সাফল্যের অংশীদার বাংলাদেশও

Author Topic: সাফল্যের অংশীদার বাংলাদেশও  (Read 543 times)

Offline shalauddin.ns

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 364
  • Test
    • View Profile
একজন বাংলাদেশিও আছেন এই বিজ্ঞানী দলে। দুই ব্ল্যাকহোলের (কৃষ্ণগহ্বর) মিলনের ফলে সৃষ্ট মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরা পড়েছে বিজ্ঞানীদের যন্ত্রে, ১০০ বছর আগে যার কথা বলেছিলেন আইনস্টাইন। গত বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে সংবাদ সম্মেলনে সেই ঘোষণা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সারা দুনিয়া কেঁপে উঠেছে সেই খবরের তরঙ্গের আঘাতে। সেই গবেষক দলের একজন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র দীপঙ্কর তালুকদার (৩৯)।
গতকাল শনিবার (যুক্তরাষ্ট্রে শুক্রবার) ড. দীপঙ্কর তালুকদারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয় ই-মেইলে। তিনি জানান তাঁদের গবেষণার সেই দারুণ কাহিনি।
২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। ৯টা ৫০ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে লাইগোর শনাক্তকারক যন্ত্রে একটা সংকেত আসে। তিন মিনিটের মধ্যে বিজ্ঞানীরা তা জানতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ই-মেইল চালাচালি। ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই বিজ্ঞানীরা প্রায় নিশ্চিত হন, এটা পৃথিবীর নিজস্ব কোনো তরঙ্গসংকেত নয়, ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের দুটি ব্ল্যাকহোলের মিলনের ফলে সৃষ্ট মহাকর্ষ তরঙ্গেরই সংকেত। তাঁদের লাইগোর শনাক্তকারকে ভূমিকম্প, রেডিও তরঙ্গ থেকে শুরু করে যত ধরনের তরঙ্গ আসতে পারে, সবকিছু শনাক্ত করার আলাদা আলাদা মিটার বসানো আছে। বিজ্ঞানীরা সবাই উত্তেজিত। এখন তাঁদের আরও গবেষণা করতে হবে, করতে হবে আরও হিসাব-নিকাশ, যাচাই-বাছাই। তারপর নিশ্চিত হতে হবে যে এটা দুটি ব্ল্যাকহোলের মিলিত হওয়া থেকে উদ্ভূত তরঙ্গ।
পরদিন ফোন আসে দেশ থেকে। দীপঙ্কর জানেন এই ফোনের মানে কী। তাঁর মা পারুল তালুকদার সপ্তাহ কয়েক আগে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এই কল মানে, মা আর নেই। মায়ের মৃত্যুসংবাদ শুনলেন। কিন্তু দেশে আসতে পারলেন না দীপঙ্কর। কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের অরিগন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইগোর বিজ্ঞানী দলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এই সংকেত পৃথিবীর বা এই সৌরজগতের অন্য কোথাও থেকে এসেছে, নাকি এসেছে ব্ল্যাকহোল থেকেই, তা বিশ্লেষণ করে দেখার। দীপঙ্কর সেই কাজে ডুবে যান। গোপনে তাঁরা কাজ করছেন। এবং নিশ্চিত হলেন, এটা ব্ল্যাকহোলের মহাকর্ষ তরঙ্গসংকেত। তারপর ১১ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞানীরা আয়োজন করলেন সংবাদ সম্মেলনের। জানালেন, আইনস্টাইনের কথাই ঠিক।
দীপঙ্করের জন্ম ১৯৭৭ সালে, বরগুনায়। বাবা পরেশ তালুকদার একসময় ছিলেন বরগুনা পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান। দীপঙ্করের মনে পড়ে, ছোটবেলায় তাঁদের সংসার ছিল টানাটানির, তিন বেলা ভাত জোটানোই ছিল মুশকিল, লেখাপড়া তো ছিল দূরের কথা। বাবা সবকিছু বিলিয়ে দিতেন আর ১৯৭১ সালে সহায়-সম্পত্তির বেশির ভাগই হাতছাড়া হয়ে যায়। দীপঙ্করের বড় ভাই শংকর তালুকদার রাস্তার ধারে বসে চাল বিক্রি করে সংসার চালাতেন। বরগুনা আদর্শ স্কুল, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বরগুনা জিলা স্কুলের দিনগুলোতে সংসারের এই অনটন দীপঙ্করকে থামাতে পারেনি। পরে অবশ্য তাঁদের সংসারে শ্রী ফিরেছে। বরগুনা সরকারি কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষে (২০০২) মাস্টারমাইন্ড আর অক্সফোর্ড স্কুলে পড়িয়েছেন কিছুদিন। তারপর সরাসরি যুক্তরাজ্য থেকে পেলেন কমনওয়েলথ বৃত্তি, অ্যাডভান্সড ম্যাথমেটিকস পড়েছেন কেমব্রিজে (২০০৩)। এরপর কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক এল, তিনি উদ্বুদ্ধ হলেন ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির ডাকে। কারণ অধ্যাপক বললেন, ‘এখানে তুমি মহাকর্ষ তরঙ্গবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পারবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের দুটি লাইগোর শনাক্তকারকে কাজ করার সুযোগ আমাদের আছে।’ লাইগো (এলআইজিও) মানে হলো লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরি। তিনি গেলেন ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্নাতক পড়ার অংশ হিসেবে এক বছর কাটালেন জার্মানির হ্যানোভারের আলবার্ট আইনস্টাইন ইনস্টিটিউটে। সেখানে তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল, ‘আকাশের স্থানীয় অ্যাস্ট্রো ফিজিক্যাল উৎসসমূহ থেকে কীভাবে দীর্ঘকালীন মহাকর্ষ তরঙ্গ খোঁজা যায়’। সেখান থেকে ফিরে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৃতীয় মাস্টার্স। ২০১২ সালে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেন। একই সঙ্গে কলেজ অব সায়েন্সের আউটস্ট্যান্ডিং গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট পুরস্কার পান। পিএইচডি গবেষণার বিষয়ও ছিল, দুটি ব্ল্যাকহোল মিলিত হলে যে অশান্ত ব্ল্যাকহোল তৈরি হয়, সেখান থেকে আসা বৃত্তায়িত মহাকর্ষ তরঙ্গের সংকেত কীভাবে শনাক্ত করা যাবে।
২০০৭ থেকে দীপঙ্কর মহাকর্ষ তরঙ্গ গবেষণা শুরু করেন। লাইগো সায়েন্টিফিক কোলাবরেশনের সদস্য হন ২০০৮ সালে। এ মুহূর্তে তিনি অরিগন বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইগো সায়েন্টিফিক কোলাবরেশনের হয়ে কাজ করছেন। যখন তিনি প্রথম সেখানে যোগ দেন, ওই কোলাবরেশনে তখন ৪০০ বিজ্ঞানী কাজ করতেন। এখন ১৫টা দেশের হাজার খানেক বিজ্ঞানী এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। আর কোনো বাংলাদেশি আছেন কি না, তিনি জানেন না।
ড. দীপঙ্কর সর্বশেষ বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০০৯ সালে। তাঁর স্ত্রী শম্পা বিশ্বাস ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন শিক্ষা বিষয়ে। অরিগন থেকে ওয়াশিংটনে গাড়ির দূরত্ব প্রায় সাত ঘণ্টা। তিনি স্ত্রীকে পড়তে উৎসাহিত করেন।
আপনাদের পরের লক্ষ্য কী—এ প্রশ্নের জবাবে দীপঙ্কর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা একটা শনাক্তকারক যন্ত্র বানিয়েছি। আমরা একটা সংকেত শনাক্ত করতে পেরেছি। ১১ ফেব্রুয়ারিতেই আমরা পুরো দল পরের কাজ শুরু করে দিয়েছি, লাইগোর শনাক্তকারক দিয়ে মহাকর্ষ তরঙ্গ-সম্পর্কিত মহাকাশ গবেষণা। আমরা মহাবিশ্বের সবচেয়ে অশান্ত অংশ সম্পর্কে জানতে পারব। আর ব্যক্তি হিসেবে আমার লক্ষ্য লাইগো কোলাবরেশনের নেতৃত্বের পর্যায়ে যাওয়া।’
পরিবার ড. দীপঙ্কর তালুকদারের প্রেরণার উৎস। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের উদ্যম আর জ্ঞানতৃষ্ণা তাঁকে সব সময় উদ্বুদ্ধ করেছে। আর তিনি প্রেরণা পান স্টিফেন হকিংয়ের কাছ থেকে। কারণ হকিং তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কাছে কখনো হার মানেননি।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে ড. দীপঙ্কর তালুকদার বললেন, ‘তোমরা কি জানো, কেন একজন ব্যর্থ হয়? কারণ সে যথেষ্ট চেষ্টা করেনি। আমি আমার কাজ তোমাদের উদ্দেশে উৎসর্গ করলাম। এই পৃথিবীতে কত মানুষ খারাপ পরিস্থিতিতে আছেন, যার ওপরে তাঁদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তারপরও তো কতজনই দারিদ্র্য জয় করেছেন। উপেক্ষা, প্রতিকূলতা পেরিয়ে সাফল্য ছিনিয়ে নিয়েছেন। আমার কাজ আমি উৎসর্গ করছি তাঁদের জন্য। আমি জানি, তোমাদের প্রত্যেকের আছে নিজের একটা করে গল্প, তোমাদের আন্তরিক সাধনা করতে হবে। তোমাদের প্রত্যেকের সামর্থ্য আছে এমন কিছু করে দেখানোর, যা আমাদের গর্বিত করতে পারবে।’