জবাবদিহিতার জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি প্রযুক্তিনির্ভর তথ্য ব্যবস্থাhttp://bonikbarta.com/magazine-post/323/%E0%A6%9C%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%8F%E0%A6%96%E0%A6%A8-%E0%A6%B8%E0%A6%AC%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%BF-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AF%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AD%E0%A6%B0-%E0%A6%A4%E0%A6%A5%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE/দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন মাহমুদুল হাসান খসরু, এফসিএ। স্বচ্ছতা, করপোরেট সুশাসন, বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, দেশে হিসাবচর্চা ও নিরীক্ষা সেবা নিয়ে সম্প্রতি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মাহফুজ উল্লাহ বাবুকরপোরেট সুশাসন ও জবাবদিহিতার আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিরীক্ষা। দেশে নিরীক্ষা খাতের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমাদের জানাবেন—
নিরীক্ষা দুই ধরনের হয়। একটি প্রতিষ্ঠানের ইন্টারনাল অডিট, অন্যটি এক্সটার্নাল। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (সিএ) ফার্ম মূলত এক্সটার্নাল অডিটের কাজটি করে থাকে। সেখানে আমরা দেখি, একটি কোম্পানির হিসাব বিভাগ যে প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে, তা যথার্থ কি না। দেশের নিরীক্ষা খাত সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই বলব, আমরা এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মানের ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড আত্মস্থ করেছি। সবচেয়ে ভালো দিকটি হলো, আইএফআরএসের (ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড) আদলেই বিএফআরএস (বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড) গৃহীত হয়েছে। সব পক্ষ এর যথাযথ অনুসরণে আন্তরিক হলে হিসাবচর্চায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যাবে। উন্নত হিসাবচর্চায় এরই মধ্যে আমাদের অনেক অর্জন সম্পর্কে আপনারা জেনেছেন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি কোম্পানি আঞ্চলিক পরিসরে সেরা আর্থিক প্রতিবেদনের পুরস্কার জিতেছে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো। আমাদের মনে রাখতে হবে, ভারতের অনেক কোম্পানি এখন বৈশ্বিক জায়ান্ট হয়ে উঠেছে। আমি স্থানীয় কোম্পানিগুলোর এ অর্জনকে অনেক বড় করে দেখছি।
এটি দেশের হাতে গোনা কিছু কোম্পানির চিত্র। সার্বিক চিত্রটি সন্তোষজনক বলা যাবে কি?
মোটেই সন্তোষজনক না। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়টি হলো, কোম্পানি নিবন্ধকের কার্যালয়ে (আরজেএসসি) প্রতি বছর এক লাখের বেশি নিরীক্ষিত প্রতিবেদন জমা পড়ে। কিন্তু আইসিএবির অফিশিয়াল উপাত্ত বলছে, সদস্য ফার্মগুলো এর এক-চতুর্থাংশের বেশি স্বাক্ষর করে না। এখন প্রশ্ন হবে, বাকিগুলো কে সই করে। হতে পারে সিএ ফার্মের জাল প্রত্যয়ন জমা দেয়া হচ্ছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে কোনো কোনো সিএ ফার্ম একটি দুর্বল প্রতিবেদন সই করে দিলেও প্র্যাকটিসিং লাইসেন্স হারানোর ভয়ে প্রফেশনাল কমিউনিটির কাছে তা অস্বীকার করছে— এটিও হতে পারে। যা-ই ঘটুক, এর অবসান দরকার। আইসিএবি এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। কোনো সদস্য প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হলে আইন অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর কোম্পানির ইন্টারনাল জালিয়াতি-অনিয়ম রোধে সংশ্লিষ্ট অথরিটিগুলোর আরো ভূমিকা দরকার।
