ঢাকা: আশ্চর্য হলেও সত্যি, সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে হৃদ্রোগের প্রকোপ সর্বোচ্চ হারে পৌঁছেছে। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা ও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে দক্ষিণ এশিয়ায় ২০২০ সাল নাগাদ হৃদরোগের আক্রমণ ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে; কিন্তু বাংলাদেশে এই বৃদ্ধির হার এতই দ্রুত বিজ্ঞানীদের এই ধারণাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এমনকি যেসব বাংলাদেশি বিদেশে অবস্থান করেন অর্থাৎ অভিবাসী ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যেও হৃদ্রোগের আক্রমণ অনেক বেশি। হৃদ্রোগকে এতকাল আমরা ধনীদের রোগ বলেই জানতাম, বিলাসী জীবনযাপন ও অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণকে এর প্রধানতম কারণ বলে ধরা হতো, কিন্তু কী এমন বিষয় রয়েছে যে এই দরিদ্র দেশের আধপেটা খাওয়া মানুষের মধ্যেও হৃদ্রোগ এমন মহামারি হয়ে দেখা দিচ্ছে? এটি খুবই ভাবার বিষয়।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের আইসিডিডিআরবি ও জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট যৌথভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একটি বড় গবেষণা পরিচালনা করে, যা ব্রেভ স্টাডি (বাংলাদেশ রিস্ক অব একিউট ভাসকুলার ইভেন্টস) নামে পরিচিত। এই গবেষণায় উঠে এসেছে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। যেমন: এক. বাংলাদেশে হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের গড় বয়স হচ্ছে ৫২ বছর। এর মানে হৃদরোগের আক্রমণে অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সী ও উৎপাদনশীল একটি অংশ কর্মদক্ষতা হারাচ্ছেন। এর অর্থনৈতিক প্রভাব বিশাল।
দুই. জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ১২ শতাংশই নারী। বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে হৃদরোগের এই উচ্চ হার আমাদের আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দেয় এ কারণে যে এ দেশে এই নারীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে সঠিক ও যথাযথ সময়ে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
তিন. বেশির ভাগ আক্রান্ত ব্যক্তির বডি মাস ইনডেক্স (উচ্চতা অনুসারে ওজনের পরিমাপ) স্বাভাবিক মাত্রার মধ্যেই পড়ে—২২.৬। ওজনাধিক্য ও স্থূলতাকে হৃদরোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে ধরা হলেও এঁদের মোটে ৪ শতাংশ রোগী স্থূল। এই তথ্য আমাদের প্রচলিত ধারণাকে পাল্টে দিচ্ছে। তবে এক-তৃতীয়াংশ রোগী ওজনে বেশি না হলেও তাঁদের পেটের মাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। তার মানে আমাদের এখানে ঝুঁকি নির্ণয়ে ওজন নয় বরং পেটের মাপ বা ওয়েস্ট হিপ অনুপাতও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচ্য হবে।
চার. গবেষণায় অংশ নেওয়া প্রতি ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনই দিনে ১০ মিনিটেরও কম সময় কঠিন পরিশ্রম করে থাকেন। অর্থাৎ অলস ও কর্মহীন জীবনযাপন একটি বড় ঝুঁকি।
পাঁচ. হৃদরোগের আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮০ শতাংশ কোনো না-কোনোভাবে তামাক সেবন করে থাকেন। পুরুষেরা বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা এবং নারীরা গুল, তামাক, সাদাপাতা ও জর্দা ব্যবহার করে থাকেন। ছয়. খাদ্যাভ্যাস যা-ই হোক না কেন, বেশির ভাগের রক্তে ক্ষতিকর এলডিএল কোলেস্টেরল বেশি এবং ভালো কোলেস্টেরল এইচডিএলের পরিমাণ কম। এ ছাড়া যাঁরা বাড়িতে ও কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা স্ট্রেস মোকাবিলা করেন, তাঁরাও অধিক ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন।
