‘আর কী করলে আপনারা মেনে নেবেন যে তামিম আমাদের সেরা ব্যাটসম্যান?’ ফোনের ওপারে হাসছেন জনাব গোলাম মুর্তজা। মাশরাফি বিন মুর্তজার গর্বিত পিতা। তামিম তখন ৮৫ পার হয়েছেন। বললেন, ‘বুঝলেন তো আপনার গত লেখা পড়েছি। প্রথম ৫ ওভারে যা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। ১০ ওভারে সত্তরের কোঠায় পৌঁছালে আমার জানে পানি এসেছে। আপনারা যে কী করে খেলা দেখেন!’ হল্যান্ডের সঙ্গে খেলার পরে লিখেছিলাম, নিজের মধ্যে বাবা বাবা অনুভূতি হচ্ছে। আরহামের বাবা তামিম ইকবাল শতক করার পরে শূন্যে লাফ দিলেন, একটু পরে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন আলায়নার বাবা সাকিব আল হাসান। তখন মনে হলো, আরে আমাদের খেলোয়াড়েরাও তো বাবার গৌরব নিয়েই খেলছেন।
তামিমের প্রশংসা আজ সারা পৃথিবী করবে। তিনি কেবল বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান নন, উইজডেন সাময়িকীর প্রচ্ছদে আসা বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। অথচ আমরা, বাংলাদেশের ধৈর্যহারা সমর্থকেরা, তাঁকে কত দুঃখই না দিয়েছি। গভীর দুঃখের সঙ্গে তামিম বলেছিলেন, আমার সমালোচনা করার সময় এমনকি আমার পরিবারকেও টেনে আনা হয়েছে। কত যে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হয়েছে তাঁকে নিয়ে! বেগম রোকেয়া একবার তাঁর স্কুলের ছাত্রীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, তোমরা যে স্কুলভবন দেখছ, তার জন্য কত মাটি নিজেকে পুড়িয়ে ইট হয়েছে, কত শামুক নিজেকে পুড়িয়ে চুন হয়েছে। আজকে তামিমের সেঞ্চুরির দিনে, বাংলাদেশের বিজয়ের দিনে বলতে পারি, তামিমের শিশুসন্তান এখনো ব্যাংককের হাসপাতালে। সাকিব যেদিন ভারতের বিরুদ্ধে এশিয়া কাপের ফাইনালে নামবেন, খেলার আগে মাঠে অনুশীলন করছিলেন, খুব কাছ থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটছেন, ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়ে তিনি খেলতে নেমেছেন। মাশরাফি বিন মুর্তজার সন্তান হাসপাতালে আইসিইউতে ছিল, আর তিনি মাঠে খেলেছেন, এমন দিনও তো গেছে। আমরা এই ছেলেদের কাছে কেবল জয় চেয়েছি, কিন্তু খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব দেখিয়ে কজনই বা বলতে পেরেছি, খেলায় জয়-পরাজয় আছেই, তোমরা তোমাদের শতভাগ উজাড় করে দাও, আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি, সুদিনেও যেমন, দুর্দিনেও তেমনি। নিশ্চয়ই বেশির ভাগ সমর্থকই তাই বলেছি, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই যুগে অল্প কয়েকজন নিন্দুকই যথেষ্ট আপনার জীবনকে অতিষ্ঠ করার জন্য।
বাংলাদেশ এই সেদিন টি-টোয়েন্টিতে পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কাকে হারাল, তবুও তাকে ওমানের সঙ্গে খেলে বিশ্বকাপের সুপার টেনে যেতে হলো। কী আর করা, আমরা তো টি-টোয়েন্টি খেলতে জানতাম না। কীভাবে ব্যাট করতে হয় এই ছোট ক্রিকেটে, তা অবশ্য দেখালেন তামিম। প্রতিটি বলে ছয় মারার চেষ্টা করার দরকার পড়ে না, প্রতিটি ওভারেও না। ১ ওভারে গোটা দুয়েক চার-ছয়ই যথেষ্ট। আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওমানের জয়ের নায়ক আমীর আলী ওমানে প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া নামের রেস্তোরাঁয় কাজ করেন, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ছেলেরা মাথা ঠান্ডা রেখে খেলবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই তারা খেলেছে। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে মাহমুদউল্লাহ বলে ফেলেছিলেন, প্রথম রাউন্ডের খেলাগুলো আমাদের ওয়ার্মআপ ম্যাচ। মাশরাফি তাঁকে নাকি নিষেধ করেছেন—এমন করে বলতে হয় না।
এখন অবশ্য রসিকতার সময়। ফেসবুকে স্ট্যাটাস আসছে, আইসিসির আম্পায়াররা বলবেন, তামিমের কনুই ১৫ ডিগ্রির বেশি বেঁকেছে, ওর ব্যাটিং অ্যাকশন ত্রুটিপূর্ণ! দুজন বোলারকে ডেকে পাঠিয়ে আইসিসি আমাদের আহত করেছে। তবে বাঘের চেয়ে আহত বাঘ আরও বেশি মারাত্মক। কাজেই আমরা মনোবল হারাচ্ছি না।
এরপরের খেলা ইডেনে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত কাল যখন বাজছিল ধর্মশালায়, আমাদের ক্রিকেটারদের চোখের কোণ চিকচিক করছিল। ওই গান কলকাতার দর্শকদের কেমন উদ্বেলিত করে, দেখার বিষয়। আর আমরা, বাংলাদেশের সমর্থকেরা, যে যেখানে খেলা দেখব, দাঁড়িয়ে গলা মেলাব—আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।