ফেনিল, নীল, অনন্ত সমুদ্র! উভয় পার্শ্বে যতদূর চক্ষু যায়, ততদূর পর্যন্ত তরঙ্গভঙ্গপ্রক্ষিপ্ত ফেনার রেখা; স্তূপীকৃত বিমল কুসুমদামগ্রথিত মালার ন্যায় সে ধবল ফেনরেখা হেমকান্ত সৈকতে ন্যস্ত হইয়াছে; কাননকুন্তলা ধরণীর উপযুক্ত অলকাভরণ। নীলজলম-লমধ্যে সহ¯্র স্থানেও সফেন তরঙ্গভঙ্গ হইতেছিল।” সত্যিই “অনন্তবিস্তার নীলাম্বুম-ল” এই সমুদ্রের “জলধিশোভা দৃষ্টি” করলে বঙ্কিমচন্দ্রের নবকুমারের মতো সবারই “পরিমাণবোধ-রহিত” হতে বাধ্য। যুগে যুগে মানুষ অপার বিস্ময়ে সমুদ্রের মুখোমুখি হয়েছে। ভেবেছে এই জলরাশির ওপারে কী আছে? মধ্য এশিয়ার আদি মানুষ তাই হয়তো যখন দেখল এই বিশাল জলরাশির ওপর একটি বড় পাতায় বসে একটি পাখি বা পোকা ভাসতে ভাসতে চলেছে তখন সে প্যাপিরাসের নৌকা বানিয়ে পাড়ি দিল সমুদ্রে। সেই খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে এশিয়া মাইনরের গ্রীক বৈজ্ঞানিকেরা বিশ্বব্রহ্মা- সৃষ্টির প্রাচীন পৌরাণিক ব্যাখ্যা পরিত্যাগ করে প্রাকৃতিক কার্যকারণের দিকে মন দিলেন এবং অ্যারিস্টটল (খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২) তার মেটিওরলজিকা’ রচনায় লিপিবদ্ধ করলেন সমুদ্রের উদ্ভবের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। ঐতিহাসিক যুগ ধরেই মানুষ তার চারপাশের এই অনন্ত সমুদ্রকে জানতে চেয়েছে, বুঝতে চেয়েছে, জয় করতে চেয়েছে। মধ্যযুগে সমুদ্রের লবণতা এবং জোয়ারভাঁটা নিয়ে ভাবনাচিন্তার পর পঞ্চদশ শতাব্দীতে কুসানার্স-এর “দ্য ইডিয়ট” রচনায় দেখি সীসের টুকরোর সাহায্যে সমুদ্রের গভীরতা মাপার উল্লেখ, ১৯৩২ সালে চার্লস ডারউইনের ‘বিগল’ জাহাজে অভিযান এবং ১৮৭২-৭৬ সালে পৃথিবীর প্রথম সংগঠিত সমুদ্রবিজ্ঞান সমীক্ষাÑ ‘চ্যালেঞ্জার’ অভিযান।এর “অনন্তবিস্তার নীলাম্বুম-ল”-এর শুধুমাত্র “জলধিশোভা দৃষ্টি”-এর শুধুমাত্র “জলধিশোভা দৃষ্টি” করে মানুষ ক্ষান্ত থাকছে না সমুদ্রের আনাচে কানাচে কী আছে জানার জন্য জাহাজ থেকে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে আধুনিক সব যন্ত্রপাতি, সাবমারসিবল রোবট, এমন কি মহাকাশ থেকে উপগ্রহের মাধ্যমে তুলে চলেছে এই অপার রহস্যের ছবি।
মানবসভ্যতার অগ্রগতি নির্ভর করে মূলত খাদ্যের উৎপাদন, খনিজ সম্পদের উৎপাদন ও ব্যবহার এবং শক্তির যোগানের উপর। এই তিনটি ক্ষেত্রই একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত এবং নির্ভরশীল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি এবং তার সঙ্গে জনসংখ্যার বৃদ্ধির ফলে কাঁচামালের চাহিদা বেড়েই চলেছে। হিসেব বলছে, ২০০০ সালে এই