বিলের টলটলে জলের ছয়-সাত ফুট ওপরে হোভারিং (দুই ডানা দ্রুত ঝাপটিয়ে শূন্যে স্থির থাকা) করছে সাদা পাখিটি। অতি দ্রুত পাখা নাড়ছে, ডানে-বাঁয়ে সামান্য সরছে, যেনবা উড়ছে একটি বড়সড় মৌমাছি। আশ্চর্য সুন্দর চিত্র যেন আঁকা হয়ে চলেছে শূন্যে, ছায়া পড়েছে টলটলে জলে। আচমকা মারল ডাইভ, ঠোঁটের ফাঁকে এক জোড়া শোলের পোনা চেপে ধরে শূন্যে যেন ছিটকে উঠল। উড়তে উড়তেই খাবার টুপুস করে গিলে আবারও শুরু করল হোভারিং। এ সময়ে আচমকা বড়সড় শোল মাছটা জল থেকে লাফিয়ে উঠল, পাকড়াও করতে চায় সে পোনার শত্রুটাকে। বিপদ বুঝে পাখিটা সটকে পড়ল।
পাখিটির নাম খুদে গাঙচিল। সাদা এই পাখিটার ঘাড়ের উপরিভাগসহ মাথা ও চোখজোড়া ঘন কালো, ওপরের ঠোঁটের গোড়ায় কপালের কাছে এক টিপ চন্দনের সাদা ফোঁটা যেন। সুচালো-লম্বা দর্শনীয় ঠোঁটটি হলুদ, আগাটা কালো। কমলা রঙের পা ও পায়ের নখর। এটা হলো বাসা বাঁধা মৌসুমের (ব্রিডিং পিরিয়ড) রং। ডিম-ছানা তোলার পরে পা ও ঠোঁট কালো হয়ে যায়। ডানার উপরিভাগসহ পিঠের রং ধূসরাভ-সাদা, গলা-বুক-পেট ও শরীরের পার্শ্বদেশ সাদা। দ্রুতগামী, চতুর ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন এই দুর্দান্ত ডাইভার পাখিটি শূন্যে ‘অ্যাক্রোবেটিক’ ও নানান রকম ডিসপ্লে প্রদর্শনে পারদর্শী। ধাওয়া দিয়ে ও অল্পস্বল্প ডুব দিয়ে মাছ শিকারে এরা খুবই পারঙ্গম। জলের উপরিভাগে উড়ে বেড়ানো এই পাখিদের মূল খাবার মাছ। পোকা-পতঙ্গ-ছোট ব্যাঙ-ব্যাঙাচি ও বড় মাছের পোনাও এদের কাছে প্রিয় খাবার। দিনের ১২ ঘণ্টার মধ্যে এরা গড়ে ৮ ঘণ্টাই ওড়ে, ফকফকে জোছনা রাতেও চরে, শিকার ধরে। হাওর-বাঁওড়-খাল-নদী-জলাশয়ই এদের মূল বিচরণক্ষেত্র। দূরে পাড়ি দেওয়ার সময় এরা অনেক উঁচুতে উঠে যায়।
বাসা করে বালুচর-নদীতীর বা এ রকমই জুতসই জায়গায়। অর্থাৎ মাটির ওপরে সংসার। জলখোর (Indian skimmer), বালি বাবুই ও গাঙচিলদের সঙ্গে মিলেমিশে কলোনির মতো বাসা করে। এতে মিলিত প্রতিরোধে ডিম-ছানা রক্ষা সহজ হয়। এই লেখার সঙ্গে যে ছবিটি ছাপা হলো, সেটিও বাসা করেছিল বৃহত্তর রাজশাহী জেলার এক নদীচরে। সেখানে ছিল অতি বিরল পাখি জলখোরদের বাসাও। কিন্তু মাঠ-চরের কর্মজীবী দুরন্ত ছেলেপুলেরাসহ বড়রা মিলে ওদের পেছনে লেগেছিল। জলখোররা তো তল্লাট ছেড়ে ভেগে গিয়েছিল। এদের ডিম খায় অনেকে।
প্রায় সারা দেশে দেখতে পাওয়া যায় পাখিটি। আমাদের দেশের সবচেয়ে ছোট এই গাঙচিলের নাম খুদে গাঙচিল। তবে বাগেরহাটে এদের নাম মেঘ কইতর ও কাজল চিল। ইংরেজি নাম little tern। বৈজ্ঞানিক নাম sterna albifrons। মাপ ২২-২৪ সেমি। মেয়ে ও পুরুষ দেখতে একই রকম। ডিম পাড়ে দুই-তিনটি। রং হয় সবুজাভ-হলুদাভ ও ধূসর রঙের মিশ্রণে। লালচে ও বাদামি ছিটছোপ থাকে। দুজনেই পালা করে তা দেয় ডিমে।