রেলওয়ের ইতিহাস

Author Topic: রেলওয়ের ইতিহাস  (Read 1684 times)

Offline myforum2015

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 218
  • সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রন এক আল্লাহ্ তায়ালারই
    • View Profile
রেলওয়ের ইতিহাস
« on: March 30, 2016, 10:12:59 AM »
রেলওয়ে উনিশ শতকে প্রবর্তিত হয়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক বিপ্লবের সূচনা করে। জর্জ স্টিফেনসনের যুগান্তকারী প্রচেষ্টায় ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বের প্রথম রেলওয়ে ইংল্যান্ডের স্টকটন থেকে ২৬ কিমি দূরবর্তী ডার্লিংটন পর্যন্ত জনসাধারণের জন্য উদ্বোধন করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেলওয়ের প্রথম উদ্বোধন হয় মোহাওয়াক থেকে হাডসন পর্যন্ত ১৮৩৩ সালে। জার্মানিতে এর প্রথম উদ্বোধন হয় ১৮৩৫ সালে নুরেমবার্গ থেকে ফুর্থ পর্যন্ত, ইতালিতে হয় ১৮৩৯ সালে, ফ্রান্সে ১৮৪৪ সালে, স্পেনে ১৮৪৮ সালে এবং সুইডেনে ১৮৫৬ সালে। রেলওয়ের প্রবর্তনে ইউরোপ ও আমেরিকার তুলনায় ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলাও পিছিয়ে ছিল না।
রেলপথ বিকাশের ইতিহাস উনিশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় উপনিবেশিক বাংলায় রেলওয়ে স্থাপনের জন্য প্রাথমিকভাবে ইংল্যান্ডে চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা হতে থাকে। এরূপ পরিকল্পনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও কৌশলগত সুবিধাদিসহ বাণিজ্যিক স্বার্থ বিবেচনা।
ভারতের ভাইসরয় লর্ড ডালহৌসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালক পর্ষদের কাছে ভারতবর্ষে রেলওয়ে স্থাপন কাজ শুরু করার জন্য অনেকগুলি প্রস্তাব পাঠান। ১৮৪৪ সালে আর.এম স্টিফেনসন কলকাতার সন্নিকটে হাওড়া থেকে পশ্চিম বাংলার কয়লাখনি সমৃদ্ধ রানীগঞ্জ শহর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি গঠন করেন।
তবে প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেতে ও সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়। ইতোমধ্যে, ১৮৫০ সালে গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ে নামক কোম্পানি মুম্বাই থেকে থানা পর্যন্ত ৩৩ কিমি দীর্ঘ রেললাইন স্থাপন করতে থাকে। লাইনটি উদ্বোধন করা হয় ১৬ এপ্রিল ১৮৫৩ সালে। এটিই ছিল ব্রিটিশ ভারতে রেলওয়ের প্রথম যাত্রা। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি কর্তৃক নির্মিত হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ৩৮ কিমি রেললাইনের উদ্বোধন হয় ১৮৫৪ সালে এবং এর মাধ্যমে চালু হয় বাংলার প্রথম রেললাইন।
বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরু করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ব্রিটিশ আমলেই বিবেচনা করা হয়েছিল। ১৮৫২ সালে কর্নেল জে.পি কেনেডি গঙ্গা নদীর পূর্বতীর ধরে সুন্দরবন হয়ে ঢাকা পর্যন্ত রেললাইন বসানোর প্রস্তাব দেন। কিন্তু এর মধ্যেই ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ সরকার বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) দখল করে। বার্মাকে সরাসরি ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করার রাজনৈতিক এবং কৌশলগত কারণেই কলকাতা ও বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগের প্রশ্নটি প্রকট হয়। ১৮৫৫ সালে বাংলায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল কোরের মেজর অ্যাবার ক্রমবি মাঠ পর্যায়ে জরিপ করে একটি রিপোর্ট পেশ করেন। এতে
ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে নামে একটি কোম্পানি গঠনের সম্ভাব্যতা উলেখ করা হয়। পরবর্তী দুই বছরে প্রবীণ রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার পুর্ডন-এর তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার রূপ নেয়।
১৮৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে
কলকাতা থেকে রাণাঘাট পর্যন্ত রেলপথ উদ্বোধন করে। এই লাইনকেই বর্ধিত করে ১৫ নভেম্বর ১৮৬২ সালে দর্শনা থেকে জগতী পর্যন্ত ৫৩.১১ কিমি ব্রডগেজ (১,৬৭৬ মিমি) রেললাইন শাখা উন্মোচন করা হয়। সে সময় কুষ্টিয়া ছিল প্রান্তিক স্টেশন, কিন্তু ১৮৬৭ সালে পদ্মা ভাঙনের কারণে তা স্থানান্তরিত হয় গড়াই নদীর পাড়ে এবং পরবর্তী বছরে আদি কুষ্টিয়া স্টেশন পরিত্যক্ত হয়। কুষ্টিয়া থেকে পদ্মার পাড়ে (পদ্মা ও যমুনার সংযোগস্থলের নিচে) অবস্থিত অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর গোয়ালন্দ পর্যন্ত ৭৫ কিমি দীর্ঘ রেললাইন উদ্বোধন করা হয় ১ জানুয়ারি ১৮৭১ সালে।
১৮৭৪ সাল থেকে ১৮৭৯ সালের মধ্যে নর্থ বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে নামে ব্রিটিশ সরকার একটি নতুন ২৫০ কিমি দীর্ঘ মিটারগেজ (১,০০০ মিমি) রেললাইন স্থাপন করে। লাইনটি পদ্মার বামতীর ঘেঁষে সারা থেকে চিলাহাটি হয়ে হিমালয়ের পাদদেশস্থ ভারতের শিলিগুড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত। এই লাইন পূর্বে পার্বতীপুর থেকে কাউনিয়া এবং পশ্চিমে পার্বতীপুর থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত দীর্ঘ। একই সময়ে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে সারা-র উল্টোদিকে পদ্মার ডান পাশে অবস্থিত দামুকদিয়া থেকে পোড়াদহ পর্যন্ত ব্রডগেজ রেললাইন সংযোজন করে। এতে রেলওয়ে নিয়ন্ত্রিত স্টিমারের পক্ষে ফেরিতে পদ্মা নদী পারাপারে সুবিধা হয়। মাঝপথে একমাত্র পদ্মা নদীর এই প্রতিবন্ধকতা ছাড়া কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত যাত্রা ছিল সরাসরি। ১৮৮৪ সালে ১ জুলাই ব্রিটিশ সরকার, কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়েকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং এর নতুন নামকরণ করে ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে।
বিশ্বজুড়ে পাটের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য প্রধান পাট উৎপাদনকারী এলাকা ঢাকা এবং ময়মনসিংহ থেকে কলকাতা বন্দরে পাট সরবরাহ করার জন্য উন্নতমানের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৮৮৫ সালে মূলত কাঁচা পাট নদীপথে কলকাতায় আনার জন্য ঢাকা স্টেট রেলওয়ে নামে খ্যাত ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ১৪৪ কিমি দীর্ঘ মিটারগেজ রেললাইন স্থাপন করা হয়। ক্রমান্বয়ে এটিকে ময়মনসিংহ থেকে জামালপুর হয়ে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট এবং পরবর্তীকালে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। ১৮৮৭ সালে আরও ভাল ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে নর্দান বেঙ্গল রেলওয়ে এবং ঢাকা স্টেট রেলওয়েসহ কাউনিয়া থেকে কুড়িগ্রাম (ধরলা) পর্যন্ত ন্যারোগেজের (৭৬২ মিমি) রেললাইনকে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের সঙ্গে একীভূত করা হয়। একই কারণে ১৮৮২-৮৪ সালের মধ্যে সেন্ট্রাল রেলওয়ে নামে পরিচিত বনগাঁ-যশোর-খুলনা ব্রডগেজ রেললাইন এবং ১৮৯৯ থেকে ১৯৯০-এর মধ্যে শান্তাহার থেকে ফুলছড়ি (তিস্তামুখ ঘাট) পর্যন্ত ৯৪ কিমি মিটারগেজ লাইন চালু করা হয়েছিল। এ দুটি লাইনকে যথাক্রমে ১৯০৪ সালে ১ এপ্রিল এবং একই বছর ১ জুলাই ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ের সঙ্গে আত্মীকরণ করা হয়। ১৯০৫ সালে কাউনিয়া ও বোনারপাড়ার মধ্যে ৪৪ কিমি মিটারগেজ রেল লাইন চালু হয়। এভাবে ঢাকা এবং রাজশাহী বিভাগের ব্যাপক এলাকায় রেলপথ বিস্তার লাভ করে।
কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গ এবং আসামের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের জন্য পদ্মার উপরে সেতু নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়ে। ১৯১৪ সালে পদ্মার উপরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ প্রকল্প বাস্তবায়ন উপলক্ষে সারা থেকে শান্তাহার পর্যন্ত মিটারগেজ লাইনকে ব্রডগেজ লাইনে রূপান্তর করা হয়। কলকাতা থেকে দিলি, মাদ্রাজ ও মুম্বাই পর্যন্ত প্রধান রেলপথগুলি ছিল ব্রডগেজ মাপের। ১৯১৫ সালের ৪ মার্চ দুই লেনবিশিষ্ট হার্ডিঞ্জ ব্রিজ রেল চলাচলের জন্য উদ্বোধন করা হয়। ১৯২৪ সালের জুলাই মাসে শান্তাহার থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত ৯৫ কিমি এবং ১৯২৬ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ পার্বতীপুর থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত ৬৭ কিমি রেলপথ মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজে রূপান্তরিত হয়। এর ফলে উত্তরবঙ্গে শিলিগুড়ি থেকে চিলাহাটি হয়ে কলকাতা ও ভারতের অন্যান্য স্থানে মালামাল সরবরাহ ও যাত্রী চলাচল গাড়ি বদল ছাড়াই সম্ভব হয়ে ওঠে। ১৯১৫ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে নাম থেকে সরকারিভাবে ‘স্টেট’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়।
ব্রিটিশ সরকার তিন প্রকার গেজের (প্রস্থের) রেলপথ প্রবর্তন করে, যথা: ব্রড (১,৭৬৭ মিমি), মিটার (১,০০০ মিমি) এবং ন্যারো (৭৬২ মিমি)। নিকটতম নদীবন্দর অথবা প্রধান প্রধান রেলপথের মাঝে সংযোগ স্থাপনের জন্য স্বল্প দূরত্বের রেললাইন স্থাপন করা হয়। অধিকতর সম্ভাবনাপূর্ণ এলাকার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য রেলপথের পরিবর্ধনও করা হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী গাড়িবদল ব্যতিরেকে রেলযোগাযোগ আরও সুসঙ্গত করার লক্ষ্যে রেলপথ রূপান্তরের কাজও অব্যাহত থাকে।
১৯২০ সালে রেলওয়ে ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করার লক্ষ্যে ময়মনসিংহ থেকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে দ্বারা পরিচালিত ৮৮ কিমি বেসরকারি রেললাইন রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। ১৯১৫-১৬ সালে স্থাপিত ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত ৮০ কিমি রেলপথটি ব্রিটিশ সরকার ১ অক্টোবর ১৯৪৪ সালে কিনে নেয়। ১৯১৬ সালে ভেড়ামারা থেকে রায়তা পর্যন্ত ব্রডগেজ লাইন খোলা হয়। ১৯১৮ সালে জুন নাগাদ ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে রূপসা (খুলনা) থেকে বাগেরহাট ৩২ কিমি রেলপথটি নির্মাণ করে, কিন্তু ১৯৪৮ সালে তা সরকারি আওতায় আনা হয়। ১৯১৯ সাল নাগাদ সরকার ও কোম্পানি কর্তৃক সর্বমোট ১,৮০৬.১৬ কিমি রেলপথ নির্মিত হয়।
বেসরকারি রেলওয়ে কোম্পানিগুলি নির্দিষ্ট চুক্তি অনুযায়ী কাজ করত। চুক্তিপত্রের শর্তাদিতে ছিল জমি, সরকারি সাহায্য, মুনাফা বহন, ভাড়ার হার ছাড়াও বিশেষ দায়িত্ব পালন, যেমন চিঠিপত্র, সৈন্যসামন্ত, পুলিশ, সরকারি অফিসার-কর্মচারী বা সরকারি টাকা পয়সা ও বহন সরকারি মালামাল পরিবহণ ইত্যাদি প্রসঙ্গে।