চাহিদা আজকের তুলনায় শতকরা ৪০০ ভাগ বেড়ে যাবে। তবে এটা নিশ্চিত যে, আগামী ৫০ বছরে পৃথিবীর স্থলভাগের বেশীরভাগ সম্পদই শেষ হয়ে যাবে। তখন সমুদ্রই একমাত্র ভরসা। অপেক্ষাকৃত নবীন বিজ্ঞান, সমুদ্রবিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে সমুদ্রের জলে এবং সমুদ্রের নিচে ভূস্তরে যে প্রভূত সম্পদের সম্ভাবনার কথা মানুষ জানতে পারছে, তার ফলে সে আশান্বিত। তাই আজ মানুষ সমুদ্রের দিকে চোখ ফিরিয়েছে। ফেরাবে না-ই বা কেন! ভূপৃষ্ঠের দুই-তৃতীয়াংশই তো পানি। এত পানি যে যদি পৃথিবীর সব পাহাড়-পর্বত ভেঙে গুঁড়িয়ে সমান করে ফেলা যায়, তাহলেও গোটা পৃথিবী কয়েক হাজার মিটার জলে ডুবে থাকবে। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পাহাড় এভারেস্টকে সমুদ্রের নিচে সবচেয়ে গভীর খাত ‘মারিয়ানা ট্রেঞ্চ’-এ ঢুকিয়ে দিলেও তার চূড়া অন্তত এক কিলোমিটার জলের নিচে থাকবে।
কিন্তু আজকের এই জল-ডাঙার পরিস্থিতি তো আর পৃথিবীর জন্মের সময় একই রকম ছিল না বা কোটি কোটি বছর পরে একই থাকবে না। ভূতাত্ত্বিক যুগ ধরেই ভাঙাগড়ার খেলা চলছে। কোথাও নতুন সমুদ্রের সৃষ্টি হচ্ছে, কোথাও নতুন পর্বতমালার। এককালের টেথিস সমুদ্র, সেখানে দাঁড়িয়ে আজকের বিশাল হিমালয়। সেই হিমালয়ও একটু একটু করে বাড়ছে। ভূমধ্যসাগর ক্রমশ ছোট হচ্ছে। বর্তমানে প্রশান্ত মহাসাগর যদি তার অবলুপ্তির প্রথম স্তরে রয়েছে, তো আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর রয়েছে পূর্ণতার শেষ ধাপে। আর্কটিক, এডেন উপসাগর এবং লোহিত সাগর রয়েছে সমুদ্রগঠনের প্রথম স্তরে। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে যে ২ কোটি বছর আগে যখন আফ্রিকা ও আরব পরস্পর থেকে দূরে সরতে শুরু করেছে, তখনই এডেন উপসাগর এবং লোহিত সাগরের সৃষ্টি। অন্যভাবে বললে, আজ পৃথিবীর সমুদ্রের নিচে যে ভূস্তরে খনিজের সন্ধান চলছে, তা হয়তো বহুযুগ আগে ছিল সমুদ্রের উপরে। তাই এই ভাঙাগড়ার খেলাটিকে ভালভাবে বোঝা দরকার। পৃথিবীর অভ্যন্তর বা ভূস্তরের এই নড়াচড়ারই ভূতাত্ত্বিক নাম “টেকটনিকস”।
প্লেট টেকটনিকস : পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে তাকালে মহাদেশগুলির তটরেখার আশ্চর্য মিল চোখে পড়বে। যেমন, দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরপূর্বের বেরিয়ে আসা অংশটি কী সুন্দরভাবে আফ্রিকার পশ্চিমের খাঁজটিতে ঢুকে যায়। এই শতকের শুরুতে জার্মান বিজ্ঞানী ওয়েগনার এই মিল এবং অন্যান্য ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ এবং জীবাশ্মের মিলের ভিত্তিতে “মহীসঞ্চরণ” বা “মহাদেশের সঞ্চরণ” তত্ত্ব খাড়া করেন। তার মতে প্রায় ৩০ কোটি বছর আগে আজকের সব মহাদেশগুলি একসঙ্গে জোড়া ছিল। বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছেন ‘প্যানগিয়া’। ২৫ কোটি বছর আগে উত্তর মহাদেশ বা “লরেসিয়া’ ছিল ইউরোপ, এশিয়া, উত্তর আমেরিকা এবং গ্রীনল্যান্ডকে নিয়ে; আর দক্ষিণ মহাদেশ বা ‘গ-োয়ানা’ ছিল ভারত, দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ম্যাডাগাসকার, অ্যান্টার্কটিকা এবং অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে। পুরাচুম্বকত্ব তথ্যের মাধ্যমে বলা হচ্ছে যে গন্ডোয়ানাল্যান্ডে অভ্যন্তরীণ নড়াচড়া শুরু হয়েছে প্রায় ২০ কোটি বছর আগে। আজ থেকে ৬ কোটি এবং আড়াই কোটি বছর আগে সময়টিতে (হিমালয়ের গঠনকাল) ভারত অন্তত ৫৫০০ কিলোমিটার, অর্থাৎ বছরে ১১ সেন্টিমিটার করে, সরেছে বলে হিসেব করা হয়। কিন্তু মহাদেশগুলির এই চলাফেরা কি একটি যুগেই সীমাবদ্ধ? প্যানগিয়ার আগে? সমুদ্রগুলি কি স্থির? চলাফেরার চালিকাশক্তিই বা কি?
ওয়েগনারের ঐতিহাসিক তত্ত্বের পথ বেয়েই এই শতকের মাঝামাঝি এল ‘প্লেট টেকটনিকস তত্ত্ব।’ আমরা জানি কম্পনতরঙ্গের তিনটি পর্যায় অনুযায়ী পৃথিবীকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়। সবচেয়ে উপরের স্তর ভূত্বক (ঈৎঁংঃ), যার গড়গভীরতা ৪০ কিলোমিটার; মধ্যবর্তী স্তর ম্যানেটেল (গধহঃষব), যার গড় গভীরতা ২৯০০ কিলোমিটার এবং সবচেয়ে নিচের স্তর অন্তঃস্থল (ঈড়ৎব), যা কেন্দ্র পর্যন্ত প্রসারিত। ভূত্বক এবং ম্যান্টেলের উপরিভাগ নিয়ে ১০০ কিলোমিটার পুরু স্তর ‘লিথোস্ফেয়ার’ (এতে সিলিকা ও অ্যালুমিনিয়ামের ভাগ বেশি) এবং তার নিচে ‘এসথেনোস্ফেয়ার’ (এতে সিলিকা ও ম্যাগনেসিয়ামের ভাগ বেশি)। ‘প্লেট টেকটনিকস’ তত্ত্ব লিথোস্ফেয়ারকে অসংখ্য মহাদেশীয় এবং মহাসাগরীয় অংশে ভাগ করেছে যেগুলি কঠিন সচল ‘প্লেট’ হিসেবে নিচের ‘প্লাসটিক’ আধা-তরল এসথেনোস্ফেয়ারের উপর চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। প্লেটের সচলতার ভিত্তিতে মূলত তিন ধরনের সীমানা চিন্তা করা হয়েছে।
১। ‘কাছাকাছি আসা’ (ঈড়হাবৎমবহঃ) প্লেটের সীমানা, যেখানে দুটি চলমান প্লেটের সংঘর্ষে একটি অপরের নিচে ঢুকে গিয়ে (সাবডাকশন) পৃথিবীর গভীরে মিশে যাচ্ছে। মহাদেশের সীমানা এবং আগ্নেয়গিরিজাত দ্বীপগুলি এই এলাকাভুক্ত।
২। ‘দূরে সরে যাওয়া’ (উরাবৎমবহঃ) প্লেটের সীমানা, যেখানে দুটি একে অপর থেকে দূরে সরে যাওয়ায় ‘সমুদ্রতল ছড়ানো’র (ঝবধভষড়ড়ৎ ঝঢ়ৎবধফরহম) ফলে নতুন লিথোস্ফেয়ার যুক্ত হচ্ছে। এগুলি নতুন সমুদ্রসৃষ্টির এলাকা।
