কিডনি রোগের ঝুঁকি স্থূলতায় ।। অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ
কিডনি রোগের ঝুঁকি স্থূলতায়
বিশ্বব্যাপী মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ‘বিশ্ব কিডনি দিবস’ পালন করা হয়। সে অনুযায়ী এ বছর, বৃহস্পতিবার, (০৯ মার্চ) বিশ্বব্যাপী উদযাপন করা হচ্ছে ‘বিশ্ব কিডনি দিবস-২০১৭’।
বিশ্ব কিডনি দিবসের উদ্দেশ্য হলো এ রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা এবং কিডনি রোগ প্রতিরোধে গণসচেতনতা সৃষ্টি। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘স্থূলতা কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়, সুস্থ কিডনির জন্য প্রয়োজন সুস্থ জীবনধারা’।
বিশ্বব্যাপী কিডনি রোগ দিন দিন মহামারী আকার ধারণ করছে। বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটিরও বেশি মানুষ কোনো না কোনো কিডনি রোগে আক্রান্ত। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি ঘণ্টায় অকাল মৃত্যুবরণ করছে পাঁচজন। সাধারণত ৭৫ শতাংশ কিডনি নষ্ট হওয়ার আগে রোগীরা বুঝতেই পারেন না যে, সে ঘাতক ব্যাধিতে আক্রান্ত। কিডনি যখন বিকল হয়ে যায় তখন বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় কিডনি সংযোজন অথবা ডায়ালাইসিস। অন্যদিকে কিডনি রোগের চিকিৎসা এতোই ব্যয়বহুল যে, এদেশের শতকরা ১০ শতাংশ লোকেরও সাধ্য নেই এই ব্যয়-বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ স্থূল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীর যতো মৃত্যু হয় পুষ্টিহীনতার জন্য, তার চেয়ে বেশি মৃত্যু অতিভোজন ও অতি ওজনের কারণে। মানুষের মৃত্যুর জন্য প্রথম ১০ ঝুঁকির মধ্যে স্থূলতা একটি। বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৫ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে মৃত্যুর জন্য দায়ী অসংক্রামক ব্যাধিগুলো। আর স্থূলতা জন্ম দেয় জীবন ঝুঁকিতে ফেলা এসব অসংখ্য ব্যাধির। এর মধ্যে প্রধান রোগগুলো হলো; উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, হাড়-জোড়ার ক্ষয় ও ব্যাথা, স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ঘুমের মধ্যে শ্বাস বন্ধ হওয়া ও নাক ডাকা, মেটাবোলিক সিন্ড্রম, মানসিক অবসাদ ও নিরানন্দভাব, কোলন ও ব্রেস্ট ক্যান্সার এর মতো মারাত্বক ব্যাধি।
স্থূলতার সঙ্গে কিডনি রোগের সম্পর্ক সরাসরি। বাড়তি ওজন সরাসরি কিডনির ছাকনি নষ্ট করে দেয়। অন্যদিকে বাড়তি ওজন ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের কারণ যা কিডনি বিকলের অন্যতম কারণ।
শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে পরিবেশগত কারণে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাবে পল্লি অঞ্চলের মানুষের মধ্যেও ওজন বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে। একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, গর্ভবতী মায়েদের ২১ শতাংশ স্থূল, ৪০ শতাংশ মাত্রাতিরিক্ত ওজন, অন্যদিকে মাত্র ৩৩ শতাংশ মায়েদের ওজন স্বাভাবিক। অথচ অতিরিক্ত ওজনের জন্য মা ও শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি।
স্থূলতা প্রতিরোধে করণীয়:
স্বাস্থ্যকর সুষম পরিমিত খাবার এবং সুস্থ জীবনধারার চর্চা সুস্থ থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একবার মুটিয়ে গেলে, তা নিয়ন্ত্রণে আনা অনেক কঠিন। কিন্তু আমরা একটু সচেতন হলে, আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা যদি স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পালন করতে পারি, তবে স্থূলতার ভয়াল থাবা থেকে আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের রক্ষা করতে পারবো।
শিশুদের ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ালে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা কমে যায়। কিশোর ও যুবকদের ক্ষেত্রে কম্পিউটার, দীর্ঘক্ষণ ভিডিও গেমস, ফেসবুক, চ্যাটিং ও টেলিভিশনের সামনে সময় কাটানোর পরিবর্তে খোলা মাঠে খেলাধুলা, ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম করতে উৎসাহিত করতে হবে। ধীরে ধীরে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। সুস্থ জীবনধারায় উৎসাহিত করতে বাবা-মাকে রোল মডেল হিসেবে কাজ করতে হবে।
বড়দের ক্ষেত্রে ওজন নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যসম্মত কম ক্যালরিযুক্ত সুসম খাদ্যের অভ্যাস ও নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম এবং ব্যায়াম ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটতে হবে। প্রতিদিন নিজের ওজন লিখে রাখতে হবে। অফিসে চেয়ারে বসার কাজ থাকলেও উঠে গিয়ে হাঁটতে হবে। লিফট পরিহার করে, সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার অভ্যাস করতে হবে।
অতিরিক্ত চর্বি, চিনি বা ক্যালরিযুক্ত খাবার পরিহার করে পর্যাপ্ত পরিমাণে শাক-সবজি ও আঁশ যুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। মিহি খাবারের পরিবর্তে গোটা শস্য; যেমন- লাল চাল, গমের রুটি খেতে হবে। ক্ষুধার্ত হলেই কেবল খাওয়া উচিত, অযথা বা অপ্রয়োজনীয় খাবার বর্জন করা উচিত। কাউকে খুশি করার জন্য বা ভালো কাজের পুরস্কার হিসেবে মজার খাবার না দিয়ে, ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হবে। কোমল পানীর পরিবর্তে সাধারণ পানি পানে উৎসাহিত করতে হবে।
এটা স্পষ্ট যে, শহরে হাঁটার রাস্তাগুলো এমনিতেই সরু, তার ওপর এগুলো হকারদের দখলে। হাঁটার জায়গা কোথায়! বেশির ভাগ স্কুলে খেলার মাঠ নেই। নগর পরিকল্পনাবিদদের এদিকে নজর দিতে হবে।
সবশেষে বলা যায়, সুস্থ সুন্দর জীবনের জন্য সুস্থ জীবনধারা। নিজে চর্চা করুন এবং সন্তানদের উৎসাহিত করুন। এতে আপনি সুস্থ থাকবেন, জাতি পাবে কর্মঠ ও সুস্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
লেখক
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ
http://forum.daffodilvarsity.edu.bd/index.php?action=post;board=295.0