সার্চ কমিটির সুপারিশ নিয়ে শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের একটি চমক অপেক্ষা করছে। যেখানে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া কারও নাম নাও থাকতে পারে। দুই দলের দেয়া নামের পরিবর্তে দেখা যেতে পারে ভিন্ন কাউকে। বিতর্কমুক্ত, নিরপেক্ষ, নির্দলীয় ও সাহসী নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের লক্ষ্যে সার্চ কমিটি এমন কৌশলী অবস্থান নিতেই পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, প্রধান দুই দলের তালিকা প্রাধান্য দেয়া হলে বিতর্ক পিছু ছাড়বে না। আগামীকাল সোমবার এ তালিকা চূড়ান্ত হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা চমক চাই না। আমরা চাই যোগ্য, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন। সার্চ কমিটির আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নাম দিয়েছে। কোন দল কাদের নাম দিল, তাও প্রকাশ করা উচিত। এ তালিকা যাচাই-বাছাই শেষে যাদের নাম সিইসি এবং ইসি হিসেবে নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ করা হবে তাদের নামও আগেই প্রকাশ করা উচিত। তিনি আরও বলেন, দেশের মালিক জনগণ। এ জনগণকে অন্ধকারে রাখার অধিকার কারও নেই। মালিকদের কাছ থেকে তথ্য গোপন রাখাও ঠিক হবে না।
সূত্র জানায়, দুই প্রধান দলের তালিকা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এখন পর্যন্ত ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি তেমন নাম পায়নি। দল দুটির তালিকা বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে কমিটির জন্য এটা শক্ত যুক্তি হতে পারে। অবশিষ্ট থাকে অন্য দলগুলোর দেয়া নামের তালিকা বিশ্লেষণ। বিশেষজ্ঞদের যুক্তি হচ্ছে, অন্য দলগুলোর দেয়া নামের অধিকাংশ প্রথমদিনই বাদ দেয়া হয়েছে। ১২৫ জনের নাম থেকে বাদ দেয়ার পরই ২২ জনের তালিকা করা হয়। অনাগ্রহ, বার্ধক্য ও অসুস্থতার কারণে এ সংক্ষিপ্ত তালিকাও ছোট হয়ে গেছে। এরপরও যোগ্য কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না কমিটি। এদিকে সময় শেষ হয়ে আসছে। সোমবার বসে ১০ জনের নাম চূড়ান্ত করার কথা। এ অবস্থায় দল থেকে পাওয়া নাম বাদ দিয়ে অন্যভাবে সংগৃহীত নাম চূড়ান্ত করার সম্ভাবনা আছে। কমিটির সদস্যরা নিজেদের পছন্দের নাম দেবেন এবং অন্য কোনো উৎস থেকে পাওয়া নাম অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এ নামগুলো থেকেই ১০ জনের তালিকা চূড়ান্ত করার সম্ভাবনা আছে। এক্ষেত্রে তারা প্রভাবশালীদের পছন্দের নাম বাদ দিতে পারবেন বলে মনে করেন না বিশেষজ্ঞরা। শেষ পর্যন্ত যদি বাস্তবে এটাই হয়, তবে এটিই হবে সার্চ কমিটির বড় চমক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের কারও নাম রাখা সম্ভব না হলে বিতর্ক এড়াতে আওয়ামী লীগের তালিকাভুক্তদের কাউকে রাখতে নারাজ সার্চ কমিটির সদস্যরা। তার মানে এ নয়, যাদের নাম দিয়ে চূড়ান্ত তালিকা হবে তারা ক্ষমতাসীনদের অপছন্দের কেউ হবেন। শাসক দল আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিকদের পছন্দের লোকের নামই তালিকাভুক্ত করা হবে। এ নামগুলো ক্ষমতাসীনদের শরিকদের পক্ষ থেকেও প্রস্তাব আসতে পারে। সার্চ কমিটি তাদেরও বাছাই করতে পারে। সেক্ষেত্রে সার্চ কমিটিও বিতর্কমুক্ত হবে। তারা বলতে পারবেন বিভিন্ন দলের কাছ থেকে প্রাপ্ত নামই তারা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব করেছেন। এ কৌশলী অবস্থানকে ভিন্ন চোখে বিশ্লেষণ করছে বিএনপি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সাধারণ মানুষ বলছেন, কী হবে, জনগণের বদ্ধমূল ধারণা আগে থেকে যা ঠিক করে রাখা হয়েছে তাই হবে। আমরাও দেখতে চাই, রাষ্ট্রপতি নতুন কিছু করতে পারেন কিনা। জনগণ প্রকৃত অর্থে যা দেখতে চান তার প্রতিফলন ঘটাতে পারেন কিনা। আমরা আশা করব, অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এ রাজনীতিক (রাষ্ট্রপতি) যে জায়গায় আছেন, সেখান থেকে জাতিকে এ সংকটমুক্ত করবেন।
নানা সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে বড় দলের তালিকা বাদ দিয়ে নিজেদের মতো করে ১০ জনের একটি খসড়া তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। এতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে দু’জন সাবেক আমলার নাম রাখা হতে পারে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনার পদে ৮ জনের নাম বিবেচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে দু’জন নারীর নাম থাকতে পারে। এখান থেকে সিইসিসহ ৫ জনকে নিয়োগ দিতে পারেন রাষ্ট্রপতি। কমিশনার পদে প্রস্তাবিত আটজনের মধ্যে একজন এনজিও ব্যক্তিত্ব, একজন শিক্ষাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত দুই বিচারপতি, পুলিশের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, দু’জন সাবেক সেনা কর্মকর্তা এবং স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ একজন।
সার্চ কমিটির সদস্যরা আগামীকাল সোমবার শেষবারের মতো বৈঠকে বসবেন। বিকাল ৫টায় সুপ্রিমকোর্ট জাজেজ লাউঞ্জে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এ বৈঠকেই আরও একদফা যাচাই-বাছাই শেষে সিইসি এবং ইসি পদে নিয়োগের জন্য ১০ জনের নাম চূড়ান্ত করবেন তারা। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মাধ্যমে ওই দিনই নামের তালিকা বঙ্গভবনে পাঠানো হবে। পরদিন মঙ্গলবার সংবিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ সাপেক্ষে নতুন সিইসি এবং ইসি নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
এর আগেই সার্চ কমিটির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২৬টি রাজনৈতিক দল ১৩১ জনের নাম দেয়। এ নামগুলো থেকে ২২ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে সার্চ কমিটি। এর আগে প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শেষ করেন কমিটির সদস্যরা। বৃহস্পতিবার আরও একদফা বৈঠক করে সার্চ কমিটি। এ বৈঠকেই তালিকা কাটছাঁট হয়। নাম ঠিক করার আগে ১৬ বিশিষ্ট নাগরিকেরও পরামর্শ নেয় সার্চ কমিটি।
উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২৫ জানুয়ারি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক, মহাহিসাব নিরীক্ষক (সিএজি) মাসুদ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক শিরীন আখতার।