৩। ‘সমান্তরাল” (ঢ়ধৎধষষবষ) প্লেটের সীমানা, যেখানে দুটি প্লেট পাশাপাশি চলেছে।
পৃথিবীর অজৈব খনিজ সম্পদের অবস্থান, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি ইত্যাদি সবই প্লেটের এই নড়াচড়ার সঙ্গে যুক্ত। জাপানের বিখ্যাত কুরোকো খনিজভা-ার, ফিলিপাইনস-এর তামার ভা-ার এবং আলাস্কা, কানাডা, ব্রাজিল, রডেসিয়া প্রভৃতির সোনার ভা-ারগুলি ‘কাছাকাছি আসা’ প্লেট সীমানার সঙ্গে যুক্ত। ‘দূরে সরে যাওয়া’ প্লেটের সীমানার প্রকৃষ্ট উদাহারণ হল আফ্রিকা ও ইউরেশিয়া প্লেটের মাঝামাঝি লোহিতসাগর এবং গভীর সমুদ্রের মাঝখানের দীর্ঘ পবর্তমালার অর্থাৎ ৮৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ মধ্যসামুদ্রিক পর্বতশিরা। সত্তরের দশকেই লোহিত সাগরের ঠিক মাঝখানে ২০০০ মিটার গভীরে ৭০ কিলোমিটার এলাকাব্যাপী সমুদ্রের নিচে ধাতব সালফাইডের সবচেয়ে বড় ভা-ারের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এই দুটি এলাকাই খনিজ তেলের ভা-ারের উপযোগী এলাকা। তাই সমুদ্রসম্পদ সমীক্ষার ক্ষেত্রে প্লেটগুলির গতিবিধি এবং ক্রিয়াপ্রক্রিয়া ভালভাবে বোঝা একান্ত প্রয়োজন। বর্তমান সমুদ্রবিজ্ঞানের বড় এক হাতিয়ার হল কৃত্রিম উপগ্রহ ‘সীস্যাট’ দ্বারা সংগৃহীত পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রের ছবি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক গবেষণা জাহাজ, আধুনিক যন্ত্রপাতি, সাবমেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কম্পিউটার।
সমুদ্রতলের ভূ আকৃতি :
সমদ্রের সম্পদের কথা বলার আগে সমুদ্রের নিচের অবস্থাটা জেনে নেয়া ভাল। অর্থাৎ সমুদ্রের সব জল শুষে নিলে নিচের ভূÑআকৃতি কী রকম হবে। সমুদ্রতলের আকৃতিকে মূল দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।
১) মহাদেশীয় উপান্ত (ঈড়হঃরহবহঃধষ গধৎমরহং) : ক) উপকূলবর্তী এলাকা (ঈড়ধংঃধষ অৎবধং), খ) মহাদেশীয় ধাপ বা মহীসোপান (ঈড়হঃরহবহঃধষ ঝযবষভ), গ) মহাদেশীয় ঢাল (ঈড়হঃরহবহঃধষ ঝষড়ঢ়ব), ঘ) মহাদেশীয় স্ফীতি (ঈড়হঃরহবহঃধষ জরংব)।
২) সামুদ্রিক অববাহিকা : ক) নিতলীয় তল খ) সামুদ্রকি স্ফীতি), গ) সামুদ্রিক পর্বতশিরা খ) খাত ঙ) সামুদ্রিক টিলা বা গায়টস।
উপকূলবর্তী এলাকায় তীর বরাবর রয়েছে পশ্চাৎতট, অগ্রতট এবং নিকটতট এলাকা। সর্বোচ্চ জোয়ারেরও ওপরে রয়েছে পশ্চাৎতট।
অগ্রতট এলাকা হল জোয়ার ও ভাটার মধ্যবর্তী এলাকা। নিকটতট এলাকায় এসে ঢেউ ভাঙে। এরপরই সমুদ্রের অপতট এলাকা।
