সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের পদটি ২০১৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করেছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় কৌশলে প্রধান শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণ করে ১১ (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত) ও ১২তম গ্রেডে (প্রশিক্ষণবিহীন), যা সাধারণত তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর বেতন। এখানেই শেষ নয়, দীর্ঘ আড়াই বছরেও প্রধান শিক্ষকদের নাম অনুযায়ী গেজেট প্রকাশ করেনি মন্ত্রণালয়। ফলে গেজেটেড কর্মকর্তার মর্যাদাও ভোগ করতে পারছেন না প্রধান শিক্ষকেরা।
অন্যদিকে আগে সহকারী শিক্ষকেরা প্রধান শিক্ষকদের মাত্র এক ধাপ নিচের স্কেলে বেতন পেলেও ওই সময় তাঁদের বেতন দুই ধাপ নিচে নেমে যায়। এ নিয়ে দাবি থাকলেও তার সুরাহা হচ্ছে না। সহকারী শিক্ষকেরা চাকরিজীবনে একবারই পদোন্নতি পেয়ে প্রধান শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পান, কিন্তু সেটিও বন্ধ হয়ে আছে প্রায় আট বছর।
মর্যাদা, বেতন, পদোন্নতি, বদলিসহ পদে পদে অবহেলার শিকার হচ্ছেন মানুষ গড়ার ‘আসল কারিগর’ হিসেবে পরিচিত দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। অথচ তাঁরা কারও চেয়ে কম পরিশ্রম করেন না। পড়ানোর পাশাপাশি ভোটার তালিকা, সরকারির বিভিন্ন জরিপ থেকে শুরু করে নানা কাজ করতে হয় প্রাথমিকের শিক্ষকদের।
এমন পরিস্থিতি নিয়ে আজ ৫ অক্টোবর পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে পৃথক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এবারের স্লোগান ঠিক করা হয়েছে, ‘শিক্ষকদের মূল্যায়ন, মর্যাদার উন্নয়ন’।
প্রাথমিক শিক্ষকদের অবহেলার বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আলমগীর বলেন, অবহেলা থাকবেই। তিনি নিজেও অবহেলার শিকার। আর প্রধান শিক্ষকদের গেজেটেড মর্যাদার বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁরা নন-গেজেটেড কর্মকর্তা। সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষকদের দুই ধাপ নিচে রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, আর এক ধাপ ওপরে দিলে তাঁদেরও কর্মকর্তা করতে হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৩ হাজার ৬০১টি। এসব বিদ্যালয়ে ২ কোটি ১৯ লাখ ৩২ হাজার ৬৩৮ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। মোট শিক্ষক আছেন ৩ লাখ ২২ হাজার ৭৬৬ জন। সংখ্যার দিক দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকেরাই দেশের সবচেয়ে বড় পেশাজীবী গোষ্ঠী।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ও কয়েকজন শিক্ষক বলেন, মানসিকভাবেই প্রাথমিক শিক্ষক তথা শিক্ষাকে গুরুত্বহীনভাবে দেখা হয়। এ কারণে মেধাবীরা এই পেশায় আসেন না। অথচ বিশ্বের অনেক দেশে প্রাথমিক শিক্ষাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের পদ নিয়ে সর্বশেষ খারাপ উদাহরণটি হতে যাচ্ছে ৩৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণ ৮৯৮ জনকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগের সুপারিশ করা নিয়ে। নন-ক্যাডার দ্বিতীয় শ্রেণির পদের অন্য প্রার্থীরা ১০তম গ্রেডে যোগদান করছেন। কিন্তু প্রাথমিকের এসব প্রার্থী নিয়োগের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করলে তাঁদের বলা হয়, ১২তম গ্রেডে (১১,৩০০ টাকা) যোগ দিতে হবে।
এই পদে সুপারিশ পাওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা এক ছাত্র প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশা করেছিলাম অন্য নন-ক্যাডারদের মতো ১০ম গ্রেডে নিয়োগ পাব, কিন্তু এখন যেভাবে বলা হচ্ছে, তাতে আর যোগদান করা সম্ভব হবে না। এ রকম করলে এই পেশায় মেধাবীরা আর আসতেই চাইবেন না।’
রাজধানীর হাজারীবাগের একটি বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেন, ১৯৯৬ সালের আগে শিক্ষকেরা পদোন্নতি পেয়ে উপপরিচালকসহ ওপরের পদগুলোতে যেতে পারতেন, কিন্তু সেই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির নেতা এস এম ছায়িদ উল্লা বলেন, গুণগত মানের প্রাথমিক শিক্ষা চাইলে শিক্ষকদেরও যথাযথ বেতন, মর্যাদা, পদোন্নতিসহ অন্যান্য সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
রাজধানীর একটি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বলেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে পাস করে ছয় বছর ধরে এই পেশায় আছেন। শিক্ষক হওয়াই তাঁর স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বেতন ও মর্যাদায় তাঁদের অনেক পেছনে রাখা হয়েছে।