পাবলিক সেক্টরের নিরীক্ষা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
পাবলিক অফিস ভিন্ন ফরম্যাটের অ্যাকাউন্টিং-অডিট প্র্যাকটিস করে। পাবলিক অ্যাকাউন্টসকে আরো যুগোপযোগী করার জোর প্রচেষ্টা এখন সারা বিশ্বেই চলছে। এ সপ্তাহেই সভাপতির নেতৃত্বে আইসিএবি থেকে আমরা কয়েকজন শ্রীলংকা যাচ্ছি। সেখানে পাবলিক অ্যাকাউন্টিং-অডিট এবং সেখানে সিএদের ভূমিকা বাড়ানোর ব্যাপারে আলোচনা হবে। আমাদের দেশে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সিএরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আইসিএবি এজন্য আন্তরিকভাবে প্রস্তুত।
মনে রাখতে হবে, করপোরেট অডিটের দুর্বলতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় শেয়ারহোল্ডার ও রাষ্ট্র। অন্যদিকে পাবলিক সেক্টরে অস্বচ্ছতার বলি হয় গোটা জাতি। আমি বলব, কোনোটিই কাম্য নয়।
একটি বিষয় নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, ই-টেন্ডারিং চালুর পর দরপত্র নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ শিরোনাম কত কমে গেছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এ যুগে প্রযুক্তিনির্ভর তথ্য ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিটি সেক্টরে, প্রতিটি অফিসে ই-ডাটাবেজ থাকলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে খুব সহজে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা যাবে। আমি বলব, জবাবদিহিতার জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর তথ্য ব্যবস্থা। আশার কথা হলো, বর্তমান সরকার এ বিষয়ে খুবই উদ্যোগী ও আন্তরিক।
উদাহরণ হিসেবে আমরা কর নিয়ে কথা বলতে পারি। কর ফাঁকি নিয়ে আমাদের হতাশা অনেক। প্রতিবেশী ভারতেও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সব তথ্য-উপাত্তে সরকারের ট্যাক্স অথরিটির পূর্ণ অ্যাকসেস আছে। আমাদের দেশেও সেটি করে দেয়া যেতে পারে। তখন টার্নওভার কমিয়ে দেখাতে চাইলে একটি কোম্পানিকে নগদে লেনদেন করতে হবে। এ যুগে এত ঝামেলা পোহানোর চেয়ে সরকারকে ট্যাক্স দেয়া অনেক সহজ।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর প্রতিবেদন নিরীক্ষার জন্য পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) হাতে গোনা কয়েকটি সিএ ফার্মের তালিকা করে দিয়েছে। ফার্মের এ সংখ্যায় আপনাদের ইন্ডাস্ট্রির বাস্তবতার কতটা প্রতিফলন ঘটছে?
বিএসইসি তাদের ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে কিছু ফার্মকে নির্বাচিত করেছে, যা আইসিএবি জানে না। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারহোল্ডাররা যাতে ভালো অডিট রিপোর্ট পান, এ উদ্দেশ্যেই বাছ-বিচারটি করা হয়েছে। তবে তালিকা করার আগে আইসিএবির সঙ্গে আলোচনা করলে কোনো অসুবিধা হতো বলে আমার জানা নেই। আইসিএবির সদস্য হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, প্যানেলে আরো ফার্মকে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ আছে।
অর্থনীতি ও করপোরেট সেক্টর যে হারে বাড়ছে, দেশে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট সেভাবে বাড়ছে না। এক্ষেত্রে প্রফেশনাল অডিটর সংকটের আশঙ্কা কতটা?