মহীসোপান হল পার্শ্ববর্তী মহাদেশের সেই অংশ যা সমুদ্রের নিচে চলে গিয়েছে খুবই সামান্য ঢাল বজায় রেখে। মহীসোপান কয়েক কিলোমিটার থেকে শুরু করে ৪০০ কিলোমিটারও হতে পারে। ভারতের পূর্ব উপকূলে মহীসোপান খুবই সরু। সব সমুদ্রের মহীসোপান সমুদ্রের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ তা সামুদ্রিক খাদ্যের শতকরা ৯০ ভাগ, পৃথিবীর তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের শতকরা ২০ ভাগ এবং প্রচুর পরিমাণে হীরে, টিন, সোনা, মোনাজাইট ইত্যাদি স্থাপন খনিজ অবক্ষেপের যোগান দেয়।
মহীসোপানের প্রান্তে এসে গভীরতা হঠাৎ ১০০-২০০ মিটার থেকে ১৫০০-৩৫০০ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যায় এবং গড়ে ৪ ডিগ্রির মতো ঢাল সৃষ্টি হয়। মহাদেশীয় ঢাল অঞ্চল খুবই সরু। প্রশান্ত মহাসাগরের গড় ঢাল ৫০২র্০। আটলান্টিকে ৩০০র্৫ এবং ভারত মহাসাগরে ২০৫৫। মহাদেশীয় ঢাল এলাকার মধ্যে রয়েছে অন্তঃসাগরীয় গিরিখাত ছোট অগভীর অববাহিকা ইত্যাদি। বস্তুত এই ঢালের প্রান্তেই মহাদেশীয় ত্বক এবং মহাসাগরীয় ত্বকের মিলন ঘটেছে।
মহাদেশীয় ঢাল এবং সামুদ্রিক অববাহিকার মধ্যভাগে ১০০ থেকে ১০০০ কিলোমিটার চওড়া মহাদেশীয় স্ফীতি অঞ্চল রয়েছে। এরও একটা সমুদ্রমুখী অল্প ঢাল আছে। এই অঞ্চলে স্থলভূমি থেকে বয়ে এসে বহু কিলোমিটার পুরু পলি জমা হয়। বঙ্গোপসাগরে গঙ্গা ব-দ্বীপের কাছে ‘সোয়াচ-অব-নো গ্রাউন্ড’ নামে গিরিখাত মহীসোপানও ঢাল অ্ঞ্চল পেরিয়ে সব পলিকে নিয়ে জমা করে দেয় গভীর সমুদ্রের নিতলীয় সমভূমিতে। মেক্সিকোতে ছেদন কার্যে এই অঞ্চলে বহু লবণ গম্বুজ এর অস্তিত্ব ধরা পড়েছে।
নিতলীয় তল সঠিক অর্থেই গভীর সমুদ্রে সমুভূমি। তার মাঝে মাঝে রয়েছে পর্বত বা টিলা। পাহাড়গুলো এই সমভূমি থেকে ১০০০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়।
গভীর সমুদ্রতলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গঠন হল পৃথিবীব্যাপী পর্বতমালা বা পর্বত বলয়, যার নাম মধ্য সামুদ্রিক পর্বতশিরা। এগুলি আটলান্টিক এবং ভারত মহাসাগরের মাঝখানে আছে, প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব সীমান্তেও দেখা যায়। এগুলি পৃথিবীর বুকে বততি রেখাÑ যে রেখা বরাবর সামুদ্রিক ত্বক সৃষ্টি হচ্ছে।
খাদ বা ট্রেঞ্চ সাধারণত ৬০০০ মিটারের বেশি গভীর হয়। প্রশান্ত মহাসাগরের মারিয়ানা ট্রেঞ্চ পৃথিবীর গভীরতম খাদÑ সমুদ্রতল থেকে ১১,৫১৫ মিটার গভীর।
সামুদ্রিক টিলাগুলি সমুদ্রতল থেকে ১০০০ মিটারেরও উঁচু আগ্নেয়গিরি। এর চূড়া জল ভেদ করে উঁচুতে উঠলে আগ্নেয়গিরির দ্বীপ তৈরি হয়।
