ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফিরবেন কি ফিরবেন না, এ আলোচনা এই মুহূর্তে রীতিমতো অসহনীয় ঠেকছে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর কর্তারা নাকি রোনালদোকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ফেরার প্রসঙ্গও মুখে না নিতে। তাঁরা রোনালদোকে রেখে দেওয়ার ব্যাপারে এতটাই মরিয়া যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে রোনালদোর দামটাম নিয়ে আলাপ-আলোচনাতেও রয়েছে তাঁদের রাজ্যের অনীহা। কেবল অনীহা বললে বোধ হয় ভুল হবে, রোনালদোর ‘মূল্য’ নিয়ে কোনো আলোচনাতেই রিয়াল মাদ্রিদ রাজি নয়।
রিয়াল মাদ্রিদ বিরক্ত খোদ রোনালদোর ওপরই। মাঝেমধ্যেই তিনি বিভিন্ন ফোরামে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্রতি নিজের ‘ভালোবাসা’র কথা প্রকাশ করেছেন। অনেক জায়গাতেই বলেছেন, হয়তো কোনো না-কোনো দিন তিনি ফিরে যাবেন তাঁর পুরোনো ক্লাবে। রিয়ালের অবস্থা এখন অনেকটা, ‘বললেই হলো’টাইপ। রোনালদো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ‘যেতে চাইলে’ই যে ‘যেতে পারবেন না’, সেটা বেশ স্পষ্ট করেই সিআর-সেভেনকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে ফুটবল বিশ্বে বাণিজ্যিক রাজস্বের দিক দিয়ে সবচেয়ে ‘লাভজনক’ এই তারকাকে ছেড়ে দেওয়ার মতো ‘বোকা’ যে রিয়াল নয়, সেটা হাভভাবে এখনই জানিয়ে দেওয়া শুরু করেছে ব্লাঙ্কোস-ব্যবস্থাপনা। সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে আর কে-ইবা ছাড়তে চায়!
হ্যাঁ, রোনালদো রিয়ালের কাছে এই মুহূর্তে সোনার ডিম পাড়া হাঁসই। ২০০৯ সালে তাঁকে যখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে ১২০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে কিনে আনা হলো, তখনই রোনালদোকে নিয়ে রিয়াল তৈরি করেছে বাণিজ্যিক পরিকল্পনার বুনিয়াদ। পাঁচ বছর পরে সেই বাণিজ্যিক বুনিয়াদ হয়েছে আরও মজবুত। এই মুহূর্তে রিয়ালের কাছে রোনালদো খেলোয়াড় হিসেবে তো বটেই বাণিজ্যিক দিক দিয়েও অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ এক অনুষঙ্গ। রোনালদো ব্যক্তিগতভাবে করপোরেট বাণিজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে দামি খেলোয়াড়। রোনালদো থাকা মানেই নিশ্চিত বাণিজ্য। কেবল পেছনে ‘রোনালদো’ লেখা ৭ নম্বর খচিত জার্সির রেপ্লিকা বিক্রি করেই যে পরিমাণ আয় করে রিয়াল, তা দিয়ে পৃথিবীর নামকরা অনেক তারকাকেই এক তুড়িতে কিনে নিয়ে আসতে পারে তারা। তারা এখন কোন হিসাবে, কীসের ভিত্তিতে রোনালদোকে ছেড়ে দেবে! ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্রতি ‘ভালোবাসা’ দেখানোর জন্য তো আর গত সেপ্টেম্বরে নতুন করে রোনালদোর সঙ্গে চুক্তি হয়নি! নতুন চুক্তিতে রোনালদো বেতন কত পান জানেন? বছরান্তে তাঁকে তুলে দেওয়া হয় ২১ মিলিয়ন ইউরো। তাও আবার ট্যাক্স কেটে। এর পাশাপাশি অন্যান্য বোনাস-টোনাসের প্রসঙ্গ না হয় বাদই দেওয়া হলো।
