২০১৬ সালের প্রিয় ‘পাগলেরা’
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী, সবচেয়ে সফল উদ্যোক্তাদের একজন—মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। অথচ ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র’ সূত্র মেনে এখনো তিনি প্রতিনিয়তই শিখছেন। যে মানুষটির কথা বহু তরুণকে অনুপ্রাণিত করে, তাঁর অনুপ্রেরণা কারা? সম্প্রতি নিজের অফিশিয়াল ব্লগে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন বিল।
আমার বয়স যখন বিশের কোঠার শেষ এবং ত্রিশের কোঠার শুরুর দিকে, তখন সমস্ত ‘পাগলামি’ ছিল সফটওয়্যার ঘিরে। পাগলামি বলতে বোঝাচ্ছি—প্রতিটি ঘরে ঘরে, ডেস্কে ডেস্কে কম্পিউটার পৌঁছে দেওয়ার নেশায় আমি এতটাই ডুবে গিয়েছিলাম যে আমাকে স্বাভাবিক জীবন ছাড়তে হয়েছিল। কোনো ছুটি নিতাম না। বিয়ে করার কোনো আগ্রহ ছিল না (যদিও পরে মেলিন্ডা এসে সব ভন্ডুল করে দিল!)। সবার আগে অফিসে ঢোকা এবং সবার পরে অফিস থেকে বের হওয়াকে আমরা মাইক্রোসফটের কর্মীরা ভীষণ গৌরবের ব্যাপার ভাবতাম। জীবনের সেই সময়টা সত্যিই দারুণ ছিল!
এখন আমার কাজ হলো, অন্য ‘পাগলদের’ কাছ থেকে শেখা। এই পাগলদের মধ্যে বিজ্ঞানী আছেন, যাঁরা নতুন কোনো আবিষ্কারের কথা ভাবছেন। শিক্ষক আছেন, যাঁরা নিজেদের পড়ানোর কৌশলটাকে আরও কার্যকর করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আছেন প্রকৌশলী, যাঁরা নতুন কোনো শক্তির উৎস খোঁজার স্বপ্নে বিভোর। তাঁদের স্বপ্নগুলো শোনার এবং তাঁদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমার জীবনে একটা চমকপ্রদ নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে।
২০১৬ সালেই এমন অনেক পাগলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, যাঁরা মন-প্রাণ দিয়ে নিজের কাজটি করে পৃথিবীকে বদলে দিতে চেষ্টা করছেন। তাঁদের কাজ দেখে আমি অনুপ্রেরণা পাই। আশায় বুক বাঁধি এই ভেবে, পৃথিবীর সেরা সময়টা এখনো সামনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আজ আমার প্রিয় কজন পাগলের কথা বলব। আমার বিশ্বাস তাঁদের গল্প আমার মতো আপনাকেও অনুপ্রাণিত করবে।
১. প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর
আমি আর মেলিন্ডা সম্প্রতি জর্জিয়ার প্লেইনস শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে জিমি ও রোজালিন কার্টারের সঙ্গে একটি সন্ধ্যা কাটানোর সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। ৯২ বছর বয়সেও জিমি কার্টার বুড়িয়ে যাননি। অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়াই জীবনের সর্বোচ্চ সাফল্য। অথচ জিমি কার্টারের জন্য, এটা ছিল কেবল শুরু! মানবাধিকার রক্ষার কাজে তিনি জীবন ব্যয় করেছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার পুরস্কার, নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর গড়া কার্টার সেন্টার দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিয়ে কাজ করছে। তিনি একজন লেখক। (তাঁর লেখা একটা বই পড়লাম। অ্যা ফুল লাইফ: রিফ্লেকশনস অ্যাট নাইনটি, তাঁর ব্যক্তিগত ও প্রকাশ্য জীবনের বেশ সাহসী স্মৃতিচারণ) তিনি এখনো শিক্ষকতা করেন। জিমি ও রোজালিন প্রতি মাসে ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের ক্লাস নেন। বাড়িতেও তাঁর অবসর নেই; আমি আর মেলিন্ডা ঘুরে দেখলাম, কয়েক বছর ধরে তিনি নিজের বাড়িটি নতুন করে সাজাচ্ছেন। অবসর সময়ে ছবিও আঁকেন! নিঃসন্দেহে এই মানুষটি আমাদের সবার জন্যই অনুপ্রেরণা হতে পারেন।
২. ‘পড়ুয়া’ চাষি
২০১৬ সালে যেসব নতুন কথা আমি শিখেছি, তার মধ্যে একটা হলো ‘নার্ড ফার্মার’ (‘পড়ুয়া’ চাষি)। ওয়াশিংটন শহরে এ বছর সেরা শিক্ষক হয়েছেন নেইট বোলিং। ক্লাসরুমে তিনি নিজেকে একজন নার্ড ফার্মার বলে পরিচয় দেন। তিনি বিশ্বাস করেন, কৃষকেরা যেমন ফসল ফলান, তেমনি তাঁর কাজ হলো ‘পড়ুয়া শিক্ষার্থী’ তৈরি করা।
গত জুনে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি বলছিলেন, ‘মজা করেই নিজেকে নার্ড ফার্মার বলে পরিচয় দিই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাণ্ডিত্য উৎপাদন করা আমার কাজ।’ নেইট পড়িয়ে থাকেন টাকোমার লিংকন হাইস্কুলে। এই স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই খুব দরিদ্র। অধিকাংশ দরিদ্র ছেলেমেয়েই যেখানে স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগে ঝরে পড়ে, সেখানে লিংকন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। নেইট ও তাঁর সহকর্মীরা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। লিংকন হাইস্কুলের শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েশনের হার ৮০ শতাংশের বেশি। উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর হারও ৪০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। নেইটকে দেখে আমি শিখেছি, কীভাবে ভালো শিক্ষক হতে হয়। কেমন করে শিক্ষার্থীদের জন্য পড়ার বিষয়গুলো আরও সহজ করা যায়; সব সময় তিনি এমন নতুন নতুন উপায়ই খুঁজতে থাকেন। যেমন নাগরিক অধিকার বোঝাতে তিনি তাঁর ছাত্রদের স্টার ওয়ার্স সিনেমা দেখান। কী দারুণ ব্যাপার, তাই না!
