বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তর্ক-বিতর্ক করা আমাদের দেশের একটা রীতি ও স্বাভাবিক বিষয়। কোন বিষয়ের বিতর্ক মানে তার যথার্থতা, নীতি-কৌশল, পর্যবেক্ষণ ও সঠিকতা তুলে ধরা এবং সমৃদ্ধ করা। সম্প্রতি বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক ও গবেষক অভিজিৎ রায় খুন হওয়া এবং এই পরিস্থিতির জন্য আস্তিক ও নাস্তিকরা কে কতটা দায়ী তার পরস্পর বিরোধী নানা মাত্রিক তর্ক-বিতর্ক চলছে।
এমনকি এই হত্যাকাণ্ড ঘিরে সুবিধাভোগী ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির সমীকরণ ঘটানোর এক কুৎসিত প্রচেষ্টাও চলছে সমগতিতে।
আপনি সনাতন না আধুনিক ধার্মিক, আস্তিক-নাস্তিক নিয়ে বিতর্ক করতে পারেন। ডান না বাম কারা দেশের অধিক ক্ষতি-বৃদ্ধির কারণ তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারেন। আপনি বিশুদ্ধ, সংশোধনবাদী না বিচ্যুৎ বাম তা নিয়ে গবেষণা করতে পারেন। কে প্রগতিশীল আর কে অপ্রগতিশীল তা নিয়ে তর্ক করতে পারেন। কিন্তু এই পরিস্থিতি ও প্রয়োজনে যাদের আঘাত-হুমকি-বিপদ মোকাবেলার জন্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-তর্ক-বিতর্ক করছেন, তাদের ছক পরিষ্কার।
আপনি, আপনারা বুঝতেই পারছেন না তাদের এজেন্ডার ব্যপ্তি ও গভীরতা কতটা ভয়াবহ! তাদের নিশানা ভুল হবে না! ভুল হচ্ছেও না। এরা কতটা ঘিরে আছে আপনাদের-আমাদের। শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রশাসনে কতটা প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ এদের। ভাবতেই পারছেন না তাদের দেশ-বিদেশের বহুমাত্রিক জাল কতটা বিস্তৃত ও সুদূরপ্রসারী।
গত দুই দশকে ছায়ানট, উদীচী, লালন আখড়া, যাত্রাগান, বৈশাখী মেলা, মন্দির, ভাস্কর্য, সংখ্যালঘু, চিত্রকলা, শিল্প-সাহিত্য, শামসুর রাহমান, সুফিয়া কামাল, জাফর ইকবাল ইত্যাদির উপর হামলা, আক্রমণ, হুমকির কারণ কি নাস্তিকতা? আইএস-বোকো হারাম-আল কায়দাসহ ইসলামি জঙ্গিরা বিশ্বব্যাপী শিশু-নারী-পর্যটক-সাধারণ মানুষ হত্যা করছে কি নাস্তিকতার অপরাধে?
এ আঘাত ও খড়গ তো বাংলাদেশ ও বাংলা সংস্কৃতির উপর..!
এখানে আস্তিক-নাস্তিক, ডান-বাম, প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল বিতর্ক ও বিভেদ করে আত্মরক্ষা, গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার কৌশল সাময়িক পুলক ও তৃপ্তির কারণ হতে পারে, কিন্তু রক্ষা পাবেন না..! বরং এই বিতর্ককে দীর্ঘ ও বিস্তৃত করা হবে জঙ্গি তৎপরতাকে পরোক্ষ যৌক্তিকতা দেয়া সহায়তার নামান্তর!
