ভারত-চীন প্রতিযোগিতা বাংলাদেশকে কী দিল?

Author Topic: ভারত-চীন প্রতিযোগিতা বাংলাদেশকে কী দিল?  (Read 1280 times)

Offline Md. Alamgir Hossan

  • Hero Member
  • *****
  • Posts: 935
  • Test
    • View Profile

বাংলাদেশ চীন থেকে সাবমেরিন কেনার পর ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, বাংলাদেশের কেন সাবমেরিন দরকার? এ নিয়ে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে রা করেনি, কিন্তু অস্বস্তির বিষয়টিও চাপা থাকেনি। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের বাংলাদেশ সফরকে এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরপর আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করে এসেছেন এবং তখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ব্যাপারে সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে। এ নিয়ে চীনের প্রতিক্রিয়া কী, তা অবশ্য এখনো জানা যায়নি। চীনের তরফেও কি একই ধরনের প্রশ্ন উঠবে; ভারতের সঙ্গে এই সামরিক সহযোগিতার দরকার কী?
চীন সম্পর্কে জানাবোঝা ভালো, এমন কূটনীতিকদের অনেকেই বলে থাকেন, চীন তড়িঘড়ি কোনো প্রতিক্রিয়া জানায় না। কিন্তু সেই অবস্থা সম্ভবত পাল্টেছে। চীনের কাছ থেকে এখন বেশ দ্রুতই প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে। আগেই বলেছি, বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনা নিয়ে ভারত সরকারের কেউ আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। প্রশ্নগুলো উঠেছে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের তরফে। কিন্তু আমরা দেখলাম, চীন এ নিয়ে বেশ কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। চীনের গ্লোবাল টাইমস যা বলে, তাকে চীনের সরকার ও সরকারি দলের বক্তব্য হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। সেখানে বেশ শক্ত ভাষাতেই প্রতিবেশীদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করতে ভারতকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। চীন থেকে নির্বাসিত তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাই লামার সাম্প্রতিক ভারতের অরুণাচল প্রদেশ সফর নিয়ে চীনের প্রতিক্রিয়া আরও কড়া। অরুণাচলকে চীন তাদের নিজেদের অংশ মনে করে। তাদের কাছে এটা ‘দক্ষিণ তিব্বত’। গ্লোবাল টাইমস লিখেছে; চীনের জিডিপি ভারতের কয়েক গুণ, তার সামরিক বাহিনীর ভারত মহাসাগরে পৌঁছার সক্ষমতা আছে, ভারতের পাশের দেশগুলোর সঙ্গেও তার সম্পর্ক ভালো; আবার ভারতের উত্তরাঞ্চলের রাজ্যের সঙ্গে চীনের সীমান্ত বিরোধও আছে—এ অবস্থায় চীন যদি ভারতের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক খেলা শুরু করে, তাহলে কি বেইজিং হারবে?
চীনের বর্তমান নেতা সি চিন পিংয়ের শাসনকাল দেশটির জনগণকে পরাক্রমশালী একটি জাতি হিসেবে চীনকে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। চীনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চার লাখ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিই দেশটিকে এই সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে। এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই পর্যায়ে চীন বুঝেছে যে শুধু রপ্তানির ওপর নির্ভর করা থেকে দেশটিকে সরতে হবে। তারা এখন অন্য দেশে বিনিয়োগ শুরু করেছে। আফ্রিকায় বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছে চীন। দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলেও চীন তাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগ জোরদার করছে। দক্ষিণ এশিয়াতেও চীন কদম ফেলেছে বেশ জোরেশোরে। শ্রীলঙ্কা ও নেপালের পর চীন নজর দেয় বাংলাদেশের দিকে। আর কোনো দেশে বিনিয়োগ মানেই সেখানে বাণিজ্য স্বার্থ নিশ্চিত করার ব্যাপার থাকে, থাকে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের বিষয়ও। এই অঞ্চলে চীনের এই নতুন অবস্থান উপমহাদেশের ভূরাজনীতির পুরোনো হিসাব-নিকাশকে অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে।
আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে এত দিন যে কৌশলে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল, এ অঞ্চলের দিকে চীনের নজর পড়ায় স্বাভাবিকভাবেই তা আর কাজে দেবে না। ভারত আঞ্চলিক শক্তি থেকে পরাশক্তি হতে চায়। এ অঞ্চলে বিশাল বিনিয়োগ নিয়ে হাজির হওয়া চীন তাই দেশটির জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলা যায়, ভারতের জন্য একটি মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। চীন থেকে বাংলাদেশের অস্ত্রশস্ত্র কেনা নতুন কিছু নয়। কিন্তু চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন কেনার পর ভারতের অস্বস্তির মাত্রায় বোঝা গেছে, এসব বিষয়কে আর আগের মতো দেখতে চাইছে না ভারত। এই উপমহাদেশ, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন বেশ জোরদার হয়ে উঠেছে।
গত বছরের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের আগেই খবর রটে গিয়েছিল যে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সহায়তা ও বিনিয়োগের প্রস্তুতি নিয়েই তিনি আসছেন। সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফর সামনে রেখে নয়াদিল্লিভিত্তিক কৌশলগত নিরাপত্তা বিশ্লেষক ভাস্কর রায় এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, বাংলাদেশ এখন চীনের নজরে রয়েছে। ‘চীন এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী। তারা সেখানকার বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণে সহযোগিতা করছে, যা চোখে পড়ার মতোই। বাংলাদেশের তিন বাহিনীও চীনা অস্ত্রে সজ্জিত। চীন বন্ধুত্বের খাতিরে কম দামেই এসব সরবরাহ করে।’ ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে চীন এই যে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার কৌশল নিয়েছে, তা মোকাবিলায় ভারতকে অনেক কিছুই নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের আগে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট-এ এক লেখায় ইন্ডিয়া বাংলাদেশ রিলেশনশিপ, কারেন্ট পারসপেকটিভ বইয়ের লেখক জয়ন্ত রায় বলেছেন, ‘চীন দক্ষিণ এশিয়ায় যে মাত্রায় অর্থের জোগান দিচ্ছে, তা চাইলেও ভারত দিতে পারবে না। এটা দিল্লিকে উদ্বিগ্ন করতে পারে কিন্তু বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশ, যারা দ্রুত উন্নয়ন চাইছে, তাদের উন্নয়নের জন্য চীনের কাছ থেকে অর্থ নেওয়া থেকে বিরত রাখা যাবে না।’
চীন-ভারতের এই প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দুই পক্ষ থেকেই যেমন নানা চাপ থাকবে, তেমনি এটা বাংলাদেশের জন্য একটা সুবিধাজনক অবস্থাও তৈরি করবে। এই সুবিধাটা ভারতের সঙ্গে ‘চীনের কার্ড’ বা চীনের সঙ্গে ‘ভারতের কার্ড’ খেলা নয়, বরং নতুন বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা, ন্যায্য পাওনা আদায় করা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের উন্নয়ন নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা কি আমরা আদৌ কাজে লাগাতে পারছি? উপমহাদেশের এই পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশকে আসলে কী দিল?
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দেওয়া-নেওয়ার হিসাব-নিকাশে বাংলাদেশ বরাবরই পিছিয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরের আগে ভারতীয় সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জয়দীপ মজুমদার এক লেখায় লিখেছেন, ভারতকে সহায়তা করার জন্য শেখ হাসিনা তাঁর যা করার তার চেয়েও বেশি করেছেন। ভূমিবেষ্টিত ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশ খুবই স্বল্প মাশুলে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে। তিনি তাঁর দেশে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়া বন্ধ করেছেন, এমনকি এসব গোষ্ঠীর নেতাদের আটক করে ভারতীয় এজেন্সিগুলোর হাতে তুলে দেওয়ার কাজও করেছেন। দেশের মধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও ভারতবিরোধী ইসলামপন্থী দলগুলোর কঠোর সমালোচনা উপেক্ষা করেই শেখ হাসিনা এই কাজটি করেছেন।