৩. ভারতের ‘পুনরোদ্যম’
এ বছর নভেম্বরে ভারত সফরে গিয়ে আমার নন্দন নিলকানির সঙ্গে দেখা হলো। তিনি ভারতের অন্যতম বহুল পরিচিত উদ্যোক্তা, মানবসেবী ও চিন্তক। ২০ বছর আগে তাঁর সঙ্গে একবার পরিচয় হয়েছিল। তখন তিনি মাত্রই ইনফোসিস নামে একটি প্রযুক্তি ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান শুরু করেছেন। তখন থেকেই তাঁর কাজের ধারা আমাকে মুগ্ধ করেছে। দেখেছি, কীভাবে তিনি উদ্যোক্তা হওয়ার বাসনা আর মানবসেবাকে এক সুতায় গেঁথেছেন। ২০০৯ সালে তিনি ইনফোসিস ছেড়ে দিয়ে ‘আধার’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন। ভারতে আধার হলো এক নতুন ধরনের বায়োমেট্রিক পরিচয়পত্র। ১০০ কোটিরও বেশি মানুষকে এই কার্ড বিতরণ করা হয়েছে। নন্দন এখন এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কীভাবে দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করা যায়, সেটাই ভাবছেন।
নন্দন আর তাঁর স্ত্রী রোহিনি মিলে ‘এক স্টেপ’ নামে একটি অলাভজনক প্রকল্প চালু করেছেন। এ প্রকল্পের মাধ্যমে স্মার্টফোন ব্যবহার করে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হবে। নন্দন সম্পর্কে আরও জানতে চাইলে পড়তে পারেন তাঁর লেখা বই, রিবুটিং ইন্ডিয়া: রিয়েলাইজিং অ্যা বিলিয়ন অ্যাসপিরেশনস।
৪. একসঙ্গে বহুদূর
একটা আফ্রিকান প্রবাদ আমি প্রায়ই বলি—‘যদি দ্রুত যেতে চাও, একলা চলো। আর যদি বহুদূর যেতে চাও, দলবেঁধে চলো।’ ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের প্রেসিডেন্ট অ্যানা মারি কসের কাজের মূল কথা এটাই। পৃথিবীর মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে তিনি দিন-রাত খেটে যাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুল, স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড এভুল্যুশন, পরিবেশবিজ্ঞান...বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন, সবাইকে তিনি এক করেছেন; যেন সবাই সবাইকে সহযোগিতা করে আরও কার্যকরভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন। অ্যানা মারি এ প্রকল্পটির নাম দিয়েছেন ‘পপুলেশন হেলথ ইনিশিয়েটিভ’। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘সুস্থতা বলতে শুধু অসুখ ও দুঃখ-কষ্ট থেকে দূরে থাকাই বোঝায় না। দারিদ্র্য, বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন...আরও অনেক কিছুই এর সঙ্গে জড়িত।’ তাঁর এই প্রকল্প শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছায়, সেটা দেখার জন্য আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি।
৫. আমার বিস্ময়কর শিক্ষক
‘শক্তি’বিষয়ক আলাপে, আমার প্রিয় শিক্ষক হচ্ছেন কেন ক্যালডেইরা। কার্নেগি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের একজন জলবায়ু গবেষক হিসেবে কেনের কাজ হলো—জলবায়ু, কার্বন এবং বিভিন্ন রকম শক্তি নিয়ে গবেষণা করা। যে দায়িত্ব তিনি খুব ভালোভাবেই পালন করছেন। মানুষের কার্যক্রম পরিবেশে কী কী প্রভাব ফেলছে, এ-বিষয়ক গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। কেনের যে বিষয়টি আমার সবচেয়ে ভালো লাগে, সেটি হচ্ছে জটিল বিষয়গুলোও তিনি আমার মতো সাধারণ মানুষের বোঝার উপযোগী করে ব্যাখ্যা করতে পারেন। তিনি বলেন, ‘মানুষকে আরেকটু কম স্বার্থপর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আমরা জলবায়ু সমস্যার মোকাবিলা করতে পারব না।’ তাঁর মতে, ‘জলদি একটি সমাধান না করে আমরা যদি মানুষের সচেতন হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকি, বড্ড দেরি হয়ে যাবে!’
Source:www.prothom-alo.com/education/article/1046091/২০১৬-সালের-প্রিয়-‘পাগলেরা’open_in_new