এই পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী খাদ্যের জন্য কোনো না কোনো ভাবে উদ্ভিগজগতের উপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে মানুষ। আমাদের খাদ্যের জন্য আমরা গুল্ম থেকে শুরু করে বৃক্ষ- সব ধরনের গাছের উপর নির্ভর করি। শুধু কি খাদ্য? নানা রোগের ওষুধও আমরা গাছ থেকে পেয়ে থাকি। কখনো গাছের বিভিন্ন অংশ সরাসরি ওষুধ হিসেবে কাজ করে, আবার কখনো সেগুলো ওষুধ তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মোটকথা, গাছের মতো উপকারী বন্ধু আর একটিও নেই। আর বাংলাদেশের সুকোমল মাটি, ঋতুচক্রের বিচিত্র বিবর্তনজাত আলো, রোদ-ছায়া-মেঘ-বৃষ্টির অপূর্ব সমাবেশে কত যে এমন উপকারী গাছগাছালি রয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই!
আসুন জেনে নিই এসময়ের অতি পরিচিত কিছু সবজি ও ফলের গুণাগুণ -
বরবটি :
অনেকেরই ধারণা বরবটি শীতকালের সবজি, আসলে তা নয়! বরবটি সারা বছর জুড়েই পাওয়া যায়। তবে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি থেকে পুরো বর্ষাজুড়ে এটা পাওয়া যায় বেশি। বরবটি দেখতে খুব সাদামাটা হলেও পুষ্টির দিক থেকে অনন্য! এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, আয়রন, প্রোটিন, শর্করা, ভিটামিন বি১, ভিটামিন বি২ ও এনার্জি। বরবটি সুপ্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন রোগের উপশমকারী ঔষধি হিসেবে কাজ করছে। রক্তশূন্যতা, চোখের অসুখ, ত্বক ও পরিপাকতন্ত্রের নানা রোগ প্রতিরোধে বরবটি সহায়তা করে। এতে রয়েছে আঁশ, যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
ঢেঁরস :
ঢেঁরস ভাজির মতো সুস্বাদু খাবার খুব কমই আছে। ঢেঁরস দিয়ে তৈরি করা হয় আরো নানা ধরনের তরকারি। ঢেঁরসে রয়েছে প্রোটিন, ভিটামিন এ, বি, সি, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, আয়োডিন ইত্যাদি নানা খাদ্য উপাদান। ঢেঁরস শরীরের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। হাড় ও দাঁত মজবুত করে তোলে এর ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস। ঢেঁরস হজমশক্তি বৃদ্ধি করে। কাশির উপশম ও শরীরের পয়ঃনিষ্কাশনে এটি বেশ উপকারী।
করল্লা :
করল্লা বা উচ্ছে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের সবজি। এর তিতকুটে স্বাদের জন্য অনেকেই এটা পছন্দ করেন না, আবার অনেকে এই তিতা স্বাদের জন্যই এর সমাদর করেন। অতীতে করল্লার নাম ছিল কারবেল্লা। পরে লোকমুখে প্রচলিত হয়ে যায় করল্লা বা করলা নামে। এতে রয়েছে আয়রন, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন সি, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, ফসফরাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান। এর বিটা ক্যারোটিন দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে। করল্লা ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। চোখ-মুখের ব্যথা, বাতরোগ, কৃমি, ম্যালেরিয়া, চুলকানি, খাবারে অরুচিসহ বিভিন্ন রোগে করল্লা ও এর পাতা ব্যবহার করা হয়।
কাঁকরোল :
