Bangladesh > Heritage/Culture
Birds of Bangladesh
Lazminur Alam:
ছবির এই পাখিটির লেজ খোয়া গেছে। এই পাখিরা বন-বাগানের ঝোপঝাড়ে চরে। লাফিয়ে লাফিয়ে এই ঝোপ থেকে সেই ঝোপে যায়, পোকামাকড়, শূককীট ও লার্ভা খায়। হাবাগোবা ও নিরীহ শান্ত স্বভাবের এই পাখিদের গলায় আছে চার রকমের মিষ্টি সুর। মোলায়েম মিষ্টি সুরেলা গলা। খুব ভোরে জেগে পাতাঢাকা কোনো গাছের ডালে বুক-পেট মিশিয়ে বসে একটানা ডাকবে অনেকক্ষণ। গানের ভাষাটা অনেকটাই ‘টিউ টু টু টুউও’ ধরনের। শৈশব-কৈশোরে গ্রামের বাড়িতে এই পাখিদের ডাকে ঘুম ভাঙত। এখনো গ্রামের বাড়িতে গেলে ঘুম ভাঙে এদেরই গানে। এদের বাংলাদেশের নাইটিঙ্গেল বলা যেতে পারে। বাগেরহাটের গহিন ঘন ছায়াময় বাগানে এরা আজও আছে বহাল তবিয়তে। জোড়ায় জোড়ায় চলে। উদাসী বাউল স্বভাব যেন এদের—সতর্কতা কম। আপন জগতেই মগ্ন থাকে। গ্রামবাংলার বসতবাড়ির পর্দা-বেড়ায় ঝোলানো শুকনো সুপারি পাতা, নারকেল-সুপারি-খেজুর ও তালের ঝুলে পড়া জ্যান্ত বা মরা পাতা এদের প্রিয় খাদ্য অন্বেষণের স্থান। অতএব, ঝোপঝাড়ে থাকা সোনাব্যাঙেরা লাফ দিয়ে উঠে মুখে পুরতে পারে, বনবিড়াল-বেজিরা দিতে পারে থাবা, দুষ্টু ছেলেপুলেরা চুপিসারে এগিয়ে গিয়ে ধরতে চাইতে পারে পাখিটিকে। এ রকম কোনো একটি কারণেই হয়তো ছবির পাখিটির লেজ খোয়া গেছে। অবশ্য লেজ আবার গজায়।
নিরীহ-শান্ত ও আনমনা-বোকাসোকা ধরনের পাখিটির নাম ‘ভ্যাদাটুনি’। ‘ভ্যাদা’ অর্থে বৃহত্তর খুলনায় বোঝায় মার খেয়েও যে প্রতিবাদ করতে পারে না বা ভয় পায়। বোধবুদ্ধিও কম। এই পাখিটার অন্য নাম ‘মোটা ঠোঁট ছাতারে’। ইংরেজি নাম Abbott’s Babbler। বৈজ্ঞানিক নাম Malacocincla abbotti। দৈর্ঘ্য ১৭ সেন্টিমিটার, ওজন ৩০ গ্রাম।
এদের মাথার তালু-পিঠ-লেজ ও পাখার উপরিভাগও জলপাই-বাদামি। গলা ধূসর-সাদাটে এবং চোখের ওপর দিয়ে একটি অস্পষ্ট সাদাটে-ধূসর রেখা বয়ে গেছে। বুকের কিছু অংশ ও তলপেট সাদাটে। পা ধূসর-গোলাপি। ঠোঁট ধূসর।
আলসে স্বভাবের ভ্যাদাটুনিরা অনেক সময় আশ্চর্য-অবিশ্বাস্য জায়গায় বোকার মতো বাসা করে। আনারসগাছের মাথায়, ঝুলে পড়া শুকনো সুপারি পাতার ভেতরে, বাঁশের কঞ্চির গোড়াসহ অন্যান্য যুৎসই স্থানে বাসা করে, তাতে ডিম পাড়ে দুই থেকে চারটি। ডিম গোলাপি। ডিম ফুটে ছানা হয় ১৩ থেকে ১৭ দিনে। বহুবার আমি এদের বাসা দেখেছি, প্রতিটি বাসার তলদেশেই দেখেছি তিন-চারটি কালো সরু বুনো লতা। নাম জানতে পারিনি। জানি না, ওই লতায় ডিম-ছানাদের জন্য কোনো প্রতিরোধী দ্রব্যগুণ আছে কি না!
