শিক্ষক কি শুধুই শিক্ষক!

Author Topic: শিক্ষক কি শুধুই শিক্ষক!  (Read 908 times)

Offline Md. Fouad Hossain Sarker

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 424
  • FHS
    • View Profile
শিক্ষক কি শুধুই শিক্ষক!
« on: November 29, 2016, 12:16:46 PM »
শিক্ষা নিয়ে বহুল প্রচলিত প্রবাদ- ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ তা কে না জানে। কিন্তু আমাদের ছাত্র শুভ লিখেছিল, ‘শিক্ষকই জাতির মেরুদণ্ড’। তার এ কথাটি আমাদের চিন্তার জগতে নতুন মাত্রার সন্নিবেশ করে। এ প্রেক্ষাপটে শিক্ষা এবং শিক্ষকের পৃথকীকরণের যৌক্তিকতা খুঁজতে গিয়ে আমাদের শিক্ষকতার সফলতা-ব্যর্থতার চিত্র পরিমাপ করতে হয়েছে। কৌতূহল সৃষ্টি হচ্ছে আসলেই শিক্ষা কী, শিক্ষক কে এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মাত্রা কেমন হওয়া উচিত, সর্বোপরি সমাজ বিনির্মাণে একজন আদর্শ শিক্ষকের করণীয় কী হওয়া উচিত। আসলে আক্ষরিক অর্থে শিক্ষার ইংরেজি আভিধানিক শব্দ বফঁপধঃরড়হ। যা এসেছে লাতিন শব্দ বফঁপধৎব থেকে যার অর্থ হচ্ছে শিশুর প্রতিপালন। এজন্য শিক্ষা জন্মের পর থেকে শুরু হয়ে আমৃত্যু পর্যন্ত চলে। প্রবাদে আছে- ‘শিক্ষাই আলো’। কারণ শিক্ষা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজমান অন্ধকারকে দূর করে আলোর সমাজ গড়ে তুলে। নেলসন ম্যান্ডেলার মতে, ‘জীবন ও জগৎকে পরিবর্তন করতে পারে এমন নিয়ামকই হচ্ছে শিক্ষা’। আসলেই শিক্ষা একমাত্র মাধ্যম যা মানব মনের বিকাশ ও উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। শুধু তাই নয়, উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমেই সমাজ ও রাষ্ট্র তার উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে পারে। সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কস বলেছেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে সমাজের মৌল কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান’। সেদিক থেকে শিক্ষাকে সামাজিক পরিবর্তন ও উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। অধ্যাপক রঙ্গলাল সেন এজন্য শিক্ষাকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আধুনিক পৃথিবীতে শিক্ষাকে মোদ্দাকথায় দুটি ভাগে ভাগ করা যায়- যার একটি সাধারণ শিক্ষা, অন্যটি উচ্চশিক্ষা। এর মধ্যে সাধারণ শিক্ষা ব্যক্তিকে অর্থপূর্ণ জীবনযাপনে সক্ষম করে তোলে। উচ্চশিক্ষা ব্যক্তিকে সামগ্রিক জীবন কীভাবে অর্জন সম্ভব, সে চিন্তার সক্ষমতা দান করে। ছোট পরিসরে এসব আলোচনার পর আমরা বলতে পারি, মানুষের অন্তর্নিহিত গুণাবলীর বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণ করে বাস্তবজীবনে ভালো গুণগুলোর প্রয়োগ করার শক্তি ও নৈপুণ্য দান করাই শিক্ষা। এছাড়া শিক্ষাই একমাত্র পন্থা যা মানুষকে পার্থক্য বোঝাতে শেখায়। সেই পার্থক্য হচ্ছে- জ্ঞানীর সঙ্গে মূর্খের, দুর্নীতিগ্রস্তের সঙ্গে দুর্নীতিমুক্তের, উত্তম চরিত্রের সঙ্গে কুচরিত্রের, বীরের সঙ্গে কাপুরুষের, সত্যবাদীর সঙ্গে মিথ্যুকের, দেশপ্রেমিকের সঙ্গে দেশদ্রোহীর। আবার এ শিক্ষার গুণেই মানুষ নিজকে দ্বিতীয়বার জন্ম দিতে পারে। এজন্য সৈয়দ মুজতবা আলী ‘শিক্ষার লক্ষ্য’ প্রবন্ধে মানুষকে যথার্থই ‘দ্বিজ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।শিক্ষাকে যিনি বাস্তবে রূপ দেন তিনিই শিক্ষক। তত্ত্বীয় জ্ঞানে শিক্ষক বলতে শিক্ষা প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত বা ছড়িয়ে দেয়ার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকেই বোঝায়। কার্যত শিক্ষক এমন ব্যক্তিত্ব যিনি আলোকিত, জ্ঞানী এবং গুণী। তিনি বিবর্তন ও পরিবর্তনের অনুঘটক। তিনি আচার-আচরণ, চাল-চলন ও মননে এক অনুকরণীয় আদর্শ। তার সাফল্যের ভিত্তি হচ্ছে- নির্মল চারিত্রিক গুণাবলী, জ্ঞান আহরণ-সঞ্চারণে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা এবং পেশাগত অভিজ্ঞতা। শিক্ষক অবশ্যই সুবিচারক, যুক্তিবাদী, গবেষক এবং উদ্ভাবকও বটে। শিক্ষকের এসব গুণাবলীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে। আমেরিকান কবি ও সাহিত্যিক রাল্ফ ওয়াল্ডো এমারসনের মতে, ‘তিনিই শিক্ষক যিনি কঠিনকে সহজ করে তুলে ধরতে পারেন।’ শিক্ষকের কর্তব্য বুঝতে উইলিয়াম আর্থার ওয়ার্ডের বক্তব্যই যথেষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘মাঝারি মানের শিক্ষক বলেন, ভালো শিক্ষক বুঝিয়ে দেন, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক করে দেখান আর মহান শিক্ষক অনুপ্রাণিত করেন।’ প্রকৃত অর্থে একজন শিক্ষকই তার ছাত্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অপার সম্ভাবনার উন্মেষ ঘটাতে পারেন। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ছাত্রকে যোগ্য করে গড়ে তোলেন। তিনি প্রতিনিয়ত গণিত, ব্যাকরণ, সামাজিকবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের নানাবিধ জটিল বিষয়ের সমাধান উন্মোচন করেন। মেধা ও মননকে ব্যবহার করে তৈরি করেন আদর্শ ছাত্র।

আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য আরও অনেক বেশি। আধুনিক যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নতুন জ্ঞান সৃষ্টির উদ্ভাবক ও মানব সত্তার অগ্রযাত্রার নায়ক বলে চিহ্নিত করা হয়। একটি জাতির স্বপ্ন কত বড় এবং তারা মানসিকতায় কতটা উদার- তা সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। কারণ নতুন জ্ঞান সৃষ্টির পাশাপাশি মানব মনকে সংকীর্ণতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্ত করে বৃহৎ মানবসত্তা বিনির্মাণের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কই সবার ওপরে। এজন্য অনেকে সভ্যতার বিকাশের ইতিহাস এবং মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার ইতিহাসকে বিশ্ববিদ্যালয়েরই ইতিহাস বলে চিহ্নিত করেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক নানা নিয়মের ফ্রেমে আবদ্ধ। প্রাচীনকালে গুরুর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করত শিষ্যরা। শিক্ষকদের মুখনিঃসৃত বাক্য অক্ষরে অক্ষরে পালন করত তারা। অনেকটাই ছাত্রদের কাছে গুরু বা শিক্ষক ছিলেন সাক্ষাৎ দেবতা। সে সময় এখন আর নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্কের ধরনও পাল্টে গেছে। মুহম্মদ জাফর ইকবালের কথাতেই ফুটে ওঠে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি- ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমরা যখন আমাদের ছাত্রছাত্রীদের পাই, তারা তখন অনেক বড় হয়ে গেছে, তাদের চরিত্রের মূল কাঠামোটি দাঁড়িয়ে গেছে। তারা আমাদের দেখে খানিকটা ভয়, খানিকটা সন্দেহের চোখে। যদি আমরা ঠিকভাবে আমাদের দায়িত্ব পালন করি তখন হয়তো খানিকটা শ্রদ্ধা করে; কিন্তু তাদের ভালোবাসাটুকু আমরা কখনও পাই না।’ ফলে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে শ্রেণীকক্ষে মিথস্ক্রিয়া হলেও হৃদ্যতার জায়গা খালিই পড়ে থাকে। শ্রদ্ধা-মর্যাদার জায়গাটিও আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। শিক্ষক বুঝতে পারে না তার ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা কী, আবার প্রকারান্তরে ছাত্রছাত্রীরাও বুঝতে পারে না শিক্ষকদের স্থান কোথায়। ফলে শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর মনের কথা আবিষ্কারে ব্যর্থ হয়। অনেকে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ককে ‘জ্ঞানভিত্তিক গভীর বন্ধন’ বলে উল্লেখ করেন যা পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এ মিথস্ক্রিয়ার মধ্যেই ছাত্র-শিক্ষকের যে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেটিই প্রকৃত সম্পর্ক। এ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে শিক্ষক তার ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদাকে সমুন্নত রাখে। শিক্ষক হয়ে ওঠেন সবার ওপরে। যার প্রমাণ আমরা মহাগুরু সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটল-মহাবীর আলেকজান্ডারের মিলবন্ধনে দেখতে পাই। বাংলাদেশেও জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক-আহমদ ছফা-সরদার ফজলুল করিমের জ্ঞানর্চচার মাঝে এমন প্রবণতা দেখেছি।

আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের সাম্প্রতিক সংকটকে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি- আমরা ছাত্রছাত্রীদের গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী করছি ঠিকই; কিন্তু পার্থিব জীবনে বড় ধরনের কোনো স্বপ্ন তাদের মনে গেঁথে দিতে পারছি না। ফলে অনেকে হতাশার জলে ডুবে কিংবা ভুল প্ররোচনায় বিপথগামী হচ্ছে। এ সংকট উত্তরণের সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে- ব্যক্তিজীবনে সব ছাত্রছাত্রীর মনে আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন বুনে দেয়া। একজন আদর্শ শিক্ষক এখানেই সফল হন। তিনি আদর্শের প্রতীক রূপে সমাজ ও দেশ আলোকিত করেন এবং শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের রূপরেখাও তৈরি করে দেন। আমাদের কাছে মনে হয়- মানুষের বেঁচে থাকার ও বড় হওয়ার পূর্বশত একটাই- তা হচ্ছে স্বপ্ন লালন করা। কারণ স্বপ্নই মানুষের বেঁচে থাকার মানবীয় অক্সিজেন। আমাদের কাছে অনেক সময় ছাত্রছাত্রীরা তাদের আকাশছোঁয়া স্বপ্নের কথা বলে, কেউ আবার কীভাবে স্বপ্নকে জয় করতে পারবে তার পরামর্শ চায়। কেউ আবার তাদের স্বপ্নভঙ্গের নানা কাহিনী শোনায়। আমরা কাউকে হতাশ করি না। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, প্রত্যেক মানুষ কত বড় হবে, তা তার স্বপ্নের আকারের ওপর নির্ভর করে। যার স্বপ্নের আকার যত বড়, সে ততই বড়। যেমন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় ‘আমার জীবনের লক্ষ্য’ রচনা লিখতে গিয়ে লিখেছিলেন ‘আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে চাই’। আর সেই শিশুটিই আজ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। যে দেশের প্রেসিডেন্ট ভবনের নামই হোয়াইট হাউস, সেই দেশের একটি কৃষ্ণাজ্ঞ শিশু কীভাবে স্বপ্ন দেখে সেই দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার! এটাই স্বপ্নের শক্তি। একজন আদর্শ শিক্ষক এখানেই সফল, যদি তিনি প্রতিটি শিক্ষার্থীর মনে বড় স্বপ্ন দেখার বীজ বপন করে দিতে পারেন। অন্যদিকে যে শিক্ষার্থীর স্বপ্ন নেই কিংবা অতি ক্ষুদ্র, তাকে খোলসমুক্ত করে স্বপ্নের অনুরাগী করার দায়িত্বও আমাদের। এখানেও একজন সত্যিকার শিক্ষকের সার্থকতা।
সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে শিক্ষকদেরই ক্যাটালিস্টের ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে। সুশিক্ষার মাধ্যমে আগামী প্রজন্মকে করে তুলতে হবে যোগ্য, আত্মবিশ্বাসী ও আকাশছোঁয়া স্বপ্নচারী। ভালোবাসা ও মমতা দিয়েই এটা সম্ভব।

মো. ফুয়াদ হোসেন সরকার ও ফয়সাল আকবর : ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

http://www.jugantor.com/window/2016/11/29/80988/%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%95-%E0%A6%95%E0%A6%BF-%E0%A6%B6%E0%A7%81%E0%A6%A7%E0%A7%81%E0%A6%87-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%95!
Md. Fouad Hossain Sarker
Assistant Professor and Head
Department of Development Studies
Faculty of Humanities and Social Sciences
Daffodil International University
Dhaka-1207