খ্রিস্টপূর্ব ৮০২ সালের আগের কথা। সে সময় কম্পোডিয়া ও তার আশপাশের দেশগুলোকে একত্রে কম্বুজা বলা হতো। তখন কম্বুজা জাভা দ্বীপের স¤্রাটের শাসনাধীন ছিল। আর জাভা হলো ইন্দোনেশিয়ার একটি দ্বীপ। জয়বর্মন জাভার রাজার কাছ থেকে কম্বুজাকে দখল করে নেন। তারপর সেখানে এক নতুন সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেনÑ গোড়াপত্তন করেন এক নতুন শহরের। যার নাম অ্যাংকর। অ্যাংকর একটা খেমার শব্দ। বাংলায় যার অর্থ হলো পবিত্র শহর। রাজা হয়েই তিনি ‘দেবরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেন। দেবরাজ বা জয়বর্মন প্রতিষ্ঠিত এ রাজবংশই পরবর্তীতে খমের বা খেমার নামে পরিচিতি লাভ করে। এ রাজবংশ নবম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল। এই খেমাররা মিয়ানমারের (বার্মা) পশ্চিম থেকে ভিয়েতনামের পূর্বাংশ পর্যন্ত শাসন করত। আর খেমার সা¤্রাজ্যের রাজধানী ছিল এই অ্যাংকর। সে সময় অ্যাংকর ছিল সবচেয়ে অভিজাত ও সমৃদ্ধ নগরগুলোর একটি। আয়তনে বিশার এ নগরীতে সে সময় প্রায় সাড়ে সাত লাখ লোক বাস করত। বহু বছর ধরে সমৃদ্ধ নগরী অ্যাংকরের প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় ছিল।
১৪৩১ খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যার রাজা অ্যাংকর নগরটি দখল করে তা ধ্বংস করে ফেলেন। অ্যাংকরের বিলুপ্ত হওয়ার কাহিনী এখনো এক বিশাল রহস্যময় হয়ে আছে। খেমার রাজারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তারা বহু হিন্দু মন্দির ও অনেক আকর্ষণীয় ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। এগুলোর মধ্যে একটি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী, যেনো একটা ফুটন্ত পদ্মের মতো। এ মন্দিরগুলোর মধ্যে অ্যাংকর ওয়াত ছিল সবচেয়ে বিখ্যাত। রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মন এ মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। মন্দিরটি এখনো টিকে আছে। তারা মন্দিরগুলোর দেয়ালের গায়ে অদ্ভুত সব মূর্তি খোদাই করেছিল। ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীর দিকে অ্যাংকর শহরে থেরাভাদা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। অন্যদিকে হিন্দুদের সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকে। এর ফলে অ্যাংকরের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের ওপরও বৌদ্ধদের প্রভাব বাড়তে থাকে। তাতে অবশ্য কারোর বিরুদ্ধে কারো অভিযোগ ছিল না, ছিল না কারোর সাথে কারো কোনো শত্রুতা। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাম্যের নীতির কারণে। হিন্দু সম্প্রদায় ৪টি শ্রেণিতে বিভক্ত। যথাÑ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। চার সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রাহ্মণদের প্রভাব প্রতিপত্তি সবচাইতে বেশি, তারপর ক্ষত্রিয়দের। বৈশ্যদের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল আরও কম। আর শূদ্ররা ছিল একেবারেই অবহেলিত। কিন্তু বৌদ্ধধর্মে বর্ণভেদ নেই, সবাই সমান। এর ফলে অ্যাংকর স¤্রাটদের প্রভাব প্রতিপত্তি ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। অনেক গবেষকের মতে, ধর্মীয় রীতিনীতির বদল হওয়াতেই এক সময় অ্যাংকরে সামাজিক ও রাজনৈতিক কলহ ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। যা পরবর্তীকালে অ্যাংকরের সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। অ্যাংকরের পতনের এটাও একটা কারণ ছিল। অ্যাংকরের পশ্চিমে ছিল অযোধ্যা রাজ্য আর পূর্বে ছিল চম্পা রাজা। এ দু’রাজ্যই অ্যাংকরের শত্রু ছিল। সর্বদা তারা ক্ষমতার জন্য একে অন্যের সাথে লড়াই করত। অনেকের ধারণা, এ যুদ্ধ কলহ ও ধর্মীয় বিবাদ অ্যাংকরের পতনের জন্য বিশেষভাবে দায়ী ছিল।
আর ষেড়শ শতকে উত্তর-পূর্ব এশিয়া ও চীনের মধ্যে একটা ‘সমুদ্র চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়Ñ যা এ সমৃদ্ধ সভ্যতাকে আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। অ্যাংকর নগরীর সমৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল সেখানকার জলব্যবস্থা। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছিল এর নালা, খাল-বিলগুলো। শুষ্ক মওসুমে চাষাবাদের জন্য খাল-বিলগুলোকে ব্যবহার করা হতো পানি বয়ে নিয়ে আনার জন্য, আর বর্ষা মওসুমে ব্যবহার করা হতো অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়ার জন্য। তবে ক্রমশ অ্যাংকরের অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। নগরটির জলব্যবস্থাও ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়তে থাকে। এক দিকে নগরটির অভ্যন্তরীণ সমস্যা, পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে যুদ্ধাবস্থা এবং অন্যদিকে প্রকৃতির বিরূপ আচরণ অ্যাংকরের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হয়ে পড়ল। ত্রয়োদশ শতকে ইউরোপে প্রচ- বরফ পড়তে থাকে।
এই সময়টাকে বলা হয় ‘লিটল আইস এজ’, বাংলায় বললে ক্ষুদ্র বরফ যুগ। এশিয়াতেও এর প্রভাব পড়ে। চলতে থাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ সময় খেমারদের প্রভাব প্রতিপত্তিও কমতে শুরু করে। ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিকে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে খেমাররাজ অযোধ্যারাজের কাছে পরাজিত হয়। ১৪৩১ সালে অযোধ্যার রাজার কাছে খেমাররাজ চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। অযোধ্যারাজ অ্যাংকর নগরী দখল করে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এভাবে এশিয়ার সমৃদ্ধ নগরী অ্যাংকর ধ্বংস হয়ে গেল। তবে শহরটি এখনো পুরোপুরি হারিয়ে বা ধ্বংস হয়ে যায়নি। নগরটির অনেক স্থাপত্য এখনো টিকে আছে। তবে স্থাপত্যগুলো তিনটি দেশÑ কম্পোডিয়া, থাইল্যান্ড ও লাওসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। স্থাপত্যগুলোর বেশিরভাগই মন্দির। অধিকাংশ মন্দিরগুলো কম্বোডিয়া আর থাইল্যান্ডে অবস্থিত। কিছু মন্দির আছে লাওসে।
By: এম এস শহিদ ||