই রয়েছে তার সমাধি।

সম্রাট ও তার প্রিয়জনদের সমাধি হয়ে উঠেছে যুগ যুগ ধরে দেশপ্রেমিকদের তীর্থ স্থানের মতো। ইন্তেকালের দেড় শতাব্দী পরও সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফর আজো ভক্তদের হৃদয়ে অমলিন। প্রতি জুমাবার দিন নামাজের পরে আর ঈদের দিনে মুশায়ারার মাহফিল বসে। পঠিত হয় বাহাদুর শাহ’র অমর কাসীদা সমুহ। স্মরণ করা হয় এই উপেক্ষিত, বঞ্চিত, ভাগ্যপীড়িত কবিকে।

সন্দেহ নেই সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফর ইতিহাসের এক ট্র্যাজিক নায়ক যার জীবন বিষাদ, বঞ্চনা, অবহেলা আর উপেক্ষার পদাবলীতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তবু তিনিই আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, আমাদের চেতনার অঙ্কুরোদগম তাঁর হাত ধরেই হয়েছে। তাই আমাদের ইতিহাসের কাছে ফিরতে হবে- বিপ্লবের ব্যর্থতা কেবল শোকগাথা নয়; নতুন প্রজন্মের কাছে উপনিবেশবাদ আর সাম্রাজ্যবাদকে শনাক্ত করারও দিকনির্দেশনা। আমরা চিনতে চাই হতভাগ্য সম্রাট বাহাদুর শাহকে, তাঁর সময়কাল কে, চিনতে চাই অতীতের সঙ্গে বর্তমানের নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মায়ানমার সফরে গিয়ে তার সমাধি সৌধ পরিদর্শন করেন। সে সময় তিনি পরিদর্শক বইতে লিখেছিলেনঃ

"দু গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তান মে , পার তেরী কোরবানী সে উঠি আজাদী কি আওয়াজ, বদনসীব তো নাহি জাফর, জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকত মে, আজাদী কি পয়গাম সে"।

বাংলায় অনুবাদ করলে দাড়ায়;

"হিন্দুস্তানে তুমি দু গজ মাটি পাও নি সত্য। তবে তোমার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিল। দুর্ভাগ্য তোমার নয় জাফর, স্বাধীনতার বার্তার মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম ও গৌরবের সঙ্গে তোমার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে"

------------------------------------

সাঈদ আহসান খালিদ
সিনিয়র লেকচারার
আইন বিভাগ
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

Offline Farhana Helal Mehtab

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 248
  • Test
    • View Profile
Dear Saeed,

Thanks for sharing a historical write up. Do you know, in this semester, a graduate student of Dhaka University, Urdu department has admitted in our LL.B 2 years program? He obtained 1st class in Urdu literature from Dhaka University. I was quite amazed after seeing his result. Anyway,  sharing  about one of my likings, after SSC I started reading Saayeri of famous Urdu poets & Bahadur Shah Zafar  was one of them. In my student life I was just obsessed with his romantic lines. Here, taking the opportunity to write one of his famous poems.

    Aae tum is dum ke jis dum aa gaya aankhon meain dum,
    Main ne dekha bhi na tum ko meri jaan achhi tarah,
    Itni bhi fursat na di hum ko falak ne, ai Zafar,
    Karte is kuche mein hum aah-o-fughaan achhi tarah.



(You arrived when I’d well-nigh breathed my last,
I couldn’t even gaze at you, or please my heart;
I wasn’t allowed to cry at length in this terrestrial lane,
The lease of life given to me was, indeed, too short.)



 By the way, just little saying, since this is pure literature related write up, better to write in the following areas:
Daffodil International University Forum »Entertainment & Discussions »Story, Article & Poetry

Hope to see more write ups from you. I appreciate your works.

Ma'am


Offline Saeed Ahsan Khalid

  • Newbie
  • *
  • Posts: 14
  • Test
    • View Profile
Thanks Maa'm for your precise and insightful feedback. Its always nice to get the common area of interest. I am very much inclined to literature and poetry in particular from the very childhood. I also believe Law & Literature are reciprocally inclusive and complementary to each other. I guess, this article also serve some fruits to the students of Law in general and Legal History in particular to have an insight of the tragic life of Bahadur Shah Jafar. Thanks maa'm for yr nice suggestion. I will keep it mind in future. Take care.

Offline farzanamili

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 471
  • Word has power, use it wisely!
    • View Profile
I did not know much regarding Last Emperor Bahadur Shah... I used to think him as coward, but after reading your post I understood my mistake and feeling guilty for past thoughts. He really did his best, but due to situation, he could not save the country. Salute to the last Emperor!
Mirza Farzana Iqbal Chowdhury
Senior Lecturer
Department of Law
Daffodil International University.