কাঁকরোলের চেহারা অন্যান্য সবজির চেয়ে একেবারেই আলাদা! গাঢ় সবুজ রঙের এই সবজিটির স্বাদও অত্যন্ত চমত্কার। তবে এর অতিরিক্ত বিচির কারণ কাটাকাটি করতে বা খেতে একটু ঝক্কি পোহাতে হয়! কাঁকরোলে রয়েছে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, শর্করা ও বিভিন্ন ভিটামিন। এটি বেশ ঔষধি গুণসম্পন্ন সবজি। রক্তশূন্যতা, কাশি, চুলপড়া ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধে কাঁকরোল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
চিচিঙ্গা :
চিচিঙ্গার গায়ে বিচিত্র ডোরাকাটা দাগ রয়েছে বলে একে ইংরেজিতে Snake Gourd বলে। আমাদের দেশে কোনো কোনো জায়গায় এটা কোহি, কৈডা ইত্যাদি নামে পরিচিত। চিচিঙ্গা কচি অবস্থায় খেতে বেশি মজা। চিচিঙ্গাতে রয়েছে খাদ্যশক্তি, আমিষ, শর্করা, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ভিটামিন এ, বি১ ও বি২। উচ্চ পুষ্টিমূল্যের এই সবজিটি নানা ধরনের রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। কৃমিনাশক হিসেবে ও শারীরিক শক্তি বাড়ানোতে এর সুখ্যাতি রয়েছে। চিচিঙ্গা পরিপাকতন্ত্র ভালো রাখে এবং হজমশক্তি বৃদ্ধি করে।
পটল :
বর্ষাকালের জনপ্রিয় সবজিগুলোর একটি হলো পটল। পটল ভাজি, ভর্তা, তরকারি ইত্যাদি নানাভাবে খাওয়া হয়। পটলে রয়েছে শ্বেতসার, ভিটামিন এ এবং সি। এতে স্বল্প পরিমাণে পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও খনিজও রয়েছে। পটল রক্ত চলাচল ঠিক রাখে, হৃদপিণ্ডকে রাখে সতেজ। পটল পেট পরিষ্কার রাখে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
ঝিঙা :
বর্ষার অন্যতম সুলভ সবজি হলো ঝিঙা। এতে রয়েছে উচ্চমাত্রার আমিষ, চর্বি, ফসফরাস, আয়রন, ক্যারোটিন ও ভিটামিন সি। যকৃতের রোগ, ঠান্ডাজনিত মাথাব্যথা, বমি ইত্যাদি প্রতিরোধে ঝিঙা বেশ উপকারী ভূমিকা রাখে।
কামরাঙা :
কামরাঙা বর্ষাকালের একটি জনপ্রিয় ফল। তবে গ্রীষ্মের শেষের দিক থেকেই পাওয়া যায়। কামরাঙা ফল দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, গুণেও তেমনি অনন্য! এতে রয়েছে শর্করা, ক্যালসিয়াম, আয়রন, আমিষ, খনিজ, আঁশ, জিঙ্ক, ভিটামিন এ, সি, বি১ এবং বি২
কামরাঙায় উপস্থিত এসব খাদ্য উপাদান নানান রোগ প্রতিরোধ করে। কামরাঙা জ্বর, জন্ডিস, স্কার্ভি আর রক্তপাত নিবারণে দারুণ কার্যকর। পাকস্থলীর ক্যানসার প্রতিরোধেও কামরাঙা ভূমিকা রাখে। এর খনিজ লবণ দাঁত ও হাড় গঠনে সহায়তা করে। কিডনিতে পাথর ও ইনফেকশন প্রতিরোধেও কামরাঙা সাহায্য করে। চুল, ত্বক, নখ ও দাঁতের সুরক্ষায় কামরাঙার জুড়ি নেই!
ডেউয়া :
টক-মিষ্টি স্বাদের ডেউয়া কাঁঠালের নিকটাত্মীয় বলে ডেউয়ার রয়েছে অসংখ্য কোষ। অনেক জায়গায় ডেউয়া মাদার ফল নামেও পরিচিত। গ্রামের ছেলেমেয়েদের কাছে এই ফল বেশি জনপ্রিয়। বর্ষাকালে শহরেও প্রচুর বিক্রি হয়। এ ফলে রয়েছে ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, খনিজ, খাদ্যশক্তি, আমিষ, ভিটামিন বি১ এবং বি২। এতে রয়েছে যকৃতকে সঠিকভাবে কার্যকর রাখার উপাদান। এছাড়া গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেও সাহায্য করে।
আঁশফল :
আঁশফল তুলনামূলক ভাবে একটু অপ্রচলিত ফল। এটা লিচুর জাতভাই। কোথাও কোথাও এটা কাঠলিচু নামে পরিচিত। শাঁস লিচুর মতো অত সুস্বাদু না হলেও বেশ মজাদার। এটি আমিষসমৃদ্ধ ফল। এছাড়াও এতে রয়েছে আঁশ, চর্বি, শর্করা, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস। হজমশক্তি বৃদ্ধি ও কৃমিনাশক হিসেবে আঁশফল বেশ কার্যকর। এটি পেটের অসুখ সারায় এবং বেশ বলকারক।
Collected