সমুদ্রের সম্পদকে আমরা মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করতে পারি; (১) জৈবসম্পদ বা খাদ্যসম্পদ, (২) অজৈবসম্পদ বা খনিজসম্পদ, (৩) শক্তি উৎপাদনকারী সম্পদ।
জৈবসম্পদ বা খাদ্যসম্পদ :
রাসায়নিক দিক থেকে সমৃদ্ধ সমুদ্রের জলে প্রথম প্রাণের উদ্ভব আনুমানিক ৩৫০ কোটি বছর আগে। তার অনেক পরে, প্রায় ৫০ কোটি বছর পর পৃথিবীর স্থলভাগে ঘটে প্রাণের আবির্ভাব। জীবাশ্ম বা ফসিল থেকে আমরা জানতে পারি প্রথম প্রাণী ছিল সাধারণ কোষবিশিষ্ট ব্যাক্টেরিয়া এবং গাছপালার অন্যতম এলগি। তারাই সমুদ্রে প্রাণের ভিত্তি। বস্তুত এলগি না থাকলে সমুদ্র বন্ধ্যা হয়ে যেত। সবচেয়ে বড় এলগি এক মিলিমিটার ব্যাসের। এক কিউবিক মিটার সমুদ্রজলে ২ লক্ষ এলগি থাকতে পারে। সাধারণভাবে বলতে গেলে তারা খনিজকে শাকসবজিতে পরিণত করে। আবহাওয়া, সমুদ্রের গভীরতা ও অন্যান্য কারণের উপর এলগির বিস্তৃতি নির্ভর করে। লাল, বাদামী, নীল এবং সবুজ-নীল এলগি পাওয়া যায়। তাছাড়া রয়েছে গাছপালা এঞ্জিওস্পার্ম।
পৃথিবীতে কমপক্ষে ২০ লক্ষ বিভিন্ন ধরনের প্রাণী ও উদ্ভিদ আছে। ধরাপৃষ্ঠের দুই-তৃতীয়াংশ জল হলেও, স্থলভাগের তুলনায় কিন্তু সমুদ্রে প্রাণীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। অন্যভাবে বললে পৃথিবীর চারভাগের তিনভাগই মাছেদের দখলে। অফুরন্ত প্রাণের উৎস সমুদ্রের মূল বাসিন্দা মাছেরা হলেও সমুদ্রগর্ভে আছে এককোষী প্রাণী প্লাঙ্কটন থেকে শুরু করে শামুক, পোকা, কাঁকড়া, সরীসৃপ, তিমি পর্যন্ত সর্বস্তরের প্রাণী। মেরুদ-ী প্রাণীদের মধ্যে অগণিত মাছ, তিমি, সীল এবং সাপ সমুদ্রের বাসিন্দা। অমেরুদ-ী প্রাণীদের তো অধিকাংশই সামুদ্রিক জীব। আণুবীক্ষণিক প্লাঙ্কটন খেয়ে প্রাণধারণ করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সামুদ্রিক জীবেরা। ছোটখাটো সামুদ্রিক মাছেরও খাদ্য হচ্ছে প্লাঙ্কটন। পক্ষান্তরে তাদের চেয়ে বড় মাছ ও প্রাণী এইসব ছোট মাছদেরে খায়। স্পঞ্জ, প্রবাল, স্টারফিশ, জেলিফিশÑÑ এসব অমেরুদন্ডী প্রাণী স্থলভাগে একেবারেই দেখা যায় না। অন্যান্য আমেরুদ-ী প্রাণীদের মধ্যে কীটপতঙ্গ, শামুকজাতীয় কোমলাঙ্গ প্রাণী, কঠিন খোলাযুক্ত প্রাণী (কাঁকড়া, গলদা চিংড়ি), যুক্তপদ ও বহুপদ প্রাণীরা) অধিকাংশই সামুদ্রিক জীব।
আজ থেকে প্রায় ২০ কোটি বছর আগে সমুদ্রের জলে মাছেদের কর্তৃত্ব খর্ব হল যখন কিছু শীতল রক্তের প্রাণী, যারা ইতিমধ্যেই চারটি পায়ের অধিকারী হয়েছে, তারা সমুদ্রে ফিরে এল। সরীসৃপরাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে এবং তাদের অন্যতম হল সামুদ্রিক কচ্ছপ (টার্টল)। এরপর কিছু পাখিও সমুদ্রে আস্তানা গাড়লোÑ আজকের পেঙ্গুইন