এবার আসা যাক রোনালদোর ম্যানচেস্টার ইউনাইডে যাওয়াটা কতটা বাস্তবসম্মত, সেই আলোচনায়। এই মৌসুমে খেলোয়াড় কেনা বাবদ ইতিমধ্যেই ২৫৭ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে ফেলেছে ইউনাইটেড। এখন নতুন করে রোনালদোকে দলে নিতে গেলে যে আরও একটি ‘রেকর্ড’ করতে হবে, সেটা তো বলাই বাহুল্য। তাও না হয় করার চেষ্টা করত ইউনাইটেড। কিন্তু গত মৌসুমে যাচ্ছেতাই পারফরম্যান্সে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার সুযোগ হারানোটা সব দিক দিয়েই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের ক্লাবটির জন্য। রোনালদো মুখে যতই ইউনাইটেড-ভালোবাসার কথা বলে থাকুন না কেন, তিনি কেবল সেই ভালোবাসার জন্য চ্যাম্পিয়নস লিগের মায়া ছাড়বেন—এ কথা বোধ হয় বিশ্বাস করার খুব বেশি লোক এই পৃথিবীতে নেই। সবকিছু ছেড়ে দিন, তিনি যদি চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার মায়াও ছেড়ে দেন, তাহলে তাঁর ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকেরা নিশ্চয়ই বসে থাকবেন না, যখনই দেখবেন রোনালদো ইউরোপ-সেরা হওয়ার লড়াইয়ে নেই, ঠিক তখনই তাঁরা পিঠটান দিয়ে দেবেন। রোনালদো এই ঝুঁকিই বা কেন নিতে যাবেন!
সবচেয়ে বড় কথা, এই মৌসুমে ২৫৭ মিলিয়ন ইউরো খরচ করার পরেও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বাজে পারফরম্যান্স ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের কর্তাদের নিশ্চয়ই রোনালদোকে দলে নেওয়ার ব্যাপারে ‘নতুন রেকর্ড’ গড়তে উৎসাহিত করবে না! এমনিতেই চ্যাম্পিয়নস লিগে না থাকার কারণে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের রাজস্ব লক্ষ্য অনেকটাই কম হবে বলে আভাস মিলেছে। এমন অবস্থায় রোনালদোকে কিনে ব্যবসায়িক ঝুঁকি কেন নেবে ইউনাইটেড।
নাইকি-অ্যাডিডাসের চিরন্তন দ্বন্দ্বও রোনালদোর বার্নাব্যু ছাড়ায় প্রতিরোধ তৈরি করছে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সম্প্রতি সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নাইকির সঙ্গে চুক্তি রদ করেছে। অ্যাডিডাসের সঙ্গে নতুন চুক্তি করেও নাকি সমস্যার মধ্যে আছে তারা। চ্যাম্পিয়নস লিগ না খেলতে পারার কারণে অ্যাডিডাস নাকি অর্থকরী বেশি দেওয়ার ব্যাপারে গড়িমসি করছে। এ তো গেল একটা বিষয়। নাইকির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর রোনালদো এর মধ্যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে গিয়ে অ্যাডিডাসের জার্সি-বুট পরবেন, এই ভাবনা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যায়। তিনি যদি অ্যাডিডাস পরেন, তাহলে রিয়ালের অ্যাডিডাস জার্সিই পরবেন, অন্য কারও নয়।
তবে যাকে নিয়ে এত কথাবার্তা, সেই রোনালদোই তাঁর ওল্ড ট্র্যাফোর্ড যাত্রাকে ‘জল্পনা’ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। তাহলে এত দিন যে ওল্ড ট্র্যাফোর্ড নিয়ে ভালোবাসার গান গাইলেন তিনি, সেগুলো কিছুই নয়! আরে ঠ্যালার নাম বাবাজি বলেও তো একটা কথা আছে—তাই নয় কি? তথ্যসূত্র: গোল ডটকম।