পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে আছে অনেক রহস্যময় আর চমকপ্রদ জিনিস। এরকমই কিছু পাওয়া গিয়েছিল পৃথিবীর সবচাইতে উঁচুতে অবস্থিত হ্রদ টিটিকাকার নিচে। দক্ষিণ আমেরিকার পেরু ও বলিভিয়ার মাঝামাঝি জায়গায় এটি অবস্থিত। ৩২০০ বর্গ মাইল আয়তনের এই বিশাল হ্রদ, যার গভীরতা প্রায় ১০০০ ফুট। ইনকা সভ্যতারও অনেক আগে থেকে দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে এই হ্রদটি পবিত্র হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। স্থানীয় লোককথা অনুযায়ী, এই হ্রদ থেকে দেবতা ভিরাকোচা উঠে আসেন ও তিয়াহুয়ানাচো নামের একটি জায়গায় আসেন প্রথম ‘এন্ডিয়ান’ (আন্দিজ পর্বতমালার অধিবাসী) মানুষ তৈরির করার জন্য। অনেক দিন ধরেই এই ধারণা প্রচলিত হয়ে আসছিল যে, এই হ্রদের নিচে রয়েছে প্রাচীন এক মন্দির। কিন্তু কেউ জানতো না, হ্রদের এত গভীরে এই মন্দির কিভাবে এলো? আর কারাই বা তৈরি করেছে এই মন্দির?
গবেষকরা অনেক আগে থেকেই হ্রদের নিচে প্রাচীন কোন মন্দির বা স্থাপনার কথা শুনে আসছিলেন। শুকনো মৌসুমে যখন হ্রদের পানি কমে যায় তখন স্থানীয় জেলেরা প্রায়ই হ্রদের নিচে প্রাচীন যুগের প্রাসাদ দেখতে পাওয়ার কথা জানান। কিংবা স্থানীয় ডুবুরিরা যখন পানির নিচে যেতেন তখন পাথরে বিভিন্ন উঁচু ভবনের ছাদ স্পর্শ করে আসেন। বিখ্যাত ফরাসি সমুদ্রবিজ্ঞানী জ্যাক কস্টিউ প্রাচীনগুপ্তধনের সন্ধানে এই জায়গাটিতে অভিযান চালান কিন্তু কিছু প্রাচীন তৈজসপত্র ছাড়া তিনি আর কিছুই পান নি।
এরপর ১৯৬৭ সালে বলিভিয়ান সরকার ও ১৯৮৮ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক টিটিকাকা হ্রদের নিচে বৈজ্ঞানিক তথ্যের জন্য অভিযান চালায়। বিভিন্ন দেশের প্রত্নতত্ত্ববিদরা হ্রদের নিচের অনেক প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান। আর এটি খুঁজতে গিয়ে এই হ্রদের নিচে প্রায় ১০০ ফুট গভীরতায় প্রায় দুইশ বার আসা-যাওয়া করতে হয় বিশেষজ্ঞদের। আরো অবাক হওয়ার মত বিষয় হচ্ছে, হ্রদের তীর থেকে বেশ কিছু পথ নেমে গিয়েছে একদম হ্রদের নিচে। আর সেগুলো হ্রদের পানির নিচে এক জায়গায় একটি অর্ধ-চন্দ্রাকার স্থানে গিয়ে মিলিত হয়েছে। পাথর খুব সুন্দরভাবে কেটে এই পথগুলো বানানো হয়েছে, পথের সংখ্যা সর্বমোট ত্রিশ।
সাল ২০০০, এবার হ্রদের নিচে পাওয়া গেল আরো চমকপ্রদ কিছু। হ্রদের নিচে চলে যাওয়া পথ অনুসরণ করতে করতে পাওয়া গেল ২০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৫০ মিটার প্রস্থের মন্দিরের সন্ধান পাওয়া গেল, যেটি একটি ফুটবল মাঠে চেয়েও ছিল বড়। এখন পর্যন্ত কেউ জানে না, কারা এই মন্দির তৈরি করেছিল? আর এটি কি পানিতে ডুবে গিয়েছিল? নাকি পানির নিচেই তৈরি করা হয়েছিল? এই মন্দিরের সাথে আরো পাওয়া গিয়েছে শস্য মাড়াইয়ের জন্য ব্যবহৃত ট্যারেস বা ছাদ, একটি লম্বা রাস্তা ও ৮০০ মিটার দৈর্ঘ্যের লম্বা দেয়াল। আর জায়গাটি আন্দিজ পর্বতমালার ঠিক কাছেই পানির নিচে অবস্থিত। দেখা গেল এগুলো প্রায় ১০০০ থেকে ১৫০০ বছরের পুরনো।
