"হাওর। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অফুরন্ত সম্ভাবনাময়, অথচ বিপন্ন এক জনপদ"

Author Topic: "হাওর। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অফুরন্ত সম্ভাবনাময়, অথচ বিপন্ন এক জনপদ"  (Read 845 times)

Offline khyrul

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 138
  • Test
    • View Profile
“মাটির ওপর জলের বসতি, জলে ওপর ঢেউ

ঢেউয়ের সাথে পবনের পিরিতি, নগরে জানে না কেউ”

হাওর। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অফুরন্ত সম্ভাবনাময়, অথচ বিপন্ন এক জনপদ। বর্ষায় এ জনপদকে মনে হয় কূলহীন সাগরের মতো। এ সময় হাওরের বুক জুড়ে থাকে জল আর জল। অন্যদিকে শীতকালে হাওর হয়ে ওঠে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ প্রান্তর, যেখানে দোল খায় সবুজ-সোনালী ধানের শীষ। তখন হাওরের দিকে একটু তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যায়। সহজ করে বলা যায়, বাংরাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পিরিচ আকৃতির বৃহৎ ভূ-গাঠনিক অবনমনটির নামই হাওর।
বিভিন্ন ইতিহাস ও প্রাচীন  পান্ডুলিপি থেকে জানা যায়, বৃহত্তর সিলেট ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের একটি বড় অংশ এক সময় ‍কালীদহ সাগর’ (মতান্তরে লৌহিত্য সাগর) নামে একটি বিশাল জলরাশিতে নিমজ্জিত ছিল। পরবর্তীতে ভূ-প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফলে তা পিরিচ আকৃতির নিন্ম সমতল ভুমিতে পরিণত হয়- যা পরিচিত হয় হাওর নামে। অবশ্য, ‘হাওর’ নাম নিয়েও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছ। এ অঞ্চলের লোকেরা ‘স’ কে ‘হ’ বলে উচ্চারণ করে। তেমনি ‘সাগর’কে বলে ‘হাগর’। এভাবেই ‘সাগর’ শব্দের বিকৃত রুপ হিসাবে ‘হাগর’ এবং ‘হাগর’ থেকে ‘হাওর’ শব্দের উৎপত্তি হয়। উল্লেখ, ভাটি অঞ্চল নামে ও হাওরাঞ্চলের আরেকটি পরিচিতি রয়েছে। প্রসঙ্গত, দেশের সাতটি উপজেলা নিয়ে বিশাল হাওর এলাকা গঠিত। জেলা গুলো হচ্ছেঃ নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভী বাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মনবাড়িয়ার একাংশ।

মানব বসতির সূচনাঃ

কবে কোন অমানিশার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে প্রথম আলোর মুখ দেখেছিল এই হাওরাঞ্চল? এর উত্তর নিশ্চিত করে বলা কঠিন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, লৌহিত্য সাগর থেকে নিম্ন সমভুমিতে (প্লাবন সমভূমি) পরিণত হওয়ার পরও বহু বছর বিরান পড়ে ছিল হাওর এলাকা। এরপর পলিমাটি বিধৌত এ উর্বর ভূমিতে প্রথম বসতি স্থাপন করে অস্ট্রো-মঙ্গোলিয়ান জাতি গোষ্ঠীর কোচ, হাজং, গারো ও খাসিয়া উপজাতিরা। এর মধ্যে কোচরাই ছিল সংখ্যাধিক্য। তারাই এসে প্রথম সেখানে অনেক উচু করে বাস্ত্তভিটা নির্মাণ করে এবং শুরু করে জমির চাষাবাদ এবং মাছ ধরার পেশা। এরপর এক সময় অঞ্চলটি কামরুপ রাজ্যের অধীনে চলে যায়। ততদিনে বিভিন্ন স্থানে প্রচার হয়ে যায় এ উর্বর ভূমির খবর। তাই সে ভূ সম্পত্তির মালিকানা পেতে উপজাতিদের পাশাপাশি অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনও ছুটে আসে সেখানে। আর এভাবেই হাওর জনপদে গড়ে ওঠেছিল বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর এক মিশ্র মেলবন্ধন। যাদের উত্তরসূরীদের নিয়ে হাওর অঞ্চল এখনও মাথা নুয়ে শুয়ে আছে হিজল-করচের ছায়ায়।

