বাড়ির পাশে নেপাল। আর ঘরের পাশে কাঠমান্ডু। সেখানে যাওয়ার সময় এখনই। বৃষ্টির মৌসুম শেষে শীতও তেমন জাঁকিয়ে পড়েনি। তাই অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাস নেপাল ভ্রমণের জন্য সেরা সময়।
এই শরৎ হেমন্তে কাঠমান্ডুর উপত্যকা জুড়ে আগুন রংয়ের ছড়াছড়ি। পাহাড়ি পত্রপতনশীল গাছের পাতায় পাতায় হলুদ, কমলা-লাল রংয়ের বাহার। সেই সঙ্গে রয়েছে হিমালয়ের শোভা। কাঠমান্ডু যাওয়ার পথে বিমানের জানালা দিয়েই দেখতে পাবেন এভারেস্ট, অন্নপূর্ণা, কাঞ্চনজংঘা, মাকালুর বিখ্যাত শৃঙ্গ। আর কাঠমান্ডু শহরের প্রায় সব জায়গা থেকেই দেখা যাবে এভারেস্টের শোভা।
একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অন্যদিকে ঐতিহাসিক স্থাপনা— কাঠমান্ডুর আকর্ষণের কোনো তুলনা নেই। সেই সঙ্গে শপিংয়ের কথা যদি যোগ করা যায় তাহলে বলা চলে কাঠমান্ডু সত্যিই তুলনাহীন।
কাঠমান্ডু যেতে হলে সঙ্গে একটি বই নিয়ে যাওয়াই যথেষ্ট। সেটি হল সত্যজিৎ রায়ের ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’। ফেলুদার বিখ্যাত অ্যাডভেঞ্চার বই।
নেপালের ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট থেকেই পোর্ট এন্ট্রি ভিসা নেওয়া যায়। তবে ঢাকার নেপাল দূতাবাস থেকে ভিসা নিয়ে যাওয়াই সুবিধাজনক।
২ হাজার বছরের প্রাচীন এই শহর ‘কাষ্ঠ-মণ্ডপ’ মন্দিরের নামানুসারে এর নাম কাঠমান্ডু। মন্দিরটি শহরের প্রাণকেন্দ্র দরবার স্কোয়ারে অবস্থিত। পুরো মন্দিরটি কাঠের তৈরি। একটি বড় গাছ থেকে নাকি পুরো মন্দিরটি কেটে বের করা হয়। মন্দিরের দেয়ালে ও ভিতরে কাঠের কারুকার্য দেখলে চোখ ফেরানো মুশকিল।
কাঠমান্ডুতে দেখার জায়গার অভাব নেই। দরবার স্কয়ার, পশুপতিনাথের মন্দির, স্বয়ম্ভূনাথের স্তূপ, বুদ্ধনাথ, বুদ্ধনীলকণ্ঠ, পাটন বা ললিতপুর, রাজপ্রাসাদ, কালভৈরব, শ্বেত ভৈরবের মন্দির পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ।
কাঠমান্ডু পর্যটকের শহর হিসেবে খ্যাত। এখানে ১০-১২টি ফাইভ স্টার, অনেক ফোর স্টার, থ্রি স্টার এবং সাধারণ মানের হোটেল পাবেন। এভারেস্ট, হায়াত রিজেন্সি, র্যা ডিসন, সাংরিলা, শংকর, হোটেল ডি লা অন্নপূর্ণা— এগুলো ফাইভ স্টার। বৈশালি, নারায়ণী, দ্য ব্লু স্টার, গ্র্যান্ড হোটেলসহ নামকরা ফোর স্টার হোটেল রয়েছে। দ্য গার্ডেন হোটেল, হোটেল অ্যাম্বাসেডর, আলোহা ইন— এগুলো থ্রি স্টার হোটেল হিসেবে খ্যাত। শহরের পর্যটন এলাকা থামেলে রয়েছে অসংখ্য স্বল্পমূল্যের হোটেল, রেস্টহাউস ও পানশালা। থামেল অনেকটা চকবাজারের মতো। এখানে প্রয়োজনীয় সব জিনিসই কেনাকাটা করতে পারবেন।
ঝামেল হল আরেকটি প্রাণচঞ্চল এলাকা। থামেলের সঙ্গে মিল করে এর নাম দেওয়া হয়েছে। এর আসল নাম ঝচেনটল বা ফ্রিক স্ট্রিট। থামেলের মতো এখানেও সুলভশ্রেণির হোটেল, রেস্ট হাউজ, দোকানপাট রয়েছে। আসানবাজারও শপিং সেন্টার হিসেবে খ্যাত।
আমার কাঠমান্ডু সফর শুরু হল পশুপতিনাথের মন্দির দিয়ে। হোটেল এভারেস্টে ছিলাম। সেখান থেকে শাটল বাস সরাসরি যায় মন্দিরে। তবে শহরের যে কোনো প্রান্ত থেকে পশুপতিনাথের মন্দিরে যাওয়ার জন্য রয়েছে ট্যাক্সি ও বাস। কাঠমান্ডুতে আরও রয়েছে টেম্পু বা হিউম্যান হলারের মতো সস্তা যানবাহন। রেন্ট-এ-কারের ব্যবস্থাও রয়েছে।
