মধ্যরাতে ছয় ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও কার্টুন চ্যানেল বন্ধ রাখতে চায় সরকার। এ জন্য সর্বশেষ জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে নেওয়া সিদ্ধান্তের আলোকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগকে বলেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এতে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
সরকার মনে করছে, গভীর রাত পর্যন্ত ফেসবুক ব্যবহারের ফলে ছাত্রছাত্রী ও তরুণ-তরুণীদের পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটছে। এতে সামগ্রিকভাবে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর কর্মদক্ষতা কমে যাচ্ছে। কার্টুন চ্যানেলগুলো ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকার ফলে শিশুরা গভীর রাত পর্যন্ত কার্টুন দেখছে। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ায় এতে শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ গতকাল সোমবার জানিয়েছে, সরকার এ বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। অবশ্য গতকালই এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) মতামত চেয়ে চিঠি পাঠায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। আবার বিটিআরসিও গতকাল চিঠির জবাব দিয়ে জানিয়েছে, এভাবে ফেসবুক বন্ধ করা ঠিক হবে না। এ বিষয়ে তারা কিছু যুক্তিও দেখিয়েছে।
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগসচিব শ্যাম সুন্দর শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ বিষয়ে মতামত চেয়ে চিঠি এসেছে। আমরা বিটিআরসির কাছে মতামত চেয়েছি, এরপর আমাদের মতামত দেওয়া হবে।’
শ্যাম সুন্দর শিকদার বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি এটা বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। শুধু তো বাচ্চাদের কথা ভাবলে চলবে না, আমাদের ব্যবসায়ী যাঁরা আছেন, তাঁরা মধ্যরাতেই বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগটা বেশি করেন। এটা হুট করে বন্ধ করার কোনো বিষয় না।’
মধ্যরাতে ফেসবুক ও কার্টুন চ্যানেল বন্ধ রাখার বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে গত আগস্টে অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে। ওই বৈঠকে ফেসবুক ও কার্টুন চ্যানেলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানান জেলা প্রশাসকেরা। তখন প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে নির্দেশ দেন। এরপর এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মতামত চেয়ে গত আগস্টেই একটি চিঠি দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কিন্তু সাত মাসে এ বিষয়ে কোনো জবাব না পাওয়ায় গত ২৩ মার্চ ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগকে আরেক দফা চিঠি পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতেই মতামত চেয়ে গতকাল ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ বিটিআরসিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠিটি পাঠায়।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে গতকাল পাঠানো বিটিআরসির মতামতে বলা হয়েছে, বর্তমানে ফেসবুক শুধু একটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নয়। এটি ব্যবহার করে সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে নারীরা অনলাইনে ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন করেন। কারিগরিভাবে কেবল ছাত্রছাত্রীদের জন্য ফেসবুক বন্ধ করা সম্ভব নয়। কারণ, এখানে বয়স নিশ্চিত করার কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেই। ফেসবুক ইন্টারনেট গেটওয়ে থেকে বন্ধ করা হলেও বিভিন্ন ভিপিএন বা প্রক্সি সার্ভারের মাধ্যমে ব্যবহার করা সম্ভব। বিটিআরসি আরও বলেছে, ফেসবুক বন্ধ করলেও ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপের মতো মাধ্যম দিয়েও যোগাযোগ করা সম্ভব। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ, আমেরিকায় যোগাযোগ করার জন্য মধ্যরাত বেশি সুবিধাজনক।
নিজেদের মতামতে ছাত্রছাত্রী ও তরুণ-তরুণীদের ফেসবুক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পরামর্শও দিয়েছে বিটিআরসি। এর মধ্যে প্রথমেই আছে ছাত্রছাত্রীদের ফেসবুকসহ ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগে অভিভাবকের মাধ্যমে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা। স্কুল ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটে কী দেখছে, সে বিষয়ে অভিভাবক, গণমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরির পরামর্শও বিটিআরসির চিঠিতে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) প্রতিষ্ঠান ফাইবার অ্যাট হোমের প্রধান প্রযুক্তিবিষয়ক কর্মকর্তা সুমন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত সন্ধ্যার পর থেকে রাত একটা পর্যন্ত ব্যক্তিগত কাজে ইন্টারনেট বেশি ব্যবহৃত হয়। স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে মধ্যরাতে ফেসবুক বন্ধ করা কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত হবে না। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতনতা তৈরির বিষয়টিতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর ফেসবুকসহ বেশ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বাংলাদেশের প্রায় এক মাসের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুই যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করতে গিয়ে যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না হয়, সে জন্য এসব যোগাযোগমাধ্যম তখন বন্ধ করা হয়েছিল।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বর্তমানে ৬ কোটি ৭২ লাখ। ৯০ দিন বা ৩ মাসের মধ্যে একজন ব্যক্তি একবার ইন্টারনেট ব্যবহার করলেই তাকে সক্রিয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হিসেবে গণ্য করে সরকার। তবে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা নিয়ে সরকারের এ হিসাবের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক, মুঠোফোন অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন জিএসএমএ, ইন্টারনেট লাইভ স্ট্যাটসের মতো বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার হিসাবে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। ইন্টারনেট লাইভ স্ট্যাটসের হিসেবে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বর্তমানে ২ কোটি ১০ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২ কোটির বেশি নয়।
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে বাংলাদেশে কতজন ফেসবুক ব্যবহার করে, সেটির কোনো নির্দিষ্ট হিসাব নেই। তবে তথ্যপ্রযুক্তি খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হিসাবে, বাংলাদেশ থেকে দেড় কোটির বেশি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। আর নিয়মানুযায়ী ১৩ বছরের নিচের কেউ ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে না। আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিদিন ৪০০ জিবিপিএস (গিগা বিটস প্রতি সেকেন্ড) ইন্টারনেট ব্যান্ডউইটথ ব্যবহার হয়। তবে বাংলাদেশে ব্যবহৃত মোট ইন্টারনেট ডেটার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ফেসবুক ব্যবহারে খরচ হয়। সে হিসাবে মোট ইন্টারনেট ব্যান্ডউইটথের ১০০ জিবিপিএস ব্যবহার হয় ফেসবুকের মাধ্যমে। তাই দিনে ছয় ঘণ্টা করে ফেসবুক থাকলে ইন্টারনেট ব্যবহারে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।
ফেসবুকের সঙ্গে আলোচনা করতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বর্তমানে সিঙ্গাপুরে রয়েছেন। ফেসবুকের মাধ্যমে আপত্তিকর কনটেন্ট ছড়ানোর বিষয়ে করণীয় নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আলোচনা করতেই প্রতিমন্ত্রী সেখানে রয়েছেন বলে জানা গেছে। গত মাসে ফেসবুকের সঙ্গে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে নতুন ফেসবুক আইডি খুলতে জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহারের দাবি তোলা হয়। সরকারের এমন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ফেসবুক।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ৩১ মার্চ এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশে মতপ্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা হিসেবে সরকার ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করছে। সংস্থাটির বিবৃতিতে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার করে সহিংসতাকে উসকে দেওয়ার বিষয়টি মোকাবিলা করা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু প্রায়ই শৃঙ্খলা রক্ষার চেয়ে সমালোচনা বন্ধ করাই রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, যে কারণে ফেসবুক বন্ধ করার চিন্তা করা হচ্ছে, সেটি হাস্যকর। ফেসবুকের অপব্যবহার রোধ করতে হলে সামাজিক মূল্যবোধ বাড়াতে হবে, সন্তানের প্রতি অভিভাবকের খেয়াল রাখতে হবে। মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারকে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করা গেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার এমনিতে কমে আসবে।