বর্ষায় নাও, হেমন্তে পাওঃ

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। কিন্তু হাওরে ঋতু মাত্র দু’টি। একটি বর্ষা। অন্যটি হেমন্ত। বছরের প্রায় পাঁচ-ছ’মাস এখানে বর্ষা থাকে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকে শুরু হয়ে বর্ষা শেষ হয় আশ্বিন-কার্তিকে। এ সময় হাওর সাগরের রুপ ফিরে পায়। পানিতে একাকার হয়ে যায় সব মাঠ-ঘাট। জলবন্দি হয়ে পড়ে প্রতিটি গ্রাম, এমনকি প্রতিটি বাড়িও। তখন এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামেতো বটেই, এক বাড়ী থেকে আরেক বাড়িতে যেতেও নৌকা লাগে। যাতায়াত ব্যবস্থাটিও হয়ে ওঠে সহজ সাধ্য। কিন্তু বর্ষা বিদায় নিয়ে হেমন্ত এলেই ঘটে বিপত্তি। কারণ হাওরের অনেক এলাকায় তেমন রাস্তাঘাট নেই। এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতে হয় পায়ে হেঁটে। অর্থাৎ দুই পা-ই তখন একমাত্র ভরসা। আর ফসলি জমির ফাঁক-ফোকর দিয়েই চলে গেছে হেঁটে চলার অনেক মেঠো পথ। দূর-দূরান্তের এসব পথ পাড়ি দিতে হয় সঙ্গে চিড়া-মুড়ী নিয়ে। সম্ভবতঃ এসব কারণেই হাওরের যোগাগোগ ব্যবস্থাকে ছড়া কেটে বলা হয় ‘বর্ষায় নাও, হেমন্তে পাও’। তেমনি আরেকটি ছড়া- ‘যেখানে চলে না রিক্সা গাড়ি-তার নাম খালিয়াজুরি’। এটি হাওর উপজেলা খালিয়াজুরির যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর রচিত একটি লোকজ ছড়া। এ ছাড়া শুনে বুঝতে বাকি থাকে না যে, হাওরদ্বীপ খালিয়াজুরীতে এই একবিংশ শতাব্দীতেও গাড়ি তো দূরের কথা, কোন রিক্সাও চলে না। অর্থাৎ ‘পথিক’ শব্দটিকে যথার্থই সার্থক করে তুলেছেন হাওর বাসিন্দারা।

হাওরের জলাতংকঃ

হাওরের লোকজন প্রতিবছর ‘জল আতঙ্কে’ ভোগে। বর্ষায় গোটা হাওর এলাকা জলে ফুলে ফেঁপে ওঠে। তখন হাওর আর হাওর থাকে না। পরিণত হয় কূলহীন সমুদ্রে। আর গ্রামগুলো হয়ে ওঠে একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। কুচুরিপানার মতো ভাসতে থাকে দ্বীপ সদৃশ গ্রামগুলো। এ সময় হাওরের প্রকৃতিও হয়ে ওঠে ভয়াবহ, উন্মাতাল। কোন বাধাই মানতে চায়না সে। সামান্য বাতাসেই হাওরের পানিতে প্রচন্ড ঢেউ ওঠে। বিশাল বড় বড় এসব ঢেউ আঘাত করে গ্রামগুলোর ওপর। এতে ভাঙ্গে গ্রাম, বসতবাড়ি। আঞ্চলিক ভাষায় এ ধরনের দুর্যোগকে বলা হয় ‘আফাল’। গত এক শতাব্দীতে
আফাল- এর তান্ডবে হাওর জনপদের বহু গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে, মুছে গেছে ,মানচিত্র থেকে। আফালের তান্ডব থেকে ঘরবাড়ি রক্ষার প্রস্ত্ততিও সেখানে কম নয়। প্রতিবছর বাড়ির চারপাশে বাঁশ-কাঠ দিয়ে এক ধরণের বাঁধ নির্মাণ করতে হয়। একেকটি বাঁধে খরচ পড়ে দু’তিন হাজার টাকা। যাদের এ সামর্থ্য থাকে না- তারাই বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই হাওরবাসীর আনন্দ-বেদনার সঙ্গে অনেকখানিই জড়িয়ে আছে সর্বনাশা এ ‘আফাল’-এর নাম। অন্যদিকে বন্যাও এ অঞ্চলের প্রায় নিত্যসঙ্গী। হাওরে দ’ধরনের বন্যা হয়। একটি অকাল (আগাম) বন্যা, অন্যটি বর্ষাকালীন বন্যা। বর্ষাকালীন বন্যা যতটা না ভয়াবহ, তার চেয়ে বেশী ভয়াবহ অকাল বন্যা। সাধারণত চৈত্র-বৈশাখ মাসে এ বন্যা হয়। এতে হাওরের মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। আর একবার ফসল তলিয়ে গেলে কৃষকরা সহায় সম্বল হারিয়ে রীতিমতো নিঃস্ব হয়ে যান। বিগত কয়েক বছরের অকাল বন্যায় হাওরাঞ্চলের এমন হাজার হাজার কৃষক নিঃস্ব হয়ে গেছেন-যারা আজও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি। এদিকে বর্ষাকালীন বন্যাতো আছেই। বর্ষার সামান্য বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল এলেই পানিতে একাকার হয়ে যায় বাড়িঘর। ঘরের সামনেই থাকে পানি আর পানি। রাতে একটু কান পাতলেই শোনা যায় ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের গর্জন। এছাড়াও খরা, শিলাবৃষ্টি, চিটায় ফসল হানিসহ নানা দুর্যোগের সংগে নিরন্তর সংগ্রাম করে বাঁচতে হয় হাওরবাসীর। তাদের জীবনসূচিও যেন রচিত হয় প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে।

