সরকারি ব্যাংকে সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাট, বিপুল খেলাপি ঋণ ও অব্যবস্থাপনায় ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান। তিনি বলেছেন, বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তারা চাকরি চলে যাওয়ার আতংকে কাজ করেন। কিন্তু সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তারা চাকরি পাওয়ার পর মনে করেন, এই চাকরি কখনও যাবে না। এ জন্য তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না। তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর অলস টাকা পড়ে আছে। অথচ গ্রামের মানুষ ঋণ পাচ্ছে না। তারা চাহিদার মাত্র ৪০ শতাংশ ঋণ পাচ্ছে এবং বাধ্য হয়ে ২৫ শতাংশ উচ্চ সুদে ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থার দ্বারস্থ হচ্ছেন।
একইভাবে সরকারি ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। তার মতে, ব্যাংকিং খাতের জন্য সুশাসন ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়া জরুরি। গত সেপ্টেম্বর শেষে শুধু সরকারি ৬ ব্যাংকেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মোট ঋণ বিতরণের ২৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর মধ্যে ২১ দশমিক ২৯ শতাংশই মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। আদায় অনিশ্চিত এসব ঋণ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
একই সঙ্গে রূপালী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের ৩০ শতাংশ ২০ শীর্ষ খেলাপির কাছে চলে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন গভর্নর।
শনিবার রাজধানীর খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইন্সটিটিউটে রূপালী ব্যাংকের বার্ষিক ব্যবসায়িক সম্মেলনে ব্যাংকিং খাতের উভয় অভিভাবক এসব ক্ষোভ ও উদ্বেগের কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ও বিশেষ অতিথি ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান। সম্মেলনে বক্তৃতা করেন রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনজুর হোসেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ফজলুল হক, পরিচালক অরিজিত চৌধুরী, অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশিদ, আবদুল বাসেত খান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান প্রমুখ।
গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ব্যাংকগুলোর মূল কাজ ঋণ বিতরণের মাধ্যমে ব্যবসা করা। এই ব্যবসা করতে হবে নিয়ম মেনে। তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশন বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষকে ভয় পেতে হবে না। তিনি বলেন, রূপালী ব্যাংক লাভ করতে না পারলেও লোকসান ও লোকসানি শাখা কমিয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ২০১৭ সালকে ঘুরে দাঁড়ানোর বছর হিসেবে ঘোষণা করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তিনি আরও বলেন, কৃষি খাতের মতো এসএমই খাতেও ঋণ প্রদান বাধ্যতামূলক করার চিন্তা করা হচ্ছে। ঋণকে কেন্দ্রীভূত না করে এসএমই খাতে ছড়িয়ে দিতে হবে। বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে এসএমই ঋণ বেশি দেয়ার তাগিদ দেন তিনি। তার মতে, প্রতি বছর ১৮ থেকে ২০ লাখ লোক কর্মবাজারে আসেন। জামানত ছাড়া এরা ব্যাংক ঋণ পান না। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকদের প্রশিক্ষণকেই জামানত হিসেবে বিবেচনা করে তাদের ঋণ প্রদান করতে হবে। তিনি বলেন, ভোক্তা ঋণের কোনো জামানত নেই। এসব ঋণে অনিয়মও কম হয়। এখন জামানত ছাড়া ঋণ দেয়ার সময় এসেছে। তবে এ ধরনের ঋণে তদারকি বেশি করতে হবে। ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় নজর দিতে হবে। সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষরিত শর্তগুলো পরিপালন করতে হবে। কোনোভাবেই একক ঋণ সীমা অতিক্রম করা যাবে না। ব্যাংকিং খাতে সমস্যা থাকবে, সমস্যা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগোতে হবে। ভয় পেলে চলবে না।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা অন্য সরকারি কর্মচারীদের মতো আচরণ করছেন। কিন্তু এটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এখানে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হয়। তাদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। কিন্তু কেউ কাজ দ্বিগুণ হারে করছেন বলে মনে হয় না। মন্দ ঋণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এক কর্মকর্তার দেয়া ঋণখেলাপি হয়ে গেলে অন্য কর্মকর্তা তা আদায় করতে চান না। এটা বন্ধ করতে হবে।
রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনজুর হোসেন বলেন, ব্যাংকের কর্মকর্তারা চাইলে সব সমস্যা সমাধান করতে পারেন। নিজেদের একগুঁয়েমির কারণে হোক বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে হোক ব্যাংকের কর্মীরা ভুল করেছেন। নিজেদেরই তা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, বড় ঋণখেলাপিরা যতই প্রভাবশালী হোক তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যা করণীয় করতে হবে। আগে রূপালী ব্যাংকের অফিসে অন্য অফিসের লোকজন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। ইউনিয়নের নামে ঋণ বিতরণ, কর্মী নিয়োগ, পদোন্নতি বদলি ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলত। এগুলো অনেকাংশে এসব বন্ধ করা গেছে।
আতাউর রহমান প্রধান বলেন, রূপালী ব্যাংকে আগে খেলাপি ঋণকে নিয়মিত দেখিয়ে ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশনিং (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) না করে মুনাফা দেখানো হয়েছে। গত ২০১৫ সালে ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে বলে মিথ্যা রিপোর্ট সরকারকে দিয়ে তার বিপরীত কর পরিশোধ করে ব্যাংকটির ক্ষতি করা হয়েছে। আমি দায়িত্ব নিয়ে সবার আগে সঠিক হিসাব করেছি।