শুকনো মৌসুমে বিশুদ্ধ পানীয় জলের তীব্র সংকট থাকলেও বর্ষায় আকাশের জলের অপেক্ষায় থাকেন বহু মানুষ। তৃষ্ণা মেটানোর সঙ্গে আবার চলে জল জমানোর ধুম। যে যেভাবে পারছেন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখছেন। বাড়ির ছাদে বড় ড্রামে, ঘরের কোণে বসানো মটকায় (মাটির বড় পাত্র), পানির বড় ট্যাঙ্কি- সবই কানায় কানায় ভরে উঠছে বৃষ্টির জলে।
বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটের এলাকা হিসাবে পরিচিত বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের অবস্থা এখন এমনই। সরেজমিন ঘুরে প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই চোখে পড়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের নানা আয়োজন। এ জন্য বর্ষাকে সামনে রেখে নতুন পাত্র সংগ্রহ করেন এই এলাকার পরিবারগুলো।
বর্ষাকালে প্রতিদিনের পানির চাহিদা মেটানো হয় বৃষ্টির পানি থেকেই। আর এ সময়ে এলাকার মানুষ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করেন আরও কিছুদিন বিশুদ্ধ খাবার পানির চাহিদা মেটাতে। ঠিক যেমনটা ধান-চাল মজুত করা হয়।
মোরেলগঞ্জের সন্যাসী, খাউলিয়া, গাবতলাসহ বিভিন্ন গ্রামে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের দৃশ্য সরেজমিনে দেখে এসেছে বাংলানিউজ। বাড়ির ছাদে বসেছে নতুন পানি ট্যাঙ্কি। পানি ধরার জন্য ঘরের চালার সঙ্গে রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। যতোটা সম্ভব বেশি পানি সংরক্ষণের চেষ্টা রয়েছে সবারই। যতো বেশি পানি ধরে রাখা যাবে, ততোটা বেশি সময় পানি সংগ্রহের চিন্তা থাকবে না তাদের। জানালেন এলাকার লোকজন।
খাউলিয়া ইউনিয়নের পূর্ব বরিশাল গ্রামের আবদুস সালাম খান বলেন, বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি দৈনন্দিন খাবার পানির চাহিদা মেটায়। বর্ষা শেষ হলে শুরু হয় খাবার পানির সংকট। সে জন্যে কয়েকটি ড্রামে পানি ধরে রাখার চেষ্টা করেন মানুষ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, আবুল কালাম, আরতি রানী, আবদুস সোবাহানসহ আরও অনেকে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে শুকনো মৌসুমের সংকট মোকাবেলার চেষ্টা
করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, এ এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট দীর্ঘদিনের। বর্ষায় জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকে গ্রামের পর গ্রাম। আর শুকনোয় একফোটা খাবারের পানি পাওয়া যায় না। শুকনো মৌসুমে কাউকে একবেলা ভাত খাওয়ানোর চেয়েও এক গ্লাস পানি পান করাতে বেশি কষ্ট হয় এই এলাকার মানুষের। ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার পর এ এলাকার পানির আধার আরও সংকুচিত হয়ে এসেছে বলেও জানালেন স্থানীয় লোকজন।
সূত্র বলছে, মার্চ-এপ্রিলে শুকনো মৌসুমে এ এলাকায় পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। এরপর বর্ষা এলে পানি ধরে রেখে কয়েক মাস সংকট মেটানো হয়। সব মিলিয়ে মোটামুটি ৬-৭ মাস কোনোভাবে খাবার পানি সংগ্রহের ব্যবস্থা হয়। বাকি সময়ে সংকট থাকে তীব্র। ফলে বহু মানুষ সরাসরি পুকুর ও নদীর পানি পান করেন। দেখা দেয় পানিবাহিত রোগ।
পানি সরবরাহের জন্য জনস্বাস্থ্য বিভাগের স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) রয়েছে। এর মাধ্যমে পুকুরের পানি পরিশোধন করে স্থানীয়রা ব্যবহার করতে পারেন। কিছু এলাকায় আবার পরিশোধিত পানি পাইপের সাহায্যে সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এর আওতায় আসছেন খুবই কম সংখ্যক মানুষ। অন্যদিকে পিএসএফ চালিয়ে রাখার জন্য রিজার্ভ পুকুরের সংখ্যাও যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি বহু পিএসএফ অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেলো, সন্যাসী বাজারের কাছে মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের পুকুরের সঙ্গে সংযুক্ত পিএসএফটি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো পড়ে আছে। অথচ এই পুকুরের পানির ওপর নির্ভরশীল ৬-৭ গ্রামের মানুষ। শুকনো মৌসুমে পুকুরে হাঁটু পানি থাকে। নিরূপায় হয়ে সেই কাদাপানি কলসি ভরে নিয়ে যান
বহু মানুষ।
খাউলিয়া ইউনিয়নের দু’টি ওয়ার্ডে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহসহ সংশ্লিষ্ট আরও কিছু বিষয়ে কাজ করছে সিসিডিবি নামের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে, এলাকার মানুষকে জলবায়ু সহনশীল হড়ে তোলা। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে মানিয়ে নিতে সহায়তা করছে এ প্রকল্প। কাজের মধ্যে একটি হচ্ছে, সুষ্ঠুভাবে পানি সংরক্ষণে সহায়তা করা। কমিউনিটিকে দেওয়া হচ্ছে পানির ট্যাঙ্কি।
সিসিডিবি’র মোরেলগঞ্জ উপজেলা কো-অর্ডিনেটর আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, এ এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট ভয়াবহ। পিএসএফ ও পুকুরগুলোর ভালো ব্যবস্থাপনাও নেই। এগুলো যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে মানুষের পানির কষ্ট কিছুটা লাঘব হতে পারতো। আমরা কমিউনিটি পর্যায়ে পানি সংরক্ষণের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করছি। অনেকে পানি সংরক্ষণের কৌশল শিখেছেন।
জনস্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র বলছে, মোরেলগঞ্জ এলাকায় প্রথমত লবণাক্ত পানি, দ্বিতীয়ত গভীর নলকূপ সফল নয়। পুকুরের পানি, পিএসএফ পরিশোধিত পানি ও বৃষ্টির পানির ওপরই মানুষকে নির্ভর করতে হয়। এ কারণে পানির সংকট লেগেই থাকে। তবে পানির সংকট লাঘবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় সরকারের এ বিভাগ।
মোরেলগঞ্জ উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আমজাদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, সরকার ও এনজিওরা মিলে এখানকার পানি সংকট মোকাবেলার চেষ্টা করছে। প্রতি বছর নতুন পিএসএফ বসানো হচ্ছে, পুকুর খনন করা হচ্ছে, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। - See more at:
http://www.banglanews24.com/beta/fullnews/bn/308124.html#sthash.k1sYi8FN.dpuf