পঞ্চম শতাব্দীতে পশুপতিনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। মূল চত্বরে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়বে বিশাল নন্দী মূর্তি। এটি সোনায় মোড়ানো। মন্দিরের বিশাল ছাদও সোনায় মোড়ানো। ফলে দূর থেকেই ঝলমল করে পুরো মন্দিরটি। বিশাল এলাকা জুড়ে এই মন্দিরের ৩ তলায় রয়েছে একটি মূল মন্দির। একই চত্বরে রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি মন্দির। ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পরম পবিত্র এই স্থান। তাই তীর্থযাত্রীদের ভিড় লেগেই আছে।
মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বাগমতি নদী। তীরে মন্দিরের সঙ্গেই রয়েছে সবচেয়ে বড় শ্মশান। নেপালের কাঠমান্ডুর অধিবাসীদের অধিকাংশ হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। একই শহরে শিব এবং গৌতম বুদ্ধর সহাবস্থান।
কাঠমান্ডুর অন্যতম বিখ্যাত দর্শণীয় স্থান হল স্বয়ম্ভূ স্ত্মূপ। মূল শহর থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত। সার্ক দেশের নাগরিকদের জন্য স্ত্মূপে প্রবেশ ফি অনেক কম। সেজন্য পাসপোর্ট দেখাতে হবে। এখানে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় ভোর বেলা। ৩ হাজার বছরের প্রাচীন এই স্ত্মূপের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য, পুরাতাত্বিক মূল্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে দেশবিদেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক এখানে আসে। পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় এই স্ত্মূপ থেকে পুরো কাঠমান্ডু উপত্যকার অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়। মূল স্থাপনায় সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধের চোখ আঁকা। সেই চোখ যেন করুণা বর্ষণ করছে কাঠমান্ডুর অধিবাসীদের প্রতি।
স্বয়ম্ভূ চত্বরে রয়েছে অনেকগুলো দৃষ্টি নন্দন স্থাপনা। যার পুরাতাত্বিক ও নন্দনতাত্বিক মূল্য অসাধারণ। এখানে বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীদের হাতে রয়েছে জপযন্ত্র। তারা জপযন্ত্র ঘুরাচ্ছেন আর আবৃত্তি করছেন তাদের মহামন্ত্র ‘ওম মণি পদ্মে হুম’।
কাঠমান্ডুর আরেকটি আকর্ষণ বুদ্ধনাথ স্ত্মূপ। সাদা রংয়ের এ স্ত্মূপে মূলত তিব্বতী লামাদের দেখা মেলে। এটি নেপালের বৃহত্তম বৌদ্ধ স্ত্মূত।
কাঠমান্ডু শহর প্রকৃতপক্ষে ৩টি শহর নিয়ে গড়ে উঠেছে। কাঠমান্ডু, ভক্তপুর ও পাটন বা ললিতপুর। ললিতপুর হল নেপালের প্রাচীন রাজবংশের আবাস স্থল। ১২শ’ শতকের রাজপ্রাসাদ ও অভিজাতদের প্রাসাদসহ পুরো এলাকাটি পর্যটকদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। এখানে কোনো আধুনিক স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ। এই এলাকার সঙ্গেই রয়েছে কেনাকাটার জন্য বাজার এলাকা।
কাঠমান্ডুর চেয়ে পাটনে জিনিসপত্রের দাম কিছুটা কম। এখানে পাবেন নেপালের বিখ্যাত পশমিনা শাল, নেপালী টুপি, আংগোরা সোয়েটার, শাড়ি, পাথরের মালা, দুল, চুড়িসহ হরেক রকম জিনিস।
পাথরের মালা নেপালের ঐতিহ্যবাহী গয়না। চীনের সামগ্রীতেও ভরপুর নেপালের বাজার। সানগ্লাস, জ্যাকেট, শার্ট, টাই, প্যান্টসহ সব রকম পোশাক সস্তায় মিলবে এখানে। নেপালের বিভিন্ন সুভ্যেনির যেমন, জপযন্ত্র, কাঠের বুদ্ধ মূর্তি, ছবির ফ্রেম পাবেন। কাঠের কাজের জন্য পাটন বিখ্যাত। কাঠের তৈরি সামগ্রীতে এই এলাকার বাজার ভরপুর। বিখ্যাত নেপালি ভুজালি, কুকরি, ছুরি মিলবে এখানে।