২০০২ এর ২৮ মে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক লিখলো, “ পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক অনেক ভয়াবহ বন্যার কথা রয়েছে, যেগুলো বিভিন্ন সভ্যতার ধ্বংসের কারণ ছিল। আর এই ধারণা বিভিন্ন দেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পর্যন্ত চলে এসেছে। এতদিন ধরে বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা ছিল, এসব বন্যার কথা শুধুমাত্র মানুষকে নৈতিক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এগুলোর কোন কোন ঘটনা সত্যও হতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পানির অনেক গভীরে পাওয়া প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন কি এই কথাই তুলে ধরে?” এছাড়া হ্রদের নিচে অনেক প্রাচীন যুগের পাথর পাওয়া গিয়েছে, যেগুলো হ্রদের নিচে থাকা রাস্তা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিল বলে ধারণা করে হয়। এগুলোর সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ১২০০০ সাল!
যাই হোক, যখন এই অভিযান শুরু হলো, তখন তা স্থানীয় জনগণের বাধার সম্মুখীন হয়। কারণ অভিযানের কথা তাদের আগে জানানো হয় নি। ইনকাদের সময় থেকেই এই হ্রদকে ‘পবিত্র’ বলে গণ্য করা হয়। ইনকা সভ্যতা অনুযায়ী, সূর্য দেবতার ছেলেরা এই হ্রদ থেকেই উঠে আসেন। তবে এখন পর্যন্ত এটি একটি বড় প্রশ্ন, কে বা কারা এই মন্দির তৈরি করেছিল? আর কেনই বা এই প্রাচীন নিদর্শনগুলো আজ পানির নিচে? যেখানে টিটিকাকা হ্রদ পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থানে অবস্থিত হ্রদ বলে স্বীকৃত?
অধিকাংশ বিজ্ঞানীর ধারণা এই যে হ্রদের নিচে নিমজ্জিত এই সভ্যতার নিদর্শন আদতে ভিনগ্রহী প্রাণীদের পৃথিবী আগমনের প্রমান। লোককথায় যে সকল দেবতার কথা বলা হয়, তারাই মূলত সেই ভিনগ্রহ বাসী। অনেক বিজ্ঞানী এটাও ধারণা করেন যে এই প্রাচীন মন্দির সম্ভবত একটি প্রাচীন স্টেশন এবং টিটিকাকা হ্রদ আসলে একটি কৃত্রিম হ্রদ। কোন কারণে স্পেস স্টেশনটির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়া যাওয়ায় বিপুল পরিমান জলরাশি একত্রিত করে জন্ম দেয়া হয়েছে এই হ্রদের। তবে এগুলো স্রেফ ধারণা নয়, বিশ্বাসী বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট তথ্য যুক্তিও উপস্থাপন করে থাকেন তাঁদের এই মতবাদের স্বপক্ষে।
তবে ব্যাপার যাই হোক না কেন, এই লেক টিটিকাকা ও তাঁর বিপুল জলরাশির নিচে নিমজ্জিত প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন আজো এক বিরাট রহস্য।(priyo.com)