মধ্য হেমন্তে চট্টগ্রামের শস্য ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিলে শুরু হয়েছে ধান কাটার উৎসব।
বিস্তৃত ফসলের মাঠে সোনালি ধান। আশানুরূপ ফলন হওয়ায় কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসি। ধানের দামও মিলছে ভাল।
তাই উৎসাহ আর উদ্দীপনায় চলছে কৃষকের কাস্তে। ধান কাটার গানেও পড়ছে না ছেদ।
হিসাব কষে লাভের কথাই বলছেন কৃষক। তাদের সঙ্গে একমত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও।
তারা বলছেন, গতবারের তুলনায় এবার হেক্টর প্রতি আমনের ফলন বেড়েছে।
চট্টগ্রামের অন্যান্য এলাকার তুলনায় গুমাই বিলের ধান একটু আগেই পাকে। তাই কাটার উৎসবও শুরু হয়েছে সপ্তাহ খানেক আগে।
শনিবার রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিলের নিশ্চিন্তাপুর, কাটা বটতল, মাঝের বিল, কদমতলি সংলগ্ন বিভিন্ন অংশে কথা হয় কৃষক ও ধান কাটার শ্রমিকদের সঙ্গে।
কাটা বটতল এলাকায় নিজের জমিতে ধান কাটছিলেন মো. শফি (৫৫)। বিলে তার আট কানি জমিতে এবার সাদা পাইজাম জাতের ধান চাষ করেছেন।
শফি জানান, জমি চাষ, ধান লাগানো, সেচ, বীজ-সার-কীটনাশক ও ধান কাটার সময় শ্রমিকের মজুরি মিলে কানি প্রতি প্রায় সাত হাজার টাকা খরচ পড়ছে। সেখানে প্রতি কানিতে এবার কম-বেশি ধান হয়েছে সাড়ে ১২ মন। মন প্রতি ৮০০ টাকা দরে এ ধানের দাম হবে ১০ হাজার টাকা।
তাই আট কানিতে ধান বেচে খরচ বাদে ২৪ হাজার টাকার মতো হাতে থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এলাকার কৃষক মোহাম্মদ রুবেলের বিলে প্রায় পাঁচ কানি জমি আছে।
“ধানের দাম গতবারের চেয়ে কিছুটা বেশি। কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারলে দাম আরো বাড়তে পারে,” বলেন তিনি।
কৃষকরা জানান, এবার জমি চাষে কানি প্রতি দেড় হাজার টাকা এবং সেচের জন্য কানি প্রতি দেড় হাজার টাকা খরচ হয়েছে।পাশাপাশি কানি প্রতি চারা রোপনে এক হাজার ২০০ টাকা এবং কাঠায় দেড় হাজার টাকা খরচ হয়।
ধান কাটা শ্রমিকরা জানান, এবার বিলে স্থান ভেদে কানিতে সর্বোচ্চ ১৭ মন থেকে সর্বনিম্ন ১২ মন পর্যন্ত ফলন হয়েছে।
সর্বোচ্চ ১৭ মন হিসেবে কানিতে ধানের দাম আসবে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা। আর সাড়ে ১২ মন ধান উৎপাদনের হিসেব ধরলে আয় হবে ১০ হাজার টাকা।
এ হিসাবে কানিতে সর্বনিম্ন তিন থেকে সর্বোচ্চ ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হবে। ধানের দামের ওপর উঠানামা করে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরিও।
গত সপ্তাহে দিনে ৩০০ টাকার সঙ্গে দুই বেলা খাওয়ার বিনিময়ে ধান কেটেছেন বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারার আমীর আলী। এ সপ্তাহে ধানের দাম বাড়ায় তার মজুরি বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৩০০ টাকা।
আমীর বলেন, “গ্রামে ধান পাকবে আরও এক মাস পর। বাড়তি আয়ের আশায় সাত জন মিলে এখানে চলে এসেছি।”
যেখানে ফলন কম সেখানে বর্গা খরচ কম। আর যেখানে ফলন বেশি সেখানে বর্গা খরচও বেশি বলে জানান আরেক শ্রমিক শওকত আলম।
কৃষক আজগর আলীর (৭০) বিলে জমি আছে ১০ কানি।
তিনি বলেন, “কানি প্রতি দুই হাজার টাকা দরে বর্গা দিয়েছি। বয়স হয়েছে বলে আর নিজে চাষ করতে পারি না। আবার জমি খালিও রাখা যায় না। এবার ফলন ভালই হয়েছে। ধানের দামও ভাল।”
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবার উপজেলায় ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছে। এরমধ্যে গুমাই বিলে প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে।
এবার কোনো পোকার আক্রমণ না থাকায় এবং নিয়মিত বিরতিতে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিও হওয়া ফলন ভালো হয়েছে বলে জানান তিনি।
এই কর্মকর্তা জানান, বিলে হেক্টর প্রতি পায়জাম ধানের উৎপাদন হয়েছে ৩ দশমিক ২৫ টন। আর বিরি ধানের ফলন প্রতি হেক্টরে ৩ দশমিক ৬০ টন।
এই উৎপাদন গত কয়েক বছরের তুলনায় বেশি বলে জানান তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে এবার চট্টগ্রাম জেলায় মোট এক লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। তবে তার চেয়ে প্রায় সাত হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আমনের চাষ হয়েছে।
বাংলাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল গুমাই বিল থেকে সারা দেশের চালের চাহিদার মোট আড়াই দিনের যোগান আসে বলে বলা হয়ে থাকে।
ধান কাটার মৌসুমে তাই জীবিকার সন্ধানে বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে আসেন ধান কাটা শ্রমিকরা। তাদের অধিকাংশই চট্টগ্রামের বাঁশখালী, সাতকানিয়া, কক্সবাজার ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা।
নেত্রকোনার দুর্গাপুর থেকে তিন দিন আগে ধান কাটতে এসেছেন আব্দুল আলী।
গত সাত বছর ধরে নিয়মিত এখানে ধান কাটতে আসেন বলে জানান তিনি।
“দেড় মাস থাকব। দিনে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা পাই। থাকা-খাওয়া গৃহস্থের বাড়িতে,” বলেন এই শ্রমিক।
চকরিয়ার বাসিন্দা জসিম বলেন, একেক সময় একেক গৃহস্থের জমির ধান কাটেন। মাস খানেক পর চলে যাবেন।