এদের বাসায় কখনো কখনো কোকিলের মতো গোপনে ডিম পেড়ে যায় কোকিলের জাতভাই ‘বেগুনি কোকিল’ (Violet Cuckoo)। আকারে এটি ভ্যাদাটুনিরই সমান। সারা বাংলাদেশেরই বন-বাগান ও ঝোপঝাড় ছায়াছন্ন এলাকায় ভ্যাদাটুনিদের দেখা যায়। বাগেরহাটে এরা সুলভ পাখি। উঠান-বাড়ির কিনারের লাউ-শিমের মাচা বা অন্য গাছেও নির্ভয়ে চরে বেড়ায়।
Lazminur Alam:
ইংরেজি নাম Pallas’s Gull বা Greater Black-headed Gull। Laridae গোত্রের এই পাখির বৈজ্ঞানিক নাম Larus ichthyaetus।
গাঙচিলদের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম পালাসের গাঙচিলের দৈর্ঘ্য ৬০-৭২ সেন্টিমিটার, প্রসারিত ডানা ১৫৫-১৭০ সেন্টিমিটার এবং ওজন ০.৯- ২.০ কেজি। প্রজননকালীন প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা, গলাসহ মুখমণ্ডল ভেলভেট কালো। পিঠের পালক ধূসর ও বুক-পেটের নিচের পালক ধবধবে সাদা। ডানার বাইরের কয়েকটি পালকের আগা কালো, এ ছাড়া বাকি সব পালক সাদা। লম্বা ও সরু ঠোঁটটি কমলা-হলুদ ও আগা গাঢ় রঙের। চোখের ওপরে ও নিচে অর্ধচন্দ্রাকৃতির পট্টি রয়েছে। প্রজননহীন পাখির মুখমণ্ডল সাদা; তবে চোখের চারদিক, কান-ঢাকনি ও মাথার পেছনে বাদামি ছিটেফোঁটা থাকে। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের ওপরটা গাঢ় বাদামি, নিচটা ফ্যাকাশে ও ঠোঁট ধূসরাভ।
এরা সচরাচর দৃশ্যমান পরিযায়ী পাখি। উপকূলীয় এলাকা, জাহাজ বা লঞ্চঘাট, নদী ও হ্রদে বিচরণ করে। প্রজনন মৌসুম ছাড়া অন্য সময় সচরাচর একাকী বা দু-তিনটিতে একসঙ্গে থকে। তবে মাছের আধিক্য থাকলে একসঙ্গে বহু পাখি দেখা যায়। মাছ মূল খাদ্য হলেও প্রয়োজনে কাঁকড়া, চিংড়িজাতীয় প্রাণী, কীটপতঙ্গ, ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ, পাখি, ডিম ইত্যাদিও খেতে পারে। পানির সামান্য ওপরে উড়ে উড়ে খাদ্য সংগ্রহ করে। শীতে সচরাচর নীরব থাকে, কিন্তু মাঝে মাঝে উচ্চকণ্ঠে ‘ক্রি-অ্যাব ক্রি-অ্যাব ক্রি-অ্যাব’ স্বরে ডাকে।
গ্রীষ্মে মধ্য এশিয়া, উত্তর-পশ্চিম মঙ্গোলিয়া, চীনের উত্তরাঞ্চল ও তিব্বতে প্রজনন করে। সচরাচর মাটির ওপর অনেক পাখি একসঙ্গে কলোনি করে থাকে। শুকনো ঘাস-লতা ও দেহের ঝরা পালক দিয়ে মাটিতে বাসা বানায়। স্ত্রী দুই থেকে চারটি ঘিয়ে রঙের ডিম পাড়ে, যার ওপর থাকে কালো, খয়েরি বা ধূসর ছিটছোপ। ডিম ফোটে ২৫ দিনে। সদ্য ফোটা বাচ্চার কোমল পালকের রং ঘিয়ে-হলুদ বা রুপালি-সাদা। বাচ্চারা প্রায় পাঁচ দিনে বাসা ছাড়ে এবং চার-পাঁচ বছর বয়সে প্রজননক্ষম হয়।