জীবন ও জীবিকার সঙ্কটঃ

হাওরের মানুষের জীবন – জীবিকাও দারুণ দুর্বিষহ। এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। কিন্তু সারা বছর কৃষি কাজ থাকে না। কারণ- একমাত্র বোরো ফসল ছাড়া হাওরে আর কোন ফসল হয় না। বছরের অগ্রাহায়ণ- পৌষ মাসে বোরো চাষাবাদ শুরু হয়। সে ফসল ঘরে ওঠে চৈত্র-বৈশাখে। এরপর বেকার হয়ে পড়েন হাজার হাজার কৃষক ও কৃষি শ্রমিক। ফলে জীবিকার প্রয়োজনে তারা বাধ্য হয়ে ছোটেন দাদনব্যবসায়ীদের কাছে। আবার কেউ কেউ অভিবাসী হয়ে কাজের সন্ধ্যানে চলে যান দুর- দূরান্তের বিভিন্ন জেলায়। হাওরাঞ্চলে আরেক শ্রেণীর শ্রমিক আছেন-যারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। বর্ষার পাঁচ-ছয় মাস তারা হাওরে মাছ ধরার সুযোগ পান। কিন্তু বর্ষা শেষ হলে তারাও বেকার হয়ে পড়েন এবং দাদন মহাজনদের দ্বারস্থ হন। দাদন ব্যবসায়ীদের সেই চক্রে আজও ঘুরপাক খাচ্ছেন হাওরের বহু মানুষ। ব্যাংক এবং এনজিও ঋণ সেখানে অপ্রতুল। নেই ব্যবসা- বাণিজ্যের তেমন সুযোগও। ফলে কর্মসংস্থানের দারুন অভাব হাওর জনপদে।

অপার সম্ভাবনাঃ

চীনের বিখ্যাত পর্যটক হিউয়েন সাং এর মতো পর্যটকও হাওরের জলধারায় পা ধুয়েছেন। সুতরাং এলাকাটি যে পর্যটনের জন্য উৎকৃষ্ট স্থান হতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা যেতে পারে সমুদ্র সৈকতের মতো পর্যটন স্পট। এজন্য দরকার কেবল ভাল রাস্তা আর হোটেল-মোটেল। হাওরের জীববৈচিত্র্যও আকর্ষণ করতে পারে পর্যটকদের। হতে পারে গবেষণার বিষয়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হাওরের প্রাণবৈচিত্র্য আজ ধ্বংসের পথে। ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে অনেক জলজ উদ্ভিদ ওপ্রাণী। এছাড়াও আরও অফুরন্ত সম্ভাবনা ছড়িয়ে আছে হাওরে। এ জনপদে প্রচুর ধান ফলে। কিন্তু চাষাবাদ পদ্ধতি অনেকটাই সেকেলে। তাই আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাও সেখানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। মৎস্য সম্পদকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা যেতে পারে মৎস্য প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র। এছাড়া কোন কোন হাওর এলাকাকে মৎস্য অভয়ারণ্য ঘোষনা করে মাছের চাষ ও প্রজনন নিশ্চিত করা যেতে পারে।

বহু খাস জমি পতিত পড়ে আছে হাওর এলাকায়। এগুলো প্রকৃত ভূমিহীনদের মাঝে বন্টন করে ভূমিহীনদের সংখ্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। দিনে দিনে বেদখল হয়ে গেছে বহু বিল-ঝিল ও জলাভূমী। সেগুলো পুনরুদ্ধার করা গেলে হাওরে কান পেতে আর শ্যালু ইঞ্জিনের ভট ভট শব্দ শুনতে হবে না। প্রকৃতির জলাধারের পানি দিয়েই নিশ্চিত হবে সেচ ব্যবস্থা। মূলতঃ একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার ছকে আনলেই হাওর জনপদ হয়ে ওঠবে এক অপার সম্ভাবনাময় জনপদ।