বাংলাদেশে এইচআইভি প্রতিরোধে সময়োচিত ও নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকেন্দ্রিক পদক্ষেপগুলোতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে। তবু এ বিষয়ে আমাদের আরও অনেক কিছু করতে হবে। আমাদের কর্মপদ্ধতি হতে হবে ঐক্যবদ্ধ, সতর্ক এবং স্বপ্রণোদিত। ‘সংক্রমণ, বৈষম্য ও মৃত্যু একটিও নয়, আর এইডস করব জয়’ শীর্ষক আমাদের এ লক্ষ্য অর্জনে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রণীত নতুন নির্দেশিকা ২০১৩ এবং ইউএনএইডসের ‘চিকিৎসা উদ্যোগ ২০১৫’ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। বিশ্বব্যাপী এইচআইভি/ এইডসবিষয়ক অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এটি এমন একটি সমস্যা, যা আপনাআপনি চলে যায় না বা প্রচলিত পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সে জন্য ‘এইডসমুক্ত বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের আত্মনিয়োগ করতে হবে এবং সেটা এখনই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, একজন রোগীর রক্তে সিডি-৪ কোষ (CD4 cell)-এর সংখ্যা প্রতি ঘনমিলিলিটারে ৫০০-এর কম হলেই তাকে এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ওষুধের সমন্বয়ে প্রদেয় চিকিৎসা (অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল ট্রিটমেন্ট—এআরটি) দেওয়া শুরু করতে হবে। ‘সিডি-৪ কোষ’ হলো রক্তের শ্বেতকণিকা, যা এইচআইভি ভাইরাস কর্তৃক আক্রান্ত হয়। কারও এইচআইভি শনাক্ত হলে তার রক্তে এই কোষের সংখ্যা গণনার ভিত্তিতেই তার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার অবস্থা নির্ণয় করা হয়, কেননা এই কোষের সংখ্যার ওপরই মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নির্ভর করে। নতুন এই নির্দেশনা পুরোনো নির্দেশনার তুলনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন, কেননা পুরোনো নির্দেশনা অনুযায়ী সিডি-৪ কোষের সংখ্যা ৩৫০-এর কম হলে তাকে এআরটি চিকিৎসা দেওয়া হতো। প্রসঙ্গত, নতুন এই নির্দেশনায় এইচআইভি-আক্রান্ত মানুষকে আরও আগেই চিকিৎসা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, কেননা সাম্প্রতিক প্রমাণাদিতে উঠে এসেছে যে যথাশিগগির চিকিৎসা এইচআইভি-আক্রান্ত মানুষকে আরও দীর্ঘায়ু করে, সুস্থতর জীবন দেয় এবং অন্যদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকাংশেই কমিয়ে দেয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে এইচআইভি আক্রান্ত মানুষের জন্য চিকিৎসাসুবিধা (এআরটি) সত্যিই প্রশংসনীয়। এইচআইভি শনাক্ত হওয়া কোনো ব্যক্তির রক্তে সিডি-৪ কোষের সংখ্যা ৩৫০ বা তার কম হলেও সাধারণত তাকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও সেবা দেওয়া হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, রক্তে সিডি-৪ কোষের সংখ্যা ৫০০-এর কম হলেই চিকিৎসা শুরু করার সুপারিশের ফলে সারা দেশে চিকিৎসাপ্রার্থী রোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে, যা একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। এইচআইভি চিকিৎসার সেবাপরিধি সম্প্রসারণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পরামর্শসেবা শক্তিশালীকরণে বাংলাদেশের এখন প্রয়োজন বিভিন্ন উদ্ভাবনী সমাধান, যাতে এই পরিষেবাগুলো প্রযোজ্য ক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত নিশ্চিত করা যায়। সবার জন্য মানসম্পন্ন সেবা ও সুবিধা নিশ্চিত করার ওপরই ‘প্রতিরোধের জন্য চিকিৎসা’ বিষয়টির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। সে অনুযায়ী, বাড়তি সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে সিডি-৪ কোষের সংখ্যা-নির্বিশেষে এইচআইভি-আক্রান্ত মূল জনগোষ্ঠী, দুজনের মধ্যে একজন আক্রান্ত এমন দম্পতি এবং গর্ভবতী নারীদের জন্য চিকিৎসাসুবিধা দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে এবং ইউএনএইডস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘ শিশু তহবিল এবং জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলসহ অন্যান্য জাতিসংঘ সংস্থা, উন্নয়ন-সহযোগী প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় এ পর্যন্ত পরিচালিত এইচআইভি/এইডস কার্যক্রম ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে এবং দেশের সার্বিক সংক্রমণের হার শতকরা শূন্য দশমিক ১ ভাগের নিচে রয়েছে। ঢাকা শহরে সুইয়ের মাধ্যমে মাদক ব্যবহারকারীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার ২০০৭ সালে ছিল শতকরা ৭ ভাগ, যা ২০১১ সালে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৫ দশমিক ৩ ভাগে। অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী যথা নারী যৌনকর্মী, পুরুষ সমকামী ও হিজড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যেও এই সংক্রমণের হার নিম্নমাত্রায় (শতকরা ০-২ ভাগ) রয়েছে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, এইচআইভি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।
তথাপি, জনসংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশের এইচআইভি প্রতিরোধ কার্যক্রম ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। কেননা, বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, যেখানে দীর্ঘদিনের দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব ও লিঙ্গবৈষম্য বিরাজ করছে এবং ব্যাপক হারে আন্তর্দেশীয় যাতায়াত রয়েছে।
এইডস মহামারির আদল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিরোধ কার্যক্রমের আদলেও পরিবর্তন আসে। প্রতিরোধের জন্য চিকিৎসাবিষয়ক এই নতুন ধারণার গোড়াপত্তনে উন্নত তথ্যানুসন্ধান এবং জাতীয় পর্যায়ে তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (এমআইএস) হাতে নেওয়া হবে। আরও কাজ করার সুযোগ রয়েছে এমন ক্ষেত্রে বিরাজমান সেবাগুলো সম্প্রসারণের লক্ষ্যে চিকিৎসক, পরীক্ষকসহ সেবা ও পরামর্শ প্রদানকারী নিয়োগ করা প্রয়োজন। সেবা ও সহায়তা কার্যক্রম জোরদার করতে জনসমাজকে আরও উদ্বুদ্ধ করা জরুরি। একই সঙ্গে নতুন সংক্রমণের অন্যতম উৎস যেমন ঝুঁকিপূর্ণ প্রবাসীশ্রমিকদের মাধ্যমে সংক্রমণ প্রতিরোধে অতিরিক্ত অর্থ মঞ্জুরি বরাদ্দ রাখতে হবে।
সর্বোপরি, ‘এইডসমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্য অর্জনে আমরা ঐক্যবদ্ধ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে
এবং দায়িত্বপূর্ণ সংস্থা ও ব্যক্তিদের পরামর্শের ভিত্তিতে নতুন এই নির্দেশনা এবং ‘প্রতিরোধের জন্য চিকিৎসা’পদ্ধতির সম্প্রসারণের মাধ্যমে সেই কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ আসতে পারে।
রুহুল হক: মন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
ড. তুষারা ফারনান্দো: প্রতিনিধি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বাংলাদেশ।
লিও কেনি: ইউএনএইডস কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর, বাংলাদেশ।
http://www.prothom-alo.com/opinion/article/68803/%E2%80%98%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A7%E0%A7%87%E0%A6%B0_%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AF_%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A7%8E%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E2%80%99