নোট 24
পবিত্র কোরআন ও বিজ্ঞানের আলোকে মানব ভ্রুণ তত্ব
পবিত্র কোরআন : 1. সূরা হাজ্জ, আয়াত 5 : “ হে মানব জাতি, যদি তোমরা পুনরুত্থান সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে থাক তাহলে দেখ আমরা, তোমাদের ধূলামাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর নূৎফা (শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিশ্রণ) থেকে, তারপর জোঁক সদৃশ জমাট রক্তপিন্ড থেকে, তারপর ছোট মাংসপিণ্ড থেকে- যা কিছুটা আকৃতিপ্রাপ্ত এবং কিছুটা আকৃতিহীন যেনো আমরা তোমাদের কাছে পরিষ্কার করতে পারি। আর আমরা যেভাবে ইচ্ছা মাতৃগর্ভে একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত রাখি। এরপর শিশু হিসেবে তোমাদেরকে মাতৃগর্ভ থেকে বের করে আনি। এরপর আমরা তোমাদের বড় করি যাতে তোমরা যৌবনে পদার্পন করতে পার। তোমাদের মধ্যে কয়েকজনকে মৃত্যুর কোলে ডেকে আনি। আর কয়েকজনকে দুর্বল বাধক্যকাল পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাই যেনো তারা জানার পর কিছুই জানে না (সূরা হাজ্জ : 5)।
2. সূরা মুমিনুন , 12-14 : প্রকৃতপক্ষে আমরা মানুষ সৃষ্টি করেছি মাটির সার নির্যাস থেকে। পরে তাকে নুৎফা হিসেবে একটি সুরক্ষিত আধারে (জরায়ু) স্থাপন করেছি। তারপর এ নুৎফাকে জমাট রক্তপিন্ডে পরিণত করেছি। তারপর জমাট রক্তপিণ্ডকে মাংসপিণ্ডে (চর্বন বস্তুর মতো) পরিণত করেছি। এরপর এ মাংসপিণ্ডকে অস্থি বানিয়েছি। এরপর অস্থিকে মাংসপেশী দ্বারা আবৃত করেছি। অবশেষে তাকে একটি ভিন্ন সৃষ্টিতে উন্নীত করেছি। অতএব মহামহিম আল্লাহ পাক সবার উপরে শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা (সূরা মুমিনুন : 12-14)।
কানাডার বিখ্যাত টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী প্রফেসর কেইথ মুর মানবভ্রুন তত্ব সম্পর্কে ল্যাবরেটরিতে উচ্চ শক্তিশালী মাইক্রোসকোপের সাহায্যে মানুষের ভ্রুন পরীক্ষা করে তা কোরআনে বর্ণিত জোঁকের ছবির সঙ্গে তুলনা করে দেখে কোরআনের বাণীর সত্যতা খুঁজে পান ।
বিজ্ঞান ভিত্তিক আলোচনা : প্রথম পর্যায় বলা হয়েছে মাটির নির্যাস থেকে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। মাটির সার নির্যাস হিসেবে মাটিতে রয়েছে সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, নাইট্রোজেন, আয়রন এবং আরো অন্যান্য উপাদান, বৃক্ষরাজি এবং ক্ষেতের ফসল মূলের সাহায্যে এসব উপাদান চুষে নেয়। এরপর বৃক্ষ ফল (আম, কাঁঠাল, কলা এবং আঙ্গুর, কলা) দেয় এবং ক্ষেতে বিভিন্ন ফসল উৎপন্ন হয়। ফল এবং ফসলগুলো পুষ্টির প্রয়োজনে মানুষ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং খাদ্যের সার নির্যাস রক্তের সাথে মিশে যায় এবং পরবর্তীতে পিতার শরীরে সৃষ্টি হয় sperm এবং মায়ের শরীরে সৃষ্টি হয় Ovum । Sperm দ্বারা Ovum নিষিক্ত হয়ে জাইগোট গঠন করে যা জরায়ুতে (Uterus) স্থানান্তরিত হয়। অতএব পিতা মাতার পুষ্টির প্রয়োজনে মাটির নির্যাস থেকে যেসব উপাদান সংগৃহীত হয় সেসব উপাদান থেকে নুৎফা তৈরি হয়।
নুৎফা দ্বারা মানব ভ্রুণ সৃষ্টি হয়। আরবি নুৎফা শব্দ দ্বারা Sperm ও Ovum এর মিলনের ফলে যে জাইগোট গঠিত হয় তাকেও পবিত্র কুরআনে নুৎফা বলা হয়েছে। Sperm, Ovum- এর ভেতরে প্রবেশ করে জাইগোট তৈরি করে। লক্ষ লক্ষ Sperm- এর মধ্যে একটি Ovum- এ প্রবেশ করে নিষেক (Fertilization) ঘটায়।
জাইগোট বাচ্চা থলির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সেখানে পার্শ্ব দেয়ালে দৃঢ়ভাবে এঁটে থাকে। এটা তার জন্য বেশ নিরাপদ স্থান।