Lazminur Alam:
রামগাংরা মারকুটে-ঝগড়াটে অতি চঞ্চল ও কোলাহলপ্রিয় পাখি। চালচলনে আছে একটা বেপরোয়াভাব। ডাকাডাকি করে সর্বক্ষণ জানান দেয় নিজের উপস্থিতি। পোকামাকড়ের বা প্রিয় ফলের নাগাল পেতে এরা গাছের সরু ডাল-পাতার শীর্ষে ঝুলে-দুলে প্রায়ই অ্যাক্রোবেটিক শো প্রদর্শনে খুবই পারঙ্গম। সাহসী পাখি বলে নিজের চেয়ে বড় পাখির দিকেও ধেয়ে যায় এরা। এই পাখিটিকে দেখলে হঠাৎ করে পুরুষ
চড়ুই বলেও মনে হতে পারে। তাই বোধ হয় এদের আরেক নাম ‘গাইছা চড়ুই’, তিতপোখ নামেও পরিচিত।
মূল খাদ্য গাছের ডাল-পাতা-বাকলের পোকামাকড়। পলেস্তারা খসা দালানের ইটের ফাঁকফোকরেও তল্লাশি চালায় পোকামাকড়ের খোঁজে। আখখেত, পাটখেত ও বেগুনখেতের পোকামাকড়ও খায়। খায় সফেদা, পেঁপে, আতাসহ আরও কিছু ছোট-বড় ফল।
দলে চলে, জোড়ায় চলে, চলে একাকীও। পাখিটির মাথার তালু ও গলা কুচকুচে কালো, চোখের নিচ থেকে প্রায় গলা পর্যন্ত ধবধবে সাদা। বুকের দুপাশ সাদা, গলার কালোটা একেবারে বুকের মধ্যিখান দিয়ে রেখার মতো বয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে তলপেটে। পিঠ ও লেজের আগার উপরিভাগ ঘন-ধূসর, ডানার উপরিভাগে সাদা সাদা সরু রেখা আছে কয়েকটা। ছোট ঠোঁটটির রং কালো। ধূসর-কালচে পা। পুরুষ ও মেয়ে পাখি দেখতে একই রকম।
এরা বাসা করে সুপারিগাছ, খেজুরগাছ, মোটা বাঁশগাছের ছোট মুখওয়ালা কোটর-ফোকরে। দরদালানের দেয়ালের ফোকরেও বাসা করে থাকে। স্টিলের খাম্বার বা পিলারের ফোকর থাকলে সেখানেও বাসা করতে পারে এরা।
বাসা সাজায় শুকনো সুপারির খোসা, আখের ছোবড়া, নারকেলের খোসা, শুকনো ঘাস ইত্যাদি দিয়ে। দুজনে মিলে বাসা সাজায়। খোঁড়লের গভীরতা বেশি হলে ওপরমুখো হয়ে পা আঁকড়ে বেয়ে বেয়ে তলায় নামে, ওঠেও বেয়ে বেয়ে একই কায়দায়। আমি ৫ ফুট থেকে ৯ ফুট গভীরতায় এদের বাসা সাজাতে দেখেছি। ছানাদের খাওয়াতে গিয়ে এরা পেরেশান হয়ে যায়। ডিম পাড়ে ৩ থেকে ৭টি। তা দেয় পালা করে। বউ যখন তায়ে থাকে, তখন পুরুষটি পরম মমতায় খাবার এনে বউটিকে খাওয়ায়।
রামগাংরার ইংরেজি নাম Great Tit। বৈজ্ঞানিক নাম Parus major। দৈর্ঘ্য ও ওজন যথাক্রমে ১৩ সেমি ও ১৩ গ্রাম। এরা আমাদের আবাসিক পাখি। ঢাকা শহরসহ সারা দেশেই দেখা মেলে এদের।
hussainuzaman:
চমৎকার তথ্যবহুল লেখা (সূত্র: প্রথম আলো)। উইকিপিডিয়াতে এই পাখির উপর অনেক ছবিসহ নিবন্ধ আছে; কিন্তু ইংরেজি, অসমীয়া সহ অনেক ভাষাতে থাকলেও বাংলা ভাষাতে নাই।
Lazminur Alam:
