মধ্য দুপুরের চকচকে রোদ। এর মধ্যেই আবার পরখ করে দেখতে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে ফ্লাডলাইট। আলোর রোশনাইয়ে যেন চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল মুশফিকুর রহিমের। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের উইকেটের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাংলাদেশ অধিনায়ক ভ্রু কুঁচকে স্বগতোক্তির মতো বললেন, ‘কাল আবহাওয়া এমন থাকলেই হয়।’
নিউজিল্যান্ড দল মাঠে আসতে আসতে রোদের তেজ চড়ে গেছে আরও। ড্রেসিং রুম থেকে মাঠের আরেক প্রান্তের সংবাদ সম্মেলনকক্ষে আসতে আসতেই ঘেমে-নেয়ে একাকার ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। নিউজিল্যান্ড অধিনায়কের তবু কোনো অভিযোগ নেই, ‘আশা করি কালও এমন ঝলমলে রোদ থাকবে।’
ঘণ্টা দেড়েক পর উধাও সেই ঝলমলে রোদ। মেঘ কালো আকাশে বেলা সাড়ে তিনটাতেই চারপাশে
সন্ধ্যার আবহ। ঘামে ভেজা শরীরকে বৃষ্টিভেজা থেকে বাঁচাতে অনুশীলনের মাঝপথেই ব্যাট-প্যাড নিয়ে ড্রেসিং রুমে ছুটতে হলো ম্যাককালামদের। দুই অধিনায়কের আশাবাদের প্রতি এ যেন প্রকৃতির নির্মম রসিকতা। চট্টগ্রামের প্রতিও কি নয়!
ক্রিকেট সাফল্যে যে শহর বরাবরই দুহাত ভরিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশকে, সেই চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরছে দুই বছর পর। সামান্য বৃষ্টিতেই খেলা না হওয়ার সেই কলঙ্ক-তিলক মুছতে আধুনিক পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা নিয়ে আজ নতুন করে যাত্রা শুরু হচ্ছে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের। কিন্তু সত্যিই হচ্ছে তো? প্রশ্নচিহ্ন বসিয়ে দিচ্ছে চট্টগ্রামেরই প্রকৃতি। মুষলধারে বৃষ্টিতেও এখন আর খেলা লম্বা সময় বন্ধ থাকার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু বৃষ্টি থামতে হবে তো!
টানা বৃষ্টিতে ভেসে গেছে তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচ। চট্টগ্রামে পা রাখার পর প্রথম তিন দিন দুই দল ছিল হোটেলবন্দী, অনুশীলন আটকে ছিল ইনডোরে। পরশু বৃষ্টি হয়নি, কালও দুপুর পর্যন্ত প্রচণ্ড রোদে সবার জেরবার অবস্থা। কিন্তু নতুন করে শঙ্কা জাগাতে হাজির দুপুরের পর বৃষ্টি। আবহাওয়া পূর্বাভাসে আজ টেস্ট শুরুর দিনেও আছে বৃষ্টি। আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে বাংলাদেশে কৌতুকের অভাব নেই। সেগুলোই আওড়ে চট্টগ্রামের ক্রিকেট সংগঠকেরা মনে-প্রাণে কামনা করছিলেন আবারও মিথ্যা হোক পূর্বাভাস। এই চাওয়া দুই অধিনায়কেরও, সিরিজটার জন্য মুখিয়ে আছে যে দুই দলই!
দুই দলের ৯ টেস্টের আটটিতেই জিতেছে নিউজিল্যান্ড, একমাত্র ড্র ম্যাচটির তিন দিন খেলা হয়নি বৃষ্টিতে। আট জয়ের পাঁচটিই আবার ইনিংস ব্যবধানে। বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড টেস্টে তাই ড্র হওয়াটাও বড় অঘটন। তার পরও এই সিরিজ নিয়ে এত আগ্রহের কারণ একটি ওয়ানডে সিরিজ! তিন বছর আগে নিউজিল্যান্ডকে সেই ৪-০তে ধবলধোলাই স্থায়ী জায়গা পেয়ে গেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে। সিরিজটির আলাদা জায়গা নিয়ে থাকবে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটেও। অমন লজ্জার পর তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে। স্পনসররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, গঠনতন্ত্র সংশোধন করে পরিবর্তন আনা হয়েছিল ক্রিকেট প্রশাসনে, এমনকি নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা ড্যানিয়েল ভেট্টোরিকেও মুখোমুখি হতে হয়েছিল জবাবদিহিতার। এবারের সফরের সূচি চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই তাই বারবার ঘুরেফিরে আসছে সেই ৪-০। সিরিজের আবহসংগীত যেন ‘বাংলাওয়াশ।’ দেশের সংবাদমাধ্যমকে ম্যাককালাম বলেছেন সেই ধবলধোলাইয়ের ক্ষত এখনো দগদগে। কাল এখানেও সংবাদ সম্মেলনে কিউই অধিনায়ক বললেন সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলবেন না কখনো। ‘প্রতিশোধ’ শব্দটি তাই ম্যাককালাম-টেলররা যতই এড়িয়ে চলুন, নিউজিল্যান্ডের জন্য এই সফরের ট্যাগলাইন একটিই—‘মিশন: প্রতিশোধ।’
প্রতিশোধ মিশন বলেই এবার আটঘাট বেঁধে এসেছেন ম্যাককালামরা। বাংলাদেশে আসার আগে কোনো ফাঁক রাখেনি প্রস্তুতিতে। এমনিতে ভারত-শ্রীলঙ্কায় খেলার আগে বাংলাদেশ সফরকে প্রস্তুতি হিসেবে নিয়েছে অনেক দল। এবার কিউইরা দেখাল উল্টো। বাংলাদেশে আসার আগে ‘এ’ দলের হয়ে ভারত ও শ্রীলঙ্কা সফরে পাঠানো হয়েছিল নিউজিল্যান্ড ‘এ’ দলকে। সেই দলের বেশ কজন আছে বাংলাদেশ সফরের দলে। এখানে আসার আগে শ্রীলঙ্কায় নয় দিনের ক্যাম্পও করে এসেছে। বাংলাদেশ সফরের জন্য এমন প্রস্তুতি আর কখনো কোনো দল নিয়েছে বলে মনে হয় না।
নিউজিল্যান্ডের জন্য যা লজ্জার ইতিহাস, বাংলাদেশের জন্য তা আরাধ্য স্মৃতি, নিরন্তর অনুপ্রেরণা। প্রেরণা এই মাঠে দুই দলের সর্বশেষ টেস্টও। সেই যে ২০০৮ সালে, ৩৬ রানে ৭ উইকেট নিয়ে আচমকাই বোলার হিসেবে আবির্ভাব সাকিব আল হাসানের। শেষ পর্যন্ত স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় পুড়তে হয়েছিল, কিন্তু আইসিএল-দুর্গত বাংলাদেশের কাছে সে সময় জয়ের সুবাস পাওয়াও চাট্টিখানি কথা ছিল না! এসব স্মৃতি অবশ্য বড় একটা চাপও বটে। এবারও যেমন ধবলধোলাইয়ের পুনরাবৃত্তির আশায় বুক বেঁধে বসে আছেন অনেকে। মুশফিক অবশ্য আত্মবিশ্বাস আর সাম্প্রতিক ফর্ম দিয়েই দূরে ঠেলতে চান প্রত্যাশার চাপকে। কাল বাংলাদেশ অধিনায়কের আত্মবিশ্বাসী ঘোষণা, ‘সব ম্যাচ জয়ের জন্যই মাঠে নামব।’
তবে নিউজিল্যান্ডের তো বটেই, বাংলাদেশের জন্যই দল সাজানো আর পরিকল্পনার পথে বড় বাধা হয়ে এসেছে উইকেট। মাঠের সাতটি উইকেটই একদম নতুন। খেলা হবে তিন নম্বর উইকেটে। তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মাটি আর কন্ডিশনেরই তো উইকেট, চরিত্রটা তাই খুব ভিন্ন হওয়ার সুযোগ নেই। সামান্য ঘাসের ছোঁয়া যা ছিল, সেটা ছেটে কাল ন্যাড়া বানিয়ে ফেলা হয়েছে। নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত তাই চিন্তাভাবনা করছে ব্রুস মার্টিনের সঙ্গে দ্বিতীয় স্পিনার হিসেবে ইশ সোধিকে খেলানোর। ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেগস্পিনার সত্যিই টেস্ট ক্যাপ পেয়ে গেলে বাইরে থাকবেন নিল ওয়াগনার বা ডগ ব্রেসওয়েলের একজন। সে ক্ষেত্রে পেস বোলিংয়ে শক্তি বাড়াতে অভিষেক হতে পারে পেস বোলিং অলরাউন্ডার কোরি অ্যান্ডারসনেরও। তখন জায়গা হারাবেন ডিন ব্রাউনলি।
বাংলাদেশ দলে একজনের অভিষেক নিশ্চিত। ঘরোয়া ক্রিকেটে গত কিছুদিনের নজরকাড়া পারফরম্যান্সের পুরস্কার পাচ্ছেন মার্শাল আইয়ুব। ব্যাট করবেন মোহাম্মদ আশরাফুলের খালি করে যাওয়া তিন নম্বরে। চারে নাঈম ইসলামের সঙ্গে লড়াই মমিনুল হকের। তবে মার্শালের সঙ্গে মমিনুলকে যেভাবে আলাদা করে শর্ট ক্যাচ অনুশীলন করানো হলো, তাতে মনে হয় লড়াইয়ে জিতছেন বাঁহাতি মমিনুলই। নাঈমের সঙ্গে একাদশের বাইরে থাকছেন সম্ভবত মাহমুদউল্লাহ ও নবাগত আল আমিন।
একাদশের চেয়েও বেশি আগ্রহ আপাতত আকাশ নিয়ে। সকালে ঘুম ভাঙার পর দুই দলের সবাই হয়তো প্রথমে তাকাবে জানালার বাইরে। কোনরূপে এল আজ সকালের চট্টগ্রাম? কানে বাজবে যুদ্ধের দামামা, নাকি মেঘের গর্জন!