জয়দীপ মজুমদারের এই পর্যবেক্ষণ বিবেচনায় নিলে বোঝা যায় যে দেওয়া-নেওয়ার হিসাব-নিকাশে আমরা কতটা পিছিয়ে। আমাদের তরফে এত কিছুর পরও ভারত এখনো তিস্তার পানি দেয়নি এবং আমরা দেখছি ভারত নিজেদের মতো করে একতরফাভাবে নদীসংযোগ প্রকল্পসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে চলেছে। এসবের মধ্য দিয়ে নিচের দিকের দেশ হিসেবে যৌথ নদীগুলোর পানির ওপর বাংলাদেশের যে অধিকার রয়েছে, তা কার্যত উপেক্ষা করে চলেছে। পরিহাস হচ্ছে, পানি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত যে আচরণ করছে, চীনের কাছ থেকে সেই একই আচরণের মুখোমুখি হচ্ছে দেশটি। যে ভারত বাংলাদেশকে তিস্তার পানির ন্যায্য ভাগ দিতে চাচ্ছে না, সেই ভারত এখন ব্রহ্মপুত্রের পানি কম পাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। চীন তিব্বতে ব্রহ্মপুত্র নদে এক বিশাল বাঁধ তৈরি করছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ প্রকল্পের জন্য। সেচ প্রকল্প মানেই পানি সরিয়ে নেওয়া হবে। ফলে ভারত এই প্রকল্পের বিরোধিতা করছে এবং ব্রহ্মপুত্রে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছে। এখন ভারত যদি মনে করে যে বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা বা যৌথ নদীগুলো নিয়ে ভারতের অবস্থান যৌক্তিক, তবে ব্রহ্মপুত্র নিয়ে চীনের প্রকল্প বা কর্মসূচির বিরোধিতা করার কোনো ভিত্তি দেশটির থাকে কি?
বোঝা যাচ্ছে, এ ধরনের দ্বিমুখী বাস্তবতা, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের পা ফেলা বা ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই নতুন পর্যায়ের সুফল আমরা এখনো কাজে লাগাতে পারছি না। উপমহাদেশে প্রভাব বিস্তারে চীনের মতো অর্থ নিয়ে নামার ক্ষমতা ভারতের নেই এবং তা নিয়ে দিল্লির উদ্বেগ আছে বলে মনে করেন ভারতের বিশ্লেষক জয়ন্ত রায়। তাঁর এই বক্তব্যের জবাবে বলা যায়, চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসে দুই হাজার কোটি ডলার ঋণ সহায়তার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার পাল্টা হিসেবে ভারতের কাছ থেকে কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তার চেয়ে বরং তিস্তা বা অভিন্ন নদীর পানি আমাদের জন্য বেশি জরুরি। সবচেয়ে বড় কথা, এটা কোনো দয়া বা সহায়তার বিষয় নয়, আমাদের ন্যায্য পাওনা। চীনের সঙ্গে অর্থের প্রতিযোগিতায় ভারত না পারুক, আমাদের ন্যায্য পাওনাটুকু দিয়ে তো অন্তত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে তারা এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে! উপমহাদেশের এই নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারত যদি এটা এখনো না বুঝে থাকে বা বুঝতে না চায়, তবে ভারতকে তা বোঝানোর দায়িত্ব বাংলাদেশের।
মানতেই হবে, এই নতুন বাস্তবতা বাংলাদেশের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ। ভারত ও চীনের তরফে আমাদের সহযোগিতার নানা প্রস্তাব যেমন থাকবে, তেমনি নানা চাপও থাকবে। আমাদের মনে আছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের ব্যাপারে বাংলাদেশ-চীন সমঝোতা স্মারক সইয়ের সব চূড়ান্ত হলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। দৃশ্যত ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণেই বাংলাদেশ সরে আসে। ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে কোন দেশের কোন বিরোধিতা বিবেচনায় নিতে হবে বা কোনটি নেওয়া যাবে না, সেই হিসাব-নিকাশটি বড়ই জটিল। চীনের মতো একটি পরাশক্তির কৌশল ও ভারতের মতো আঞ্চলিক শক্তি থেকে পরাশক্তি হতে মরিয়া দেশের কৌশলকে মোকাবিলা করেই বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। কোনো পক্ষের প্রতি সুস্পষ্ট কোনো পক্ষপাত না দেখিয়ে কাজটি করে যাওয়া খুবই কঠিন। এটা মানতেই হবে যে, বাংলাদেশ-ভারত বা বাংলাদেশ-চীনের সম্পর্ককে এখন আর আগের কূটনীতির বিবেচনায় চালানো যাবে না।

Offline Ratul.JMC

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 279
    • View Profile
Thank you very much for your post. :)
Md. Rashedul Islam Ratul
Lecturer, JMC
Daffodil International University