বছর দুই আগে এক স্বত:স্ফুর্ত প্রক্রিয়ায় গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিষ্ঠা হয়। সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে একটা সমীকরণ ও মেরুকরণ ঘটিয়েছে। একচুয়াল জগত ছাড়িয়ে তা ভার্চ্যুয়াল জগতেও গড়িয়েছে। অনেকে যে যার সম্পর্ক-সম্বন্ধ-যোগাযোগগুলো ফের ঝালাই করে এবং যোগ-বিয়োগ করে নিয়েছেন। যা আমাদের রাজনীতি সচেতন নাগরিকদের মধ্যে- বিশেষত তরুণ সমাজের মধ্যে তৈরি করেছে এক স্পষ্ট বিভেদ রেখা। বিভিন্ন ধারার শিক্ষা যোগাচ্ছে এই বিপরীতমুখী সংস্কৃতির মনস্তাত্ত্বিক পুষ্টি আর অসুস্থ ও বিভক্ত ধারার রাজনীতি দিচ্ছে এর প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি। যা আমাদের ঘনবসতিপূর্ণ ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জাতীয় ঐক্য ও সংহতির জন্য এক অশনি সংকেত।
লক্ষ্য করেছি, রাজনীতি সচেতন প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক বলয়ে সহনশীলতার ঘাটতি, অতি মর্যাদাবোধ, শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা ও অনৈক্য। দেশের ছোট-বড় যে কোন সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ঘটনা ও দুর্ঘটনায় তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করি বিভিন্ন। মত-মতান্তর একটি গণতান্ত্রিক সমাজের স্বাভাবিক চিত্র। ভিন্নমত, ন্যায্য-যৌক্তিক আলোচনা ও বৈচিত্র্য গ্রহণযোগ্য। যে কোন বিষয়ের নানা মাত্রিক বিতর্ক-বিশ্লেষণ জ্ঞান-বোধকে সম্পন্ন ও উন্নত করে। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই যখন কোন অভিন্ন বিষয়ের তত্ত্বগত ও মৌলিক সহমত (থাকার কথা) থাকলেও বাস্তবে তার জ্ঞান ও মতামত প্রকাশের বিষয়টি হয়ে ওঠে প্রতিযোগিতা, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই।
এই অনাকাঙ্খিত ও অনির্ধারিত তর্ক-বিতর্ক যতটুকু না সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সাংস্কৃতি, দর্শন, প্রগতি ইত্যাদির সংগ্রামকে অগ্রসর করে তার চেয়ে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত ও বিভ্রান্ত করে। এবং প্রতিপক্ষের কর্মকাণ্ডকে সহজ ও বেপরোয়া করতে সহায়ক হয়। এমন কি সেই কথিত শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে কোন কোন বন্ধুকে দেখেছি প্রতিপক্ষের সাথে সুর মেলানোর অনৈতিক কৌশলের আশ্রয় নিতে।
বুর্জোয়া দলগুলোর দ্বারা কোন অন্যায়, অপরাধ, ভুল সংঘটিত হলে (ব্যতিক্রম বাদে) তাদের দলের শীর্ষ থেকে সর্বনিম্ন ব্যক্তি পর্যন্ত একভাষায় কথা বলবে। এবং নানাভাবে প্রমাণের চেষ্টা করবে তাদের দলের কোন নেতা, কর্মী, সদস্য এর সাথে যুক্ত না এবং তা প্রতিপক্ষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে। আর এই প্রগতিশীল ঘরানায় অন্যায়, অপরাধ, ভুল তো পরের কথা কোন ব্যক্তির লেখা/বলায় সামান্য ভিন্নমত হলে তার জন্য প্রতিপক্ষের দরকার নেই, আমরাই আমাদের কাটাছেঁড়ার জন্য যথেষ্ট।
বাংলাদেশের এই ধারার ক্ষতি যতটা না তার প্রতিপক্ষ দ্বারা হয়েছে তার অনেক বেশি নিজেদের দ্বারাই হয়েছে-হচ্ছে। আমরা একে অন্যকে সহযোগিতা করার বিপরীতে অপদস্থ করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করি।
এতো সীমাবদ্ধতায় প্রধান দলগুলো ভাবমূর্তি সংকটে থাকলেও পালা করে ক্ষমতায় যেতে সমস্যা হচ্ছে না। আর প্রগতিশীলরা অস্তিত্বের সংকটে থেকেও লক্ষ্য অর্জনের চেয়ে কে কতটা নির্ভুল, উদার ও মহান তা প্রমাণের প্রচেষ্টায় মহাতৎপর।
দুর্ভাগ্য যে, প্রগতিশীলরা যখন প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন (ভার্চ্যুয়াল জগতে) তাদের প্রতিরোধ/জবাব দেয়ার ক্ষেত্রেও সমীকরণটা হয় পক্ষ-বিপক্ষে নানা ঘটনা ও হিসেবের সুযোগ নেয়ার। তাই, বাংলাদেশের প্রগতিশীলদের চিন্তার প্রকাশ ও আচরণ দেখে মনে হয়, আপনি যতই লাইন টেনে দিন, ব্যাঙ যেমন একসাথে হাঁটতে পারে না, প্রগতিশীলরাও কি তাই..?