বাহাদুরাবাদ থেকে জামালপুর (সিংহজানি) পর্যন্ত মিটারগেজ রেললাইন চালু হয় ১৯১২ সালে। ১৯২৮-২৯ সালে তিস্তা-কাউনিয়া ন্যারোগেজের রেললাইন মিটারগেজে রূপান্তর করা হয়। ১৯৩০ সালে আব্দুলপুর থেকে আমনুরা পর্যন্ত ব্রডগেজ লাইন নির্মিত হয়। এর একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল আম ও আখ পরিবহণ এবং সেন্ট্রাল বেঙ্গল থেকে রোহনপুর হয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন। পরিবহণ ব্যবস্থার প্রবল চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৯৭ সালে আগস্ট মাসে দর্শনা থেকে পোড়াদহ পর্যন্ত দুই লেনের রেলপথ (double line) স্থাপন করা হয়। এরপর দুই লেনের ব্রডগেজ লাইন স্থাপিত হয় পোড়াদহ-ভেড়ামারা (১৯০৯ সালে), ভেড়ামারা-ঈশ্বরদী (১৯১৫ সালে) এবং ঈশ্বরদী-আব্দুলপুরে (১৯৩২ সালে)।
ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে চায়ের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলি চীন থেকে চা আমদানি শুরু করে। ১৮৩০ সালে বিভিন্ন কারণে চীন থেকে চা আমদানি বন্ধ হওয়ায় ব্রিটিশ কোম্পানিগুলি হিমালয়ের দক্ষিণাংশে আসাম (সিলেট) ও উত্তরবঙ্গে (দার্জিলিং ও কুচবিহার/আলীপুর দুয়ার) চা বাগান স্থাপনের কাজ শুরু করে। চা বাগানগুলির উৎপাদন বাজারজাত করার জন্য ১৯০২ সালে বেঙ্গল ডুয়ার্স ন্যারোগেজের রেলপথটি কাউনিয়ার উত্তরে নর্থ বেঙ্গলের কুচবিহার পর্যন্ত সম্প্রসারণ করে ১৯৪১ সালে প্রশাসনিক ভাবে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এর দক্ষিণাংশ বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের আওতায়। কেবল বাহাদুরাবাদ-ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লাইন ছাড়া ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের পুরো অংশটাই ছিল ব্রহ্মপুত্র নদীর পশ্চিম পাশে। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কলকাতার শিল্প, বাণিজ্য ও শহরতলি এলাকার চাহিদা পূরণের জন্য এমনভাবে বিস্তার লাভ করে যে পুরো রেলওয়ে ট্র্যাকের বিন্যাস কলকাতামুখী হয়ে ওঠে।
১৮৩০ সালের দিকে মূলত আসাম অঞ্চলের সিলেট এলাকায় চা কোম্পানিগুলির স্থাপনা শুরু হয়। যেসব চা উৎপাদনকারী কোম্পানি আসামের চা বাগানে প্রচুর বিনিয়োগ করেছিল তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৯১ সালে
আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে স্থাপন করা হয়েছিল। এর প্রধান দপ্তর ছিল চট্টগ্রামে। আসামসংলগ্ন সমৃদ্ধশালী জেলাগুলিতে চা এবং অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা নিতে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন জরুরি হয়ে পড়ে। এই বন্দর থেকেই আবার ব্রিটিশ বাংলার ঢাকা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, ত্রিপুরা (কুমিল্লা) এবং চট্টগ্রাম জেলার পাট, খাদ্যশস্য ও অন্যান্য কাঁচামাল বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হতো। ১৮৯২ সালে ইংল্যান্ডে গঠিত আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি এদেশে রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব নেয়। ১৮৯৫ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রাম থেকে কুমিলা ১৫০ কিমি মিটারগেজ লাইন এবং লাকসাম থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত ৬৯ কিমি রেললাইন জনসাধারণের জন্য খোলা হয়। ১৮৯৬ সালে কুমিল্লা-আখাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ স্থাপন করা হয়। কিন্তু কলকাতা বন্দর এবং আশপাশের নদীভিত্তিক এলাকার কিছু স্বার্থান্বেষী স্টিমার কোম্পানি চট্টগ্রামে সমুদ্র বন্দরের স্থাপনা ও উন্নতি সাধনে বাদ সাধে। শেষ পর্যন্ত ১৮৯৭ সালে প্রচন্ড প্রতিরোধের মুখেও, ব্রিটিশ সরকার চট্টগ্রাম বন্দরে জেটি নির্মাণ অনুমোদন করে। বন্দর প্রশাসন স্বয়ং ভিন্ন প্রশাসন হওয়া সত্ত্বেও, বন্দর নির্মাণ কজের ভার দেওয়া হয় আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের কোম্পানির ওপর।
