বাংলাদেশের গৌরব ৭ বীরশ্রেষ্ঠ- যেভাবে শহীদ হয়েছিলেন তাঁরা...
বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক জন মুক্তিযোদ্ধার ত্যাগ অনস্বীকার্য। যুদ্ধের প্রতিটি রক্তকণিকার পেছনে রয়েছে একটি গল্প, রক্তমাংসের একজন মানুষের গল্প যিনি হয়তো ছিলেন আমাদের মতোই খুব সাধারণ একজন মানুষ। কিন্তু দেশমাতার প্রয়োজনে পরিবার-পরিজন ফেলে রেখে সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি। তাদের সেই সংগ্রাম বৃথা যায়নি মোটেও। যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতার সূর্য ওঠে বাংলাদেশের দিগন্তে, কিন্তু এদের অনেকেই সেই সূর্যোদয় দেখে যেতে পারেননি। দেশের জন্য আত্মত্যাগী এই বীর শহীদদের মাঝেই রয়েছেন বাংলার বীরশ্রেষ্ঠগণ। দাপ্তরিক ভাষায় বলা যেতে পারে, বীর শ্রেষ্ঠ বীরত্বের জন্য প্রদত্ত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক। যুদ্ধক্ষেত্রে অতুলনীয় সাহস ও আত্মত্যাগের নিদর্শন স্থাপনকারী যোদ্ধার স্বীকৃতিস্বরূপ এই পদক দেয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ সাতজন মুক্তিযোদ্ধাকে এই পদক দেয়া হয়েছে।
বীর শ্রেষ্ঠ পদক প্রাপ্ত সাত জন মুক্তিযোদ্ধা হলেন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ হামিদুর রহমান, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোস্তফা কামাল, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোহাম্মদ রুহুল আমিন, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লাইট লেঃ মতিউর রহমান, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ এবং বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ। তাদের প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধে রেখেছেন এমন অসামান্য অবদান যার জন্য আজো তারা ইতিহাসের পাতায় রয়েছেন অম্লান।
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর
মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ বরিশালের বাবুগঞ্জ থানার রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল মোতালেব হাওলাদার। তিনি ১৯৬৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন এবং ১৯৬৬ তে আই.এস.সি পাশ করার পর বিমান বাহিনীতে যোগদানের চেষ্টা করেন, কিন্তু চোখের অসুবিধা থাকায় ব্যর্থ হন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৮-র ২ জুন তিনি ইঞ্জিনিয়ার্স কোরে কমিশন লাভ করেন।
১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তিনি পাকিস্তানে ১৭৩ নম্বর ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটেলিয়ানে কর্তব্যরত ছিলেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি ছুটে এসেছিলেন পাকিস্তানের দুর্গম এলাকা অতিক্রম করে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখানোর কারণে তাঁকে রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর দখলের দায়িত্ব দেয়া হয়। শহরটি দখলের জন্য সেক্টর কমান্ডার এ.এন.এম. নূরুজ্জামান তিনটি দল গঠন করেন। তার একটি দলের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর আনুমানিক ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়ায় অবস্থান নেন। ১১ ডিসেম্বর সেখানে ভারতীয় বাহিনীর আর্টিলারীর গোলাবর্ষণ করার কথা ছিলো। কিন্তু সেটি হয়নি। পরবর্তী দুইদিন ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর একাধিকবার ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে ব্যার্থ হন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর। পরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়াই শত্রুদের অবস্থানে আক্রমন করবেন। এবং তিনি সেটিই করেন। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বিজয় সুনিশ্চিত করেই তিনি শহীদ হয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরকে চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ আঙিনায় সমাহিত করা হয়।