এখানে বলে রাখা ভালো— ভুজালি বা ছুরিজাতীয় কোনো কিছু বিমানে ফেরার সময় হ্যান্ড লাগেজে বা ক্যাবিন লাগেজে রাখবেন না। তাহলে বিমান বন্দরে তা ফেলে দেওয়া হবে। এগুলো মূল লাগেজে রাখবেন। আরও জানিয়ে রাখা ভালো এখানে ব্যাপক দরদাম চলে। দর কষাকষি চলে থামেল ও ঝামেলসহ যে কোনো শপিং কমপ্লেক্সে।
নেপালের হস্তশিল্পের মধ্যে বিখ্যাত হল মুখোশ ও থাংকা। কাঠের তৈরি বিভিন্ন মুখোশ শোপিস হিসেবে অনবদ্য। পেপার ম্যাশের তৈরি মুখোশও পাবেন। থাংকা— কাপড়ে আঁকা ছবি। সিল্কজাতীয় কাপড়ে আঁকা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন দেবদেবীর ছবি থাকে থাংকায়। নকশা করা থাংকা বেশ দামি। কয়েক হাজার নেপালি রুপি দামের এসব থাংকা বিক্রি হয় বিভিন্ন কিওরিওশপ বা শিল্পকর্ম বিক্রি করে এরকম দোকানে। তিব্বতি থাংকার নাম বেশি। তিব্বতি হ্যান্ডি ক্রাফটসের দোকান রয়েছে থামেল, পাটন ও দরবার স্কয়ারে।
দরবার স্কয়ার কাঠমান্ডুর একেবারে প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত। এখানে আশপাশে রয়েছে প্রচুর দর্শণীয় স্থাপনা। কাল ভৈরব, শ্বেত ভৈরবের মন্দির রয়েছে কাছেই। রয়েছে প্রাচীন রাজপ্রাসাদ।
নেপালে খাবারের স্বাদ বেশ। ভাত বা রুটি যাই খান প্রথমেই পরিবেশিত হবে পাঁপড়। সঙ্গে থাকবে ঝাল চাটনি। ভাত, সবজি ও ডাল পাবেন। সাধারণ রেস্টুরেন্ট বা একেবারে রোডসাইড ধাবাতেও পাবেন মুখরোচক খাবার। ভাত, তরকারি সব কিছুর সঙ্গেই মিলবে পাঁপড় ও চাটনি।
ডাল-ভাত নেপালের বিখ্যাত খাবার। ডাল রাঁধা হয় মশলা দিয়ে, খেতে দারুন মজা। মাংস ও মাছ বড় রেস্তোরাঁ ছাড়া পাবেন না। নেপালে সাধারণ খাবারের দোকানে গরুর মাংস পাওয়া যায় না। কাঠমান্ডুতে তিব্বতি খাবারের অনেক রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এখানে মোমো নামে তিব্বতী খাবার পাওয়া যায়। লাল সসে ডুবানো এই খাবারটি এক ধরনের মিট বল। বিভিন্ন মাংসের হতে পারে। চিকেন মোমো খেলে মজা পাবেন।
ভারতীয় রেস্টুরেন্ট যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে কেএফসি এবং পিৎজা হাটের মতো চেইন ফুড শপ। নেপালি ভাষার পাশাপাশি সাধারণ মানুষ হিন্দি বোঝে। আপনি যদি কাজ চালানোর মতো হিন্দি বলতে পারে তাহলে কোনো সমস্যা নেই। একটু ভালো শপিং সেন্টারে ও হোটেলে ইংরেজি বোঝে।
বাংলাদেশ বিমান ও ইউনাইটেড এয়ারের ঢাকা-কাঠমান্ডু সরাসরি ফ্লাইট রয়েছে। প্যাকেজ ট্যুরের আওতায় বিমান টিকিটসহ হোটেলে ২ রাত ৩ দিন থাকার জন্য জনপ্রতি খরচ পড়বে সাধারণত ২৪-৩৫ হাজার টাকা।
নেপাল গেলে কাঠমান্ডুসহ পোখরা ও ভক্তপুরেও যেতে পারেন। যেতে পারেন গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনিতেও। কাঠমান্ডু ও নাগরকোট যেতে হলে ৩ রাত ও ৪ দিনের প্যাকেজ ট্যুরে খরচ পড়বে সাধারণত ৩০ হাজার টাকা। পোখরা ও অন্যান্য স্থানে গেলে খরচ পড়বে জনপ্রতি ৩০-৩৫ হাজার টাকা।
নেপালে ক্যাসিনো, বার ও ক্যাবারে সরকারিভাবে স্বীকৃত। এসব জায়গায় জমজমাট হয়ে ওঠে নেপালের রাত। তবে একটু সাবধানে থাকতে হয়। প্রতারকের অভাব নেই এসব জায়গায়।
কাঠমান্ডুতে অনেক ক্যাসিনো রয়েছে। ফাইভ স্টার হোটেল থেকে শাটল-কার যায় এসব ক্যাসিনোতে। হোটেলের নিজস্ব ক্যাসিনোও রয়েছে। নেপালে এ সময় মোটামুটি ঠাণ্ডা পড়ছে। আর নভেম্বরে বেশ শীত থাকবে। তাই কাঠমান্ডু যেতে হলে লাগেজে গরম কাপড় রাখতে ভুলবেন না।
এই মৌসুমে হিমালয়ের শোভার পাশাপাশি কাঠমান্ডু শহরের কাঠের ঘরবাড়ির শৈলীতেও মুগ্ধ হবেন।