http://paimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/400x0x1/uploads/media/2014/08/23/6b622325db412e2f8ed0a7aac83ef269-28.jpgমে মাসের মাঝামাঝি এক বৃষ্টিস্নাত সকাল। তড়িঘড়ি করে আমরা বেরিয়ে পড়ি রাঙামাটি শহর থেকে একটু দূরে রাঙ্গাপানি, আলুটিলা, মোনঘর ও মানিকছড়ির উদ্দেশে। মে মাসের প্রথম বৃষ্টির পরপরই মাটি থেকে গজিয়ে ওঠে আদিবাসীদের সবচেয়ে প্রিয় মাশরুম সাম্মুওল। এই মাশরুম খুবই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। বাজারে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় এই মাশরুম। এটি শুধু মাশরুম নয়, আদিবাসীরা এটিকে ‘দেবতার উপহার’ বলে মনে করেন। মাশরুমটিকে সংগ্রহ করতে বাঁশ বা বেতনির্মিত বিশেষ ঝুড়ি ব্যবহার করেন তাঁরা। সোনা-রুপার গয়না সংরক্ষণের জন্য আদিবাসীরা যে ঝুড়ি ব্যবহার করেন, তাকে ‘সাম্মু’ বলেন। আর মাশরুমকে তাঁরা বলেন ‘ওল’। তাই দেবতার পাঠানো মূল্যবান মাশরুম তাঁরা মূল্যবান ঝুড়িতেই সংগ্রহ করেন বলে এই মাশরুমের নাম ‘সাম্মুওল’ হয়েছে বলে জানা যায়।
http://paimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/300x0x1/uploads/media/2014/08/23/8ae84c34c93f296525d779728289781f-29.jpg
রাঙামাটির মোনঘর এলাকায় বিশেষ ঝুড়িতে মাশরুম সংগ্রহ করে ফিরছেন আদিবাসী এই নারী l ছবি: প্রথম আলোরাঙামাটির এক সহকর্মী তাঁর মুঠোফোনে খবর পেলেন, রাঙ্গাপানি, মোনগড়, তঞ্চঙ্গ্যাপাড়া, সুখী নীলগঞ্জ ও আলুটিলা থেকে অনেকেই সাম্মুওল সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করছেন। পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে আমাদের গাড়ি উঠে গেল আলুটিলায় পরিচিত এক মাশরুমচাষির বাসার কাছে। তাঁর সহায়তায় আমরা সাম্মুওলের দেখা পাই। সাম্মুওল বিশেষ প্রজাতির উইপোকার ঢিবি থেকে জন্মায়। উইপোকার ঢিবি পর্যাপ্ত পুষ্টি, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা সরবরাহ করে, যাতে মাশরুমের অনুসূত্র (সূত্রাকার কাঠামো) সারা বছর বৃদ্ধি পায়। প্রতিবছর গ্রীষ্মের প্রথম বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মাটি থেকে ছাতার মতো যে অংশটি বেরিয়ে আসে, সেটিই সাম্মুওল। জীববিজ্ঞানের ভাষায়, মাশরুম হচ্ছে উচ্চশ্রেণির ছত্রাকের ফুল বা ফল।
সাম্মুওল নামের মাশরুম মূলত Termitomycetaceae পরিবারের Termitomyces গণভুক্ত উচ্চশ্রেণির ছত্রাক। প্রতিবছরই প্রথম বৃষ্টির পরপরই এসব উইপোকার ঢিবি থেকে চোখে পড়ার মতো, দৃষ্টিনন্দন, সুস্বাদু ও পুষ্টিকর এই মাশরুমের ফলদেহ মাটির ওপরে বেরিয়ে আসে। শক্ত মাটি ভেদ করে ওপরে গজিয়ে ওঠা মাশরুমটি দেখতে প্রথমত বল্লমাকার, ঘণ্টাকৃতি কিংবা অফুটন্ত শিমুল ফুলের কলির মতো মনে হয়। পরে এটি ছাতার মতো ছড়িয়ে পড়ে।
মাটির নিচে প্রোথিত অংশটি মুলার মতোই নরম বলে একে শাবলজাতীয় বস্তু দিয়ে মাটি থেকে খুঁড়ে বের করতে হয়। মাশরুমটি মাংসল এবং এর কোনো বিশেষ গন্ধ নেই, যে কারণে সবার পছন্দ। মাশরুমটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, এই মাশরুমে রয়েছে দেহ গঠন এবং ক্ষয়পূরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ১০ ধরনের অতিপ্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড, যা অন্যান্য মাশরুম থেকে বেশি।
রাঙামাটির আদিবাসীদের ভাষ্য, সাম্মুওল বার্ধক্য ঠেকাতে সাহায্য করে এবং বিভিন্ন সংক্রমণজনিত রোগের আক্রমণ থেকে তাঁদের রক্ষা করে। সুখী নীলগঞ্জের এক মাশরুমচাষি জানালেন, তিনি প্রতিবছর এই সাম্মুওল সংগ্রহ করেন। নিজে খেয়ে থাকেন, তবে কখনো বিক্রি করেননি। অথচ তিনি বাণিজ্যিকভাবে ওয়েস্টার মাশরুম চাষ করে বাজারে বিক্রি করেন। মোনঘরের এক দরিদ্র আদিবাসী জানান, তিনি প্রতিবছর বর্ষায় প্রচুর সাম্মুওল সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করেন এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে খান।
মাশরুমটি নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি, কারণ এটি শুধু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলেই জন্মে। যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য শীতপ্রধান দেশে এই মাশরুম জন্মে না। এই মাশরুমের জীববিজ্ঞান এখনো অসম্পূর্ণ, যে কারণে এটি এখনো গবেষণার ফাঁকা মাঠ।
(লেখক সাভারে অবস্থিত জাতীয় মাশরুম উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কেন্দ্রের গবেষক।)Source:www.prothom-alo.com