উল্লেখযোগ্য। ৫ কোটি বছর আগে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের প্রতিভূ হিসেবে সমুদ্রে প্রবেশ করলো তিমিদের পূর্বপুরুষ। বহু লক্ষ বছর পরে এল সীল। বর্তমানে পশু সা¤্রাজ্যের সব গোষ্ঠীরই প্রতিনিধিরা সমুদ্রে রয়েছে। এমনকি পোকাওÑ যার কথা আগেই উল্লিখিত হয়েছে। ‘কোয়েলেনট্রাটা’ প্রাথমিক স্তরের আমেরুদ-ী প্রাণী। এদের দেহে রয়েছে শুধু পাকস্থলী এবং কয়েকটি কর্ষিকা। এই শ্রেণীভুক্ত প্রাণী “অ্যানিকোনি” গন্ধ দিয়ে খাদ্যের অস্তিত্ব বুঝতে পারে। খাদ্যের অপাচ্য অবশিষ্ট অংশ একই মুখগহ্বর দিয়ে বের করে দেয়। এরা এবং জেলিফিশ একক প্রাণী (পলিপ) হিসেবে জীবন যাপন করে, কিন্তু প্রবাল (কোরাল) এবং সী-পেন কাটায় যৌথ জীবন। শত বা হাজার হাজার ‘পলিপ’ জুড়ে একটি প্রবাল কলোনী গড়ে ওঠে এবং এই কলোনীগুলো বিকশিত হয় প্রবাল দ্বীপে। ট্রপিকাল বা সাব-ট্রপিকাল সমুদ্রের ১৮০ সেন্টিগ্রেড-এর বেশি উষ্ণতায় সাধারণত প্রবাল সৃষ্টি হয়Ñ যেখানে খুব দ্রুত কার্বোনেট নিক্ষেপ ঘটে। সী-পেনকে ডাঙায় আনলে ফিকে নীল রঙের আলো ছড়ায়। অন্যদিকে, একই স্থানে স্থিত প্রাণী ‘স্পঞ্জ’-এর দেহ জালের মত সাজানো একক কোষের সমন্বয়ে তৈরি। এদের দেহের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফোকর দিয়ে বয়ে যাওয়া জল থেকে তারা জীবন ধারণের খাদ্য ও অক্সিজেন গ্রহণ করে।
পিরীচ আকৃতির প্রাণী ‘জেলিফিশ’-এর দৈহিক আয়তন সাত ফুট হলেও এর কর্ষিকাগুলো ১২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এদের দেহ বিস্তর কোষ দিয়ে তৈরি এবং দুই স্তরের মাঝে থাকে জেলির মত পদার্থের স্তর। ‘একিনোডারমা’ শ্রেণীভুক্ত স্টারফিশ, সী কিউকাম্বার ইত্যাদিরা ত্রিস্তর কোষবিশিষ্ট। এদের অনেক বাহু বা পা থাকে। সমুদ্রের বিচিত্র কীটদের অন্যতম হল ‘টিউব ওয়ার্ম। তাদের দেহে মুখ, চোখ বা অস্ত্র বলতে কিছু নেই। যে সব ব্যাকটিরিয়া তাদের দেহে আশ্রয় লাভ করে, সেই ব্যাকটিরিয়াই তাদের প্রাণ। পোকামাকড়ের থেকে উন্নত স্তরের অমেরুদ-ী প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম অক্টোপাস এবং স্কুইড। এরা উভয়েই মোলাসকা বা কোমলাঙ্গ শ্রেণীর প্রাণী। অক্টোপাসের আটটি পা এবং একটি উন্নত চোখ রয়েছে এবং স্কুইডের আছে দশটি পা এবং দুটি চোখ। শক্ত মেঝে এবং মহীসোপানের উল্লেখযোগ্য বাসিন্দা অক্টোপাস পাথরের ফাটলে লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে এবং শুধুমাত্র রাতেই আহারের সন্ধানে বের হয়। স্কুইড ৫০ ফুট বা তার থেকেও লম্বা হতে পার্ েএ জন্য খুব বড় আকারের স্কুইডকে সমুদ্র-দানবও (সি মনস্টার) বলা হয়।