আমি মনে করি, সংকট এখনো রয়েছে। এখন পর্যন্ত আইসিএবির হাজার দেড়েক সদস্য রয়েছেন, যাদের একটি অংশ আবার এক্সটার্নাল অডিটের কাজ করেন না। মানসম্মত এক্সটার্নাল অডিটের জন্য অর্থনীতির সমান্তরালে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি বলব আরো বেশি গতিতে সিএর সংখ্যা বাড়াতে হবে। আমি মনে করি, যথাযথ সেবা প্রদানে এক দশকে আমাদের সদস্য সংখ্যা অন্তত ১০ গুণে উন্নীত করতে হবে। আমাদের একাডেমিক কাউন্সিল এজন্য কাজ করে যাচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সময়ে সহযোগী সদস্যদের কাজের সুযোগ বাড়িয়ে সমস্যার সমাধান করা যায় কি না— আমরা সেটি নিয়েও ভাবছি। শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সিএদের টিয়ার ওয়ান, টিয়ার টু এভাবে ভাগ করে তাদের জন্য আলাদা আলাদা কাজের ক্ষেত্র করা গেলেও ভালো হবে।
একটি সমস্যা সম্পর্কে বলতেই হবে, আমাদের করপোরেট সেক্টর ব্যবসায়ের কোনো খরচের ব্যাপারেই অনুদার নয়, শুধু এক্সটার্নাল অডিট ফি ছাড়া। শতকোটি টাকার টার্নওভারের একেকটি কোম্পানি এখনো দু-আড়াই লাখ টাকার বেশি ফি দিতে চায় না। অর্থনৈতিক উন্নয়নযজ্ঞে আমরা যেসব দেশকে প্রতিযোগী ভাবছি, সেখানে নিরীক্ষকের ফি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে তা ১০ গুণের বেশি হতে দেখা যায়। সিএ ফার্মের ফি বাড়লে নিরীক্ষা সেবার পেশাদারিত্ব ও মান অনেক বাড়বে।
যত দূর দেখি, কমিউনিটি হিসেবে আপনারা বেশ সংগঠিত। নিজেরা ঐকমত্যে গিয়ে সেটি বাড়াতে পারছেন না কেন?
প্রতিটি ফার্মই একমত। কিন্তু গ্রাহকদের মানস-কাঠামোয় পরিবর্তনটি এখনো সেভাবে হয়ে ওঠেনি। হাতে গোনো কয়েকটি কোম্পানি আছে, যারা নিরীক্ষককে যথেষ্ট ফি দিতে রাজি।
আমরা শুনি, গ্রাহক আকৃষ্ট করতে গিয়ে অনেক সিএ ফার্মই বড়সড় আপস করে। আপনাদের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা কেমন?
সব ইন্ডাস্ট্রির মতো আমাদের এখানেও প্রতিযোগিতা রয়েছে। ফার্মগুলোর ব্যবসায় সক্ষমতা, সেবার মান, ফি, গ্রাহকের সঙ্গে সম্পর্ক সবকিছুই নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রির মতোই আমাদের কোনো কোনো ফার্মের ব্যাপারে আপসের বিষয়টি সত্য হতেও পারে। তবে পেশাগত দায়িত্ব থেকে বিচ্যুতির প্রমাণ পাওয়া গেলে আইসিএবি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের শিক্ষা সনদ কেড়ে নেয়া না গেলেও তার প্র্যাকটিসিং লাইসেন্স কিন্তু আমরা বাতিল করতে পারি। শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অনেক উদাহরণও রয়েছে। তবে এজন্য প্রমাণটি অত্যাবশ্যক। উন্নত হিসাবচর্চার জন্য কোম্পানিগুলোরও আরো আন্তরিক হতে হবে, নিরীক্ষককে তো অবশ্যই।
হিসাবচর্চা উন্নত করতে দেশে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং আইন (এফআরএ) হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন?
এফআরএর আওতায় ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি) গঠন করা হবে। এক্সটার্নাল অডিটরদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে আগে আগে শুধু আইসিএবি কাজ করছিল, এখন এফআরসিও যুক্ত হবে। আইসিএবি প্রস্তাবিত এফআরসির সঙ্গে কাজ করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আমি চাই, এটি যেন নিছকই আরেকটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে গড়ে না ওঠে।
দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি কেমন দেখছেন?
দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। তবে অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তা আরো বাড়াতে হবে। সরকার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এটি আগামীতে অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দিতে সক্ষম। আমি দেখছি, বিদেশী কোম্পানিগুলো বিনিয়োগের ভালো সুযোগ খোঁজে।
শুধু সতর্ক থাকতে হবে, এসইজেডগুলো যেন নিছক ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে পরিণত না হয়। সেটি নিশ্চিত করতে হলে, কার্যকর সমন্বিত পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন জোরদার করতে হবে। সর্বোপরি পাবলিক-প্রাইভেট সব সেক্টরে চাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার চর্চা। আবারো বলব, এজন্য আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রযুক্তিনির্ভর তথ্য ব্যবস্থা।