এ দেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি তামাটে মুনিয়া। কালোমাথা মুনিয়া নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Chestnut Munia, Indian Black-headed Munia বা Eastern Black-headed Munia. Estrildae পরিবারের সদস্য তামাটে মুনিয়ার বৈজ্ঞানিক নাম lonchura atricapilla. আগে এরা Lonchura malacca বা তিনরঙা মুনিয়ার (Tricolored Munia) একটি উপপ্রজাতি হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু ২০০০ সালে এদের তামাটে বা কালোমাথা মুনিয়া ও তিনরঙা বা খয়েরি মুনিয়া নামে দুটি পৃথক প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
তামাটে মুনিয়া ছোট আকারের পাখি। লম্বায় প্রায় ১১ সেন্টিমিটার ও ওজনে মাত্র ৯ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা, ঘাড় ও গলা চকচকে কালো। ডানা, পিঠ, বুক, পেট ও লেজ গাঢ় তামাটে। কোনো কোনো বংশধারার (Race) পাখির পেট ও লেজের তলা কালো এবং লেজের পালকে হলদে বা কমলার আভা দেখা যায়। শক্তপোক্ত ত্রিকোণাকার ঠোঁট হালকা নীলচে-ধূসর। পা, আঙুল ও নখ কালো। গাঢ় রঙের চোখ। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের পালক অনুজ্জ্বল দারুচিনি-বাদামি ও দেখতে হুবহু তিলা মুনিয়ার বাচ্চার মতো। মাথা-ঘাড়-গলায় কালো রং নেই। ঠোঁট গাঢ় নীলচে-ধূসর।
তামাটে মুনিয়া দীর্ঘ ঘাসবন, ধানখেত, জলাভূমি, আবাদি জমি ও বনের ভেতরের খোলা জায়গায় বা বনের কিনারায় বিচরণ করে। সচরাচর জোড়ায় বা ছোট দলে দেখা যায়। তবে তিনরঙা মুনিয়ার সঙ্গে মিশ্র ঝাঁকেও দেখা যেতে পারে। মিশ্র ঝাঁকে থাকলে ঝাঁকের চার-পাঁচ ভাগের এক ভাগ মাত্র হয় তামাটে মুনিয়া। অন্যান্য মুনিয়ার মতো বীজজাতীয় খাদ্য, যেমন ঘাসবিচি ও ধান-কাউন এদের প্রধান খাদ্য। মাটিতে খুঁটে খুঁটে বা ঘাস-ধান-কাউনের ছড়ায় উঠে খাবার খায়। শুধু পুরুষই ডাকে। ‘পি পি’ বা ‘পিট পিট’ শব্দে ডাকতে থাকে।
মে-নভেম্বর প্রজননকাল। মাটি থেকে ১-২ মিটার উচ্চতায় নলখাগড়া, ঝোপ, লম্বা ঘাস বা তাল-খেজুরগাছে শুকনো ঘাস ও চিকন কাঠিকুটি দিয়ে ডিম্বাকার বাসা বানায়। ডিম হয় ৫-৬টি। ডিমের রং সাদা। বাচ্চা ফুটতে ১২-১৫ দিন সময় লাগে। বাচ্চারা উড়তে শেখে প্রায় দুই সপ্তাহে। এরপর আরও ১-৩ সপ্তাহ বাবা-মায়ের সঙ্গে বাসায় থাকে। দুর্লভ এই মুনিয়াগুলো এ দেশের প্রকৃতিতে অনন্তকাল বেঁচে থাকুক।
Navigation
[0] Message Index
[#] Next page
[*] Previous page
Go to full version