সাত. রক্তে ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ যেমন আর্সেনিক, কপার ও মার্কারির মাত্রা সরাসরি হৃদরোগের আক্রমণের সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে আর্সেনিকের ঝুঁকি রক্তে চর্বির আধিক্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আট. সাধারণত বাংলাদেশি খাদ্যাভ্যাস অর্থাৎ অধিক শর্করা (যেমন ভাত, চিনি ও মিষ্টিদ্রব্য) হৃদরোগের ঝুঁকির সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু যাঁরা নিয়মিত মাছ খান, তাঁরাও এই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন। এই তথ্যও আমাদের প্রচলিত ধারণার পরিপন্থী। এর একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে মাছে ব্যবহৃত নানা রাসায়নিক বা বিষাক্ত পদার্থের, বিশেষ করে ফরমালিন ও আর্সেনিকের উপস্থিতি। এ ছাড়া বাংলাদেশে মাছ রান্নার প্রচলিত পদ্ধতিও কিছুটা দায়ী। অতিরিক্ত তেলের ব্যবহার, অনেকক্ষণ ধরে মাছ ভাজা ও রান্না করার কারণে মাছের গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়।
ব্রেভ স্টাডি থেকে আবিষ্কৃত নতুন ধরনের ও অপ্রচলিত তথ্য-উপাত্ত ইতোমধ্যেই বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই গবেষণার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের মানুষের জন্য থাকল কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ।
তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলুন। নারীদের মধ্যে গুল, জর্দা বা তামাক ব্যবহার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে নারীদের হৃদরোগ। আর সরাসরি ধূমপানের মতো পরোক্ষ (পাবলিক জায়গায় বা অন্যের সামনে) ধূমপানও সমান ক্ষতিকর।
ওজন স্বাভাবিক থাকলেও পেটের মাপের দিকে মনোযোগী হন। পেটের মেদ বা ভুঁড়ি বাড়ে অতিভোজন ও কম পরিশ্রমের কারণে। গড়পড়তা বাংলাদেশি নারী-পুরুষ খুবই কম কায়িক শ্রম করে থাকেন। বিশেষ করে শহর ও শহরতলির মানুষের মধ্যে এর পরিমাণ আরও কম। শহর অঞ্চলে হাঁটার জন্য খোলা মাঠ, পার্ক বা ওয়াকওয়ে বাড়াতে হবে, খেলাধুলা, বাইসাইকেল চালনা বা সাঁতার কাটার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
সহজ শর্করা যেমন চিনি ও মিষ্টি, সাদা চালের ভাত, সাদা পাউরুটি খাওয়া কমিয়ে দিন। ভাজা ও ফ্রাই খাবার, গরু খাসির মাংস, কোমল পানীয়, কেক পেস্ট্রি, বিস্কুট, ফাস্ট ফুড ইত্যাদিও এড়িয়ে চলুন। আমিষের উৎস হিসেবে ডাল ও পোলট্রি বেছে নিন। খাবারে ও রান্নায় লবণের পরিমাণ যথাসম্ভব কমান।
গবেষণা বলছে যে বাংলাদেশের খাদ্যশৃঙ্খলে বিষাক্ত রাসায়নিকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে ও দৈনন্দিন খাবার যেমন চাল, ভাত বা সবজিকে দূষিত করেছে। যত দ্রুত সম্ভব এই খাদ্যদূষণ রোধে কঠোরতম পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এ বিষয়ে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করতে হবে।
হৃদরোগের মতো একটি ব্যয়সাপেক্ষ ও জটিল সমস্যাকে মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ট প্রস্তুতি আমাদের নেই। অথচ এ অঞ্চলের মধ্যে দ্রুততম হারে বেড়ে চলেছে এই সমস্যা। তাই প্রতিরোধই এই মুহূর্তে সর্বোত্তম পন্থা।