পরবর্তী পযায়ে জাইগোট বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্ধিষ্ণু জাইগোটের প্রাথমিক অবস্থাকে আরবিতে বলা হয় ‘আলাক’ । একটি জোঁক রক্ত চুষে নিয়ে যে রূপ ধারণ করে আলাক দেখতে অনেকটা সে রকম। 3 থেকে 4 সপ্তাহের মধ্যে উন্নয়নশীল ভ্রুণ জোঁকের মত আকার ধারণ করে। এর মধ্যে থাকে মাথার সম্মুখভাগের উন্নত অংশ। এ পর্যায়ে হৃৎপিণ্ড অথাৎ Cardiovascular system এর উন্নয়ন ঘটে। এরই মধ্যে 15-16 দিনের মাথায় আলাক জরায়ুর দেয়ালে ঝুলন্ত দেহবস্তুর মতো ঝুলে থাকে। অতএব আলাক শব্দটি তিন ধরণের অর্থ বিজ্ঞাসম্মতভাবে গ্রহণযোগ্য। (1) জমাট রক্তপিণ্ড, (2) জোঁক সদৃশ বস্তু, (3) ঝুলন্ত দেহবস্তু।
পরবতী পযায়ের রুপান্তরকে আরবিতে বলা হয় মুদগাহ বা মাংসপিণ্ড । এ অবস্থা চলতে থাকে 23-42 দিন পযন্ত। এ অবস্থায় ভ্রুণকে প্রকৃতপক্ষে চর্বন বস্তুর মতো (Chewed-like substance) দেখায় ।
পরবর্তী পর্যায়টি হলো হাঁড় তৈরির স্তর । প্রথমে যে হাঁড়গুলো দেখা দেয় সেগুলো হলো উপরিভাগের কচি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। প্রাথমিক 6 সপ্তাহে কচি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মেসেনচিমাল টিশুগুলো ( Mesenchymal tissue) কোমল অস্থিতে পরিণত হয়ে ভবিষ্যৎ অস্থির একটি স্বচ্ছ মডেল গঠন করে। 12 সপ্তাহের মধ্যে ভ্রুণের একটি পূর্নাঙ্গ কঙ্কাল (Skeleton) গঠিত হয়।
ভ্রুণ বিকাশের পরবর্তী স্তর হলো পেশী গঠনের স্তর। সপ্তম সপ্তাহ থেকে কঙ্কাল দেহে বিস্তার লাভ করে এবং হাঁড়গুলো পরিচিত আকার ধারণ করে। এ সময় ভ্রুণটি একটি মানব চিত্র লাভ করে। সপ্তম সপ্তাহ শেষ হলে অষ্টম সপ্তাহের সময় পেশীগুলো হাঁড়ের চারপাশে আবৃত হতে থাকে। যদিও হাঁড় গঠনের সঙ্গে সঙ্গে পেশী গঠন শুরু হয় তবুও পরবর্তী সময় না আসা পর্যন্ত পেশী তার সঠিক অবস্থান গ্রহণ করে না। সুতরাং পেশী হাড়ের উপর আচ্ছাদন কথাটি খুবই তাৎপর্যবাহী।
অষ্টম সপ্তাহ শেষ হলে নির্দিষ্ট পেশীকাণ্ড, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং মাথা খুব ভালোভাবে দেখা যায় এবং এ সময় ভ্রুণটি নড়াচড়া করতে থাকে।
এরপর ভ্রুণটি একটি সময়কাল ধরে বড় হতে থাকে। আরবি শব্দ ‘খালকান আখারা’ যে অর্থ প্রকাশ করে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ন। ‘খালকান আখারা’ অর্থ ভিন্ন সৃষ্টি। গর্ভে থাকার পূর্ণ সময় পরে শিশু জন্মলাভ করে অর্থাৎ নতুন এক সৃষ্টি আপন অস্তিত্বে মূর্ত হয়ে ওঠে।
আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, আল্লাহ পাক ‘আহসানুল খালেকীন’ অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ স্রষ্ঠা । এ অর্থ যথোপযুক্ত। প্রকৃতপক্ষে মানুষ কোনো কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। শুধু আল্লাহ পাক প্রদত্ত বস্তুসমূহের রূপান্তর করতে পারে। অর্থাৎ সৃষ্টির উপজীব্য উপাদান তা’আলারই সৃষ্টি । তাছাড়া মানব সৃষ্টি সকল সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম এ কারণে মানুষকে বলা হয় আশরাফুল মাখলুকাত।
জন্মলাভের পরপরই শিশু পার্থিব আলো, বাতাস, আর্দ্রতা ও উষ্ণতার সংস্পর্শে আসে। তখন তার মধ্যে আশ্চযজনক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তারপর আমরা দেখতে পাই যে, শিশু বিকশিত হয়ে কিভাবে কৈশোর এবং যৌবনে পদার্পন করছে। এ আয়াতে বলা হয়েছে কেউ কেউ বার্ধক্যে পৌছার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আল্লাহ পাক বিশেষভাবে কিছু মানুষের বৃদ্ধাবস্থার কথাও উল্লেখ করেছেন। মানুষ যৌবনকালেই শক্তিশালী থাকে এবং পরবর্তী পর্যায়ে পুনরায় বৃদ্ধাবস্থায় দুর্বল হয়ে পড়ে। অল্পসংখ্যক লোক দেখা যায় যারা অধিক বয়স পযন্ত বাঁচে। এভাবে বাঁচার কারণে তারা শিশুর মতো শিশুসুলভ আচরণ করে এবং তারা তাদের অতীতের সবকিছু ভুলে যায়। এ অবস্থায় দৈহিক দুবলতার কারণে মস্তিস্কের কঠিন পরিবর্তন সাধিত হয় যার ফলে তার চিত্তভ্রম ঘটে।
সপ্তম শতাব্দিতে যখন পবিত্র কোরআনে এসব স্তরের কথা উল্লেখ করা হয় তখন ভ্রণবিদ্যার (Embryology) জন্মলাভ ঘটেনি।