জল বাতাস থেকে ৮০০ গুণ ভারী। ফলে জলচর প্রাণীদের শরীরের সামান্য মেদবৃদ্ধি বা স্ফীতি পাখি বা এরোপ্লেনের তুলনায় গতিকে অনেক বেশি মন্থর কর্ েতাই আমরা দেখি দ্রুতগতিপম্পন্ন সামুদ্রিক মাছ টুনা, বোনিটো, মারলিন, ম্যাকেরেলÑ এদের শরীরের গঠন অপূর্ব চিকনÑ সামনে ছুঁচোলো, মাঝখানটা মোটা এবং আস্তে আস্তে সরু হয়ে দুটো ফালি হয়ে লেজের পাখনায় শেষ হয়েছে। ‘সাইক্লোস্টোমাটা’ গোষ্ঠীভুক্ত মাছেরা সবচেয়ে আদিম। বিশাল সমুদ্রের বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন গভীরতায় বিভিন্ন ধরনের মাছ রয়েছে। তারা তাদের শারীরিক গঠন এবং অন্যান্য ক্ষমতা দিয়ে সেই পরিবেশকে জয় করেছে। যেমন, গভীর সমুদ্রে ৭৫০ মিটারেরও নিচে যেখানে একে অপরের ‘সিগন্যাল’ দেখার জন্য একেবারেই আলো নেই, সেখানে মাছেরা নিজেরাই আলো তৈরি করে নিয়েছে। দ্রুততম মাছ ‘সেইল ফিশ’ একটি ছোট পথ যেতে তার গতিকে ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার এ দাঁড় করায়। অর্থাৎ ডাঙার দ্রুততম প্রাণী চিতার থেকেও দ্রুত। ¯্রােত পক্ষে থাকলে হাঙর পাঁচশ’ মিটার দূর থেকে রক্তের গন্ধ পায়। সামুদ্রিক মাছেদের ভ্রমণসূচির একটি প্রকৃষ্ট উদারহণ ‘ম্যাকেরেল’-এর যাত্রা। তারা অক্টোবরে জলের উপরিভাগ ছেড়ে সমুদ্রতলের কাছে ছোট্ট একটি এলাকায় জড়ো হয়। সে সময় তারা ছোট মাছ বা শামুক ইত্যাদি খায়।
জানুয়ারি মাসে তারা দলবদ্ধভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠে চলে আসে এবং এপ্রিলে তাদের ‘ডিম ছাড়ার এলাকা’য় হাজির হয়। মহীসোপানের ধারে ঘুরতে ঘুরতে তারা ডাঙার খুব কাছে চলে আসে, সে সময় তাদের খাদ্য ক্ষুদ্র ভাসমান প্রাণ ‘প্লাঙ্কটন’। জুলাই মাস পর্যন্ত তারা উপকূলের খুব কাছাকাছি ছোট ছোট দলে ঘোরাফেরা করে, ছোট ছোট মাছ খায়। শরৎকালে তারা আবার গভীর সমুদ্রে ফিরে যায়। অপরদিকে ঈল মাছ জীবনের প্রথম অংশ কাটায় সমুদ্রে তারপর শত শত কিলোমিটার জনপথ অতিক্রম করে স্থলভাগের নদী বা হ্রদে এসে আস্তানা গাড়ে এবং কয়েক বছর সেখানে কাটিয়ে আবার ফিরে আসে সমুদ্রে। সেখানেই ডিম পাড়ে এবং পাণত্যাগ করে। ‘ইলেকট্রিক ঈল’ মাছের সংস্পর্শে এলে মানুষ মারা যায়। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক মাছ হল ‘টরপেডো’। সমুদ্রে একদিকে যেমন রয়েছে লোভনীয় সব ভোজ্য মাছ কড, হেরিং, সারডিন, শাড, সালমন, ম্যাকেরেল, টুনা ইত্যাদি, অন্যদিকে রয়েছে টোডফিশ, স্টোনফিশ, স্করপিয়ন ফিশ-এর মত বিস্তৃত বা কদাকার মাছ। প্রায় এক মিটার লম্বা কড মাছ কয়েক লাখ ভাসমান ডিমের জন্ম দেয়।
By: সুবীর দত্ত.