১৯৬৯ সালের ১৯ নভেম্বর ভাস্কো দা গামা ও সান্তোসের মধ্যকার ম্যাচটি ব্রাজিলিয়ান লিগের কোনো সাধারণ ম্যাচ ছিল না। লাখো মানুষ মারাকানা স্টেডিয়ামে ভিড় জমিয়েছিলেন এক বিস্ময়কর মাইলফলকের সাক্ষী হওয়ার জন্য। হার-জিতের হিসাব সেদিন গণ্য হয়ে গিয়েছিল। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন কিংবদন্তি পেলের ১০০০তম গোলের জন্য। এমনকি পেলের গোলটি দেখার জন্য নিজ দলের হার মেনে নিতেও রাজি ছিলেন প্রতিপক্ষ ভাস্কো দা গামার সমর্থকেরা। পেলে গোলটি পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেটা বহু নাটকীয়তা শেষে।
খেলা শুরুর পর থেকেই গোলের জন্য মরিয়া হয়ে খেলেছিলেন পেলে। কিন্তু প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররাও যেন পণ করেছিলেন, হার-জিত যা-ই হোক, পেলেকে তাঁরা নিজ জালে বল জড়াতে কোনোভাবেই দেবেন না। পেলের একটি দুর্দান্ত গোল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেওয়ার পর নিজ দলের সমর্থকদের কাছ থেকেই দুয়োধ্বনি শুনতে হয়েছিল ভাস্কো দা গামার খেলোয়াড়দের। তাতে অবশ্য বিন্দুমাত্রও দমেননি তারা। ভাগ্যও যেন ছিল পেলের বিপক্ষে। তাঁর একটি শট ফিরে আসে
গোলপোস্টে লেগে। তার আগে আরও একটি জোরালো শট অবিশ্বাস্য দক্ষতায় রুখে দেন প্রতিপক্ষের গোলরক্ষক। এমনকি পেলের গোল ঠেকানোর জন্য একবার ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের জালেই বল জড়িয়ে দিয়েছিলেন ভাস্কো দা গামার এক ডিফেন্ডার। কিন্তু ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী স্টেডিয়াম মারাকানাই যে পেলের ১০০০তম গোলের সাক্ষী হবে, এটা যেন ছিল নিয়তি-নির্ধারিত।
৭৭ মিনিটের মাথায় আসে সেই ইতিহাসগড়া মুহূর্তটি। প্রতিপক্ষের পেনাল্টি বক্সের মধ্যে ফাউলের শিকার হন পেলে। পেয়ে যান পেনাল্টি থেকে গোল করার সহজ সুযোগ। আর সেটা কাজে লাগাতে বিন্দুমাত্রও ভুল করেননি এই গোলমেশিন। ভাস্কো দা গামার গোলরক্ষকের প্রচেষ্টাও কম ছিল না। পেলে যেদিকে শট নিয়েছিলেন সেদিকেই ঝাঁপিয়েছিলেন তিনি। বলে হাতটাও ছুঁইয়েছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। বলটা ঠিকই জালে জড়িয়েছিল। আক্ষেপ আর হতাশায় বারবার মাটিতে ঘুষি মারা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না ভাস্কো দা গামার গোলরক্ষকের। আর পেলে ছুটে গিয়েছিলেন ইতিহাসগড়া বলটিতে চুম্বন এঁকে দেওয়ার জন্য। মুহূর্তের মধ্যেই মাঠে দৌড়ে এসেছিল শত শত ভক্ত। তাদের কাঁধে চড়েই ১০০০তম গোলের মাইলফলক স্পর্শের মুহূর্তটি উদযাপন করেছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার।
পরবর্তী সময় সেই দিনটির কথা স্মরণ করে পেলে বলেছিলেন, ‘প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরা যা যা সম্ভব, সবই করেছে গোল ঠেকানোর জন্য। এমনকি নিজেদের জালেও বল জড়িয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে, যেন আমি গোল করার সুযোগ না পাই। কিন্তু পেনাল্টি বক্সের মধ্যে আমাকে ফাউল করা হয়। আমিও পেয়ে যাই পেনাল্টি থেকে গোল করার সুযোগ। এই মুহূর্তে দর্শকরা যেন পাগল হয়ে গিয়েছিল। আমি কয়েক ধাপ পিছিয়ে এসে শট নিলাম। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম দর্শকেরা ১০০ মাইল বেগে আমার দিকে ছুটে আসছে। আমি জানতাম, এটা হবে একটা দারুণ দিন।’
মজার ব্যাপার হলো, ১০০০তম গোলটা হয়তো আগের ম্যাচেই করে ফেলতে পারতেন পেলে। সেই ম্যাচে ৯৯৯তম গোলটা করার পরেই হঠাত্ করে দেখা গেল ইনজুরির ফাঁদে পড়েছেন সান্তোসের গোলরক্ষক। আরও অবাক করার মতো ব্যাপার, সেদিন তাদের কোনো বদলি গোলরক্ষকও ছিল না। পেলেই পরবর্তী সময়ে দাঁড়িয়েছিলেন গোলপোস্টের নিচে। ব্রাজিলিয়ান এই কিংবদন্তি যেন মারাকানার মতো ঐতিহ্যবাহী স্টেডিয়ামেই ক্যারিয়ারের ১০০০তম গোলটি করতে পারেন, সেজন্যই নাকি গোলরক্ষককে আঘাত পাওয়ার অভিনয় করতে বলেছিলেন সান্তোসের কোচ। পেলেও গোল করা বাদ দিয়ে নিয়ে ছিলেন গোল ঠেকানোর ভূমিকা।