বিভিন্ন রেলপথের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংযোগপথের অংশগুলিতে রেল যোগাযোগের কাজ চলতে থাকে। ১৯০৩ সালে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের পরিচালনায় বেসরকারি লাকসাম-নোয়াখালী রেল শাখা চালু হয়। ১৯০৫ সালে এই লাইনটি সরকার কিনে নেয়, এবং ১৯০৬ সালে ১ জানুয়ারি আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের সঙ্গে একীভূত করে দেয়। টঙ্গী এবং আখাউড়ার মধ্যে রেললাইন স্থাপিত হয় ১৯১০ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে, সিলেট এবং কুলাউড়ার মধ্যে ১৯১২ থেকে ১৯১৫ সালে, শায়েস্তাগঞ্জ-হবিগঞ্জ লাইন ১৯২৮ সালে, শায়েস্তাগঞ্জ-ব
েল্লা এবং ফেনী-বেলুনিয়ার মধ্যে ১৯২৯ সালে, চট্টগ্রাম-ষোলশহর লাইন ১৯২৯ সালে, ষোলশহর-নাজিরহাট লাইন ১৯৩০ সালে, ষোলশহর এবং দোহাজারী লাইন ১৯৩১ সালে।
১৯১২-১৯১৮ সালের মধ্যে ময়মনসিংহ-ভৈরববাজার রেলওয়ে কোম্পানি ময়মনসিংহ-গৌরীপুর, গৌরীপুর-নেত্রকো
না-মোহনগঞ্জ, শ্যামগঞ্জ-জারিয়া-ঝঞ্চাইল, গৌরীপুর-ভৈরববাজার রেললাইন স্থাপন করে। এই শাখাগুলি ১৯৪৮-৪৯ সালের মধ্যে সরকার অধিগ্রহণ করে। ময়মনসিংহ-গৌরীপুর-ভৈরব রেললাইন ছিল আসাম-বেঙ্গল রেল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাধীনে। ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগের জন্য ১৯৩৭ সালে ৬ ডিসেম্বর মেঘনা নদীর উপর রেলসেতু উদ্বোধন করা হয়। ১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকার আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে অধিগ্রহণ করে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের সঙ্গে একীভূত করে এবং এর নতুন নামকরণ হয় বেঙ্গল-আসাম রেলওয়ে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্তির পর বেঙ্গল-আসাম রেলওয়ে পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান উত্তরাধিকারসূত্রে পায় ২,৬০৬.৫৯ কিমি রেললাইন এবং তা ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে (ইবিআর) নামে পরিচিত হয়। ১৯৬১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এর নতুন নামকরণ হয় পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে। ইবিআর পায় প্রায় ৫০০ কিমি ব্রডগেজ এবং ২,১০০ কিমি মিটারগেজ লাইন, কিন্তু ব্রডগেজ রেল ইঞ্জিন বা ব্রডগেজ রেললাইনের উপরে চলাচল করার উপযুক্ত রেলযানসমূহ মেরামত করার কোন কারখানা পূর্ব পাকিস্তানে ছিল না। তবে, পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে সৈয়দপুরে একটি মিটারগেজ রেল কারখানা পেয়েছিল। ইবিআর রেল পরিচালনার ক্ষেত্রে কতগুলি মারাত্মক অসুবিধা ও সমস্যার সম্মুখীন হয়, যেমন, সংযোগবিহীন রেললাইন, যানান্তরকরণের অসুবিধা, যমুনা নদীর দুই ধারে নাব্যতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ফেরিঘাটসংলগ্ন রেললাইনের নিত্য স্থানান্তর সমস্যা ইত্যাদি। উপরন্তু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেললাইনের উপর দিয়ে প্রবল ধকল যায়। দেশ বিভাগের আগে পর্যন্ত সেগুলি সঠিকভাবে মেরামত করা সম্ভব হয়নি।
দেশ বিভাগের পরপরই সঙ্গত কারণে সৈয়দপুর কারখানায় ব্রডগেজ রেল ইঞ্জিন ও যানবাহন মেরামতের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছিল। দর্শনা থেকে যশোর পর্যন্ত রেল যোগাযোগ বিহীন এলাকায় ৬৯.২৩ কিমি একটি অসংযুক্ত ব্রডগেজ লাইন দ্রুত নির্মাণ করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ২১ এপ্রিল ১৯৫১ সালে। রেলওয়ের ট্র্যাকের প্রয়োজনীয় পাথর সরবরাহ করার জন্য সিলেট-ছাতক লাইনে ৩৩.৮ কিমি রেলপথ উন্মুক্ত করা হয় ১৯৫৪ সালের ১৫ অক্টোবর। ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাস থেকে ভোলাগঞ্জের নদীবক্ষ থেকে ছাতক বাজার পর্যন্ত সংগৃহীত শিলা ও নুড়িপাথর সরবরাহের জন্য ১৮.৫১ কিমি মনোরেল রোপওয়ে স্থাপনা সক্রিয় করা হয়। এই ব্যবস্থায় ঘণ্টায় ৬০ টন পাথর বহন করা সম্ভব হয়। ১৯৭০ সাল নাগাদ রূপসা-বাগেরহাট ন্যারোগেজ রেললাইনকে ব্রডগেজে রূপান্তর করা হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশের পর এদেশের রেলওয়ের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ রেলওয়ে, যা উত্তরাধিকারসূত্রে পায় ২,৮৫৮.৭৩ কিমি রেলপথ ও ৪৬৬টি স্টেশন। স্বাধীনতা যুদ্ধে রেলওয়ে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ফলে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে অনেক বছরে সেগুলি মেরামত করতে হয়। উল্লেখ্য ১৯৫০-এর দশকে সরকার রেলপথের বিস্তার ও পরিবর্ধনের জন্য যে সমীক্ষা চালায়, সে অনুযায়ী ডাবল লাইন ও শাখা রেলপথ তৈরি করার উদ্যোগ গৃহীত হয়।
১৯৬০-এর দশকে ঢাকা-টঙ্গী ও চট্টগ্রাম-চিনকি আস্তানার মধ্যে ডাবল লাইন ট্র্যাকের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৭০-এর দশকের মধ্যে সেই সব ডবল লাইন পর্যায়ক্রমে খোলা হয়েছিল। পুনঃস্থাপন প্রকল্পের আওতায় ঘনবসতিপূর্ণ ও ঘিঞ্জি এলাকা ফুলবাড়িয়া থেকে কমলাপুরে ঢাকা রেলস্টেশন স্থানান্তরের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৫০ সালের শেষের দিকে এবং তা চালু হয়েছিল ১৯৬৮ সালের ১ মে তারিখে। ১৯৮৭ সালে ১১ এপ্রিল এই স্টেশনের সংলগ্ন এলাকায় দেশের প্রথম অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপো উদ্বোধন করা হয়। ১৯৬৭ সালে ২৩.৬ কিমি রুহিয়া-পঞ্চগড় ও ২৮.৫৫ কিমি কুড়িগ্রাম-চিলমারী ব্রডগেজ রেললাইন খোলা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে ১৯৭০-এর দশকের প্রথম দিকে বন্যায় চিলমারী স্টেশন যমুনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় এবং বর্তমানে শুধু রমনা বাজার স্টেশন পর্যন্ত রেলগাড়ী চলাচল করে।
১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে নরসিংদী-মদনগঞ্জ ৪৬.৬৯ কিমি লাইন খোলা হয়। ট্রাফিক চলাচলের স্বল্পতার দরুন এই লাইন চালু রাখা মোটেই লাভজনক হয়নি, তাই ১৯৭৭ সালে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই কারণে ১৯৯০ সালে ফরিদপুর-পুকুরিয
়া এবং ভেড়ামারা-রায়ত
া লাইন বন্ধ হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণে ১৯৯৬ সালে লালমনিরহাট-মোগলহাট এবং ১৯৯৭ এ রূপসা-বাগেরহাট, ফেনী-বেলুনিয়া ও কালুখালী-ভটিয়াপাড়া ঘাট শাখাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
১৯৯৪ সালে বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতুর কাজ শুরু হয়েছিল। চার লেন সড়কপথ ও এক লেন ডুয়ালগেজ (পাশাপাশি ব্রডগেজ ও মিটারগেজ) রেলপথবিশিষ্ট এই সেতুর উপরে আছে বৈদ্যুতিক সংযোগ, গ্যাস লাইন ও টেলিফোন লাইনের বন্দোবস্ত। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন সেতু উদ্বোধন করা হয়। রেলওয়ে গেজ পদ্ধতিকে সুসঙ্গত করার জন্য যমুনা সেতুর পূর্ব প্রান্ত থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ১১৫ কিমি ডুয়ালগেজ লাইন নির্মিত হচ্ছে এবং জয়দেবপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত ৩৫ কিমি ব্রডগেজ লাইনকে ডুয়ালগেজ/ব্রডগেজে রূপান্তরের কাজ শুরু হয়েছে। ২৪৫ কিমি দৈর্ঘ্য পার্বতীপুর-ঈশ্ব
রদী-জামতৈল ব্রডগেজ রেলপথ যমুনা সেতুর পশ্চিম প্রান্তে মিলেছে। সেটিকে ডুয়ালগেজে রূপান্তর করা হচ্ছে।
[সংগৃহীত]
Solaiman Hoque
Lecturer (Mathematics)
Dept. of NS
solaiman.ns@diu.edu.bd