ব্যাংকিং খাতের জন্য ২০১৩ ছিল চ্যালেঞ্জিং একটি বছর। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও কেলেঙ্কারির ফলে ধস নামে ব্যাংক ব্যবসায়। বছর শেষে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ বাড়লেও ঋণনীতিমালায় ছাড়ের সুযোগে মুনাফার মুখ দেখে খাতটি। তার পরও হ্রাস পায় কয়েকটি ব্যাংকের মুনাফা। এ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও এগিয়ে থাকা ১০টি ব্যাংকের একটি তালিকা করেছে বণিক বার্তা। দেশের ২৯টি বেসরকারি ব্যাংকের ২০১৩ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে সাতটি মানদণ্ড এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। তালিকার প্রথমেই রয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে যথাক্রমে সাউথইস্ট ও ইস্টার্ন ব্যাংক।
সাতটি সূচক নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনের মোট পয়েন্ট ৭০। তবে এর অর্ধেক পয়েন্টও অর্জন করতে পারেনি কোনো ব্যাংক। শীর্ষস্থান পাওয়া ব্যাংক ডাচ্-বাংলার অর্জন ৩৩ দশমিক ৮২ পয়েন্ট। ৩০-এর উপরে পয়েন্ট রয়েছে আর মাত্র চারটির। এতেই বোঝা যায়, গেল বছর কতটা চাপে ছিল খাতটি।
তালিকা প্রণয়নে যে সাতটি সূচক অনুসরণ করা হয়েছে সেগুলো হলো— সম্পদের বিপরীতে আয় (রিটার্ন অন অ্যাসেট বা আরওএ), শেয়ারহোল্ডারদের মালিকানার বিপরীতে আয় (রিটার্ন অন ইকুইটি বা আরওই), শ্রেণীকৃত ঋণ (এনপিএল) অনুপাত, শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস), শেয়ারপ্রতি নেট সম্পদমূল্য (এনএভি), মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত (ক্যাপিটাল অ্যাডেকোয়েসি রেশিও বা সিএআর) ও শাখাপ্রতি পরিচালন মুনাফা (ওপিবি)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান খান এ মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন, ব্যাংকের মূল্যায়ন এর মাধ্যমে শতভাগ না হলেও এটা এক ধরনের গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ব্যাংকের মূল্যায়ন করলে সেরা তালিকা বের হয়ে আসে।
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ২০১৩ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন থেকে সাতটি সূচকের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। শীর্ষ ব্যাংক নির্বাচনের ক্ষেত্রে কেপিএমজি, আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়ং ও পিডব্লিউসির মতো শীর্ষ গবেষণা ও নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরির যে পদ্ধতি, তা অনুসরণ করা হয়েছে।
বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রতিটি সূচকের ভিত্তিমান সর্বোচ্চ ১০ পয়েন্ট ধরা হয়। প্রতিটি সূচকেই নির্দিষ্ট মান নির্ধারণের ভিত্তিতে পয়েন্ট হিসাব করা হয়েছে। যেমন আরওই ৩০ শতাংশ বা তার বেশি হলে তার জন্য ১০ পয়েন্ট ধরা হয়। এভাবে আনুপাতিক হারে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের প্রাপ্ত মানের ওপর পয়েন্ট হিসাব করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের আরওই ১৭। এতে সূচকে ব্যাংকটির প্রাপ্ত মান দাঁড়ায় (১৭–১০—৩০) বা ৫ দশমিক ৬৭ পয়েন্ট। অন্য সূচকগুলোয় একইভাবে পয়েন্ট ধরা হয়েছে। অন্যান্য সূচকের সর্বোচ্চ পয়েন্ট ধরার ক্ষেত্রে মানদণ্ড হলো— আরওএ ৫, এনপিএল ১, সিএআর ২০ শতাংশ, ইপিএস ১৫ টাকা, শেয়ারপ্রতি এনএভি ১০০ টাকা ও শাখাপ্রতি পরিচালন মুনাফার ক্ষেত্রে ১০ কোটি টাকা। পরে সাতটি সূচকে মোট ৭০ পয়েন্টের মধ্যে ব্যাংকগুলোর প্রাপ্ত মানের ভিত্তিতে শীর্ষ ১০ ব্যাংক নির্বাচন করা হয়।
২০১৩ সালের বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের অবস্থান প্রথম। তারা পেয়েছে ৩৩ দশমিক ৮২ পয়েন্ট। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ২০০ কোটি টাকা, যা অন্যান্য ব্যাংকের চেয়ে তুলনামূলক কম। এতে ব্যাংকটির ইপিএস, শেয়ারপ্রতি এনএভি এসব ক্ষেত্রে ভালো অবস্থান রয়েছে, যা ব্যাংকটিকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে দিয়েছে।
দ্বিতীয় স্থানে থাকা সাউথইস্ট ব্যাংকের অর্জন ৩২ দশমিক ২৩ পয়েন্ট। রিটার্ন অন অ্যাসেট, মূলধন পর্যাপ্ততা ও শাখাপ্রতি পরিচালন মুনাফায় এগিয়ে গেছে ব্যাংকটি। এ বিষয়ে কথা বলতে ব্যাংকটির এমডির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে ব্যাংকটির জ্যেষ্ঠ পরামর্শক মুরশিদ কুলী খান বলেন, ‘সম্পদ ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে করার ফলেই আমরা এ অবস্থায় এসেছি। পরিচালনা পর্ষদও অযাচিত হস্তক্ষেপ না করে সময়োপযোগী বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছে। ফলে বিভিন্ন ঝুঁকি থেকে ব্যাংকটি রক্ষা পেয়েছে।’
তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ২০১৩ সালে শাখাপ্রতি সবচয়ে বেশি মুনাফা করা ইস্টার্ন ব্যাংক। তারা অর্জন করেছে ৩০ দশমিক ৯২ পয়েন্ট। শাখাপ্রতি মুনাফা, মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত ও বাকি সূচকের গড় ব্যাংকটিকে তৃতীয় অবস্থানে এনেছে। গেল বছর বণিক বার্তার বিশ্লেষণে ইস্টার্ন ব্যাংক ছিল দ্বিতীয় স্থানে। এ হিসাবে এবার একধাপ পিছিয়েছে ব্যাংকটি।
৩০ দশমিক ৪ পয়েন্ট নিয়ে তালিকার চতুর্থ স্থানে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। গেল বছর এ তালিকায় ব্যাংকটি ছিল তৃতীয় অবস্থানে। এ হিসাবে ইসলামী ব্যাংকও একধাপ পিছিয়েছে। মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত ও রিটার্ন অন ইকুইটি ব্যাংকটিকে এগিয়ে রেখেছে।
ইসলামী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ আবদুল মান্নান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি নীতিমালা মেনে সময়োপযোগীভাবে ব্যাংকটি পরিচালনার। বড় গ্রাহকদের দিকে না ঝুঁকে ছোট গ্রাহকদের বেছে নিচ্ছি আমরা। এভাবে ঝুঁকি বহুমুখীকরণের মাধ্যমে ব্যাংকটিকে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।’
মার্কেন্টাইল ব্যাংক রয়েছে তালিকার পঞ্চম অবস্থানে। বণিক বার্তার বিশ্লেষণে তাদের অর্জন ২৯ দশমিক ৪২ পয়েন্ট। রিটার্ন অন অ্যাসেট ও শাখাপ্রতি মুনাফা ব্যাংকটির ভালো ছিল, যা তাদের শীর্ষ দশে জায়গা পেতে সহায়তা করেছে।
ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা মণীন্দ্র কুমার নাথ এ বিষয়ে বলেন, ‘প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা সঠিকভাবে ব্যাংকিংয়ের চেষ্টা করেছি। ব্যাংকের ভিত্তি আরো মজবুত করতে চলতি বছর ৩০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করা হচ্ছে। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে বিশেষ উদ্যোগের পাশাপাশি সব শাখাকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা আরো এগিয়ে যেতে চাই।’
ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে আইএফআইসি। ব্যাংকটি পেয়েছে ২৭ দশমিক ৩২ পয়েন্ট। আইএফআইসির এমডি শাহ আলম সারওয়ার বলেন, ‘আমরা খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার জন্য নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়েছি। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার দিকে জোর দেয়া হয়েছে। এমন ঋণ দেয়া হয়নি, যা মন্দ হয়ে যেতে পারে। আমরা ব্যাংকটিকে উন্নতির দিকে নিতে না পারলেও খারাপের দিকে নিতে চাই না। ব্যবসা বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যাংকটির ভিত্তি শক্তিশালী করার জন্য নতুন নতুন কৌশল নেয়া হচ্ছে।’
সপ্তম অবস্থানে রয়েছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল)। ব্যাংকটি ২০১৩ সালের জন্য পয়েন্ট পেয়েছে ২৬ দশমিক ৩৭। ইউসিবিএলের এমডি মোহাম্মদ আলী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা করপোরেট ব্যবসা থেকে সরে গিয়ে এসএমই প্রধান ব্যাংক হতে যাচ্ছি। রফতানি, শিল্পঋণ, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দিকে জোর দিচ্ছি। এসব কারণে গ্লোবাল ফিন্যান্স দেশসেরা ব্যাংক হিসেবে আমাদের রেটিং করেছে।’
অষ্টম অবস্থানে থাকা ঢাকা ব্যাংক পেয়েছে ২৬ দশমিক ৩৪ পয়েন্ট। তালিকায় ২৫ দশমিক ৮২ পয়েন্ট পেয়ে নবম অবস্থানে রয়েছে এক্সিম ব্যাংক। আর ২৫ দশমিক ২৬ পয়েন্ট পেয়ে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক রয়েছে দশম স্থানে।
সূচকের পয়েন্ট নির্ণয় নমুনা: মানদণ্ড নিয়ে সূচকের পয়েন্ট কীভাবে নির্ণয় হয়েছে, তার একটি নমুনা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের আরওএ ১ দশমিক ২। এক্ষেত্রে ব্যাংকটি এ সূচকে পয়েন্ট অর্জন করে (১.২–১০—৫) বা ২ দশমিক ৪। ব্যাংকটির এনপিএল ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। কোনো ব্যাংকের এনপিএল যত কম, তার অবস্থান তত ভালো প্রকাশ করে। তাই ১ শতাংশ মানদণ্ড ধরে এ সূচকে ব্যাংকটির পয়েন্ট (১–১০—৩.৯২) বা ২ দশমিক ৫৫। এছাড়া ব্যাংকটির অন্য সূচকগুলো যেভাবে নির্ণয় হয়েছে তা হলো, ইপিএস (১০–১০—১৫) বা ৬ দশমিক ৬৭, এনএভি (৬৩.২–১০—১০০) বা ৬ দশমিক ৩২, সিএআর (১৩.৭–১০—২০) বা ৬ দশমিক ৮৫ ও ওপিবি (৩.৩৭–১০—১০) বা ৩ দশমিক ৩৭ পয়েন্ট।
Source:
http://bd24live.com/details/3703