প্রাণ হাতে নিয়ে সড়কপথে লাখো ঈদযাত্রী
আব্দুল্লাহ আল মাছুম২২ জুন, ২০১৭ ইং
প্রাণ হাতে নিয়ে সড়কপথে লাখো ঈদযাত্রী
য খন এ লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনো পত্রিকাগুলোর অনলাইন সংস্করণে ভাসছে ‘মাতুয়াইলে বাস উল্টে নিহত ২। তাদের একজন ৫ বছরের শিশু, অপরজন ২৭ বছরের যুবক। সংবাদটি হয়ত আপনাদের হূদয়ে সমবেদনার ঝড় তুলে দিয়েছে, কিন্তু আমার মধ্যে সামান্য ভাবাবেগও জন্মায়নি। ক্রোধ-হতাশায় ভরে থাকা হূদয়ে এখন সমবেদনা জায়গা করে নিতে পারে না। কারণ আমি জানি এ এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনা কোনো দুর্ঘটনার কাতারে পড়তে পারে না। নিয়মিত প্রায় প্রতিদিন যদি একই সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে তবে তাকে আমি হত্যাই বলব।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত আট কিলোমিটার সড়ক আট লেনের। আট লেন করা হয়েছিল যানজট থেকে মুক্ত হয়ে নিরাপদ সড়কের প্রত্যাশায় কিন্তু এখন আট লেনের মহাসড়ক যেন মৃত্যুকেই প্রশস্ত করছে। এ সড়কে আমি নিজেও গত বছরের অক্টোবরের ১৯ তারিখে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া বাসের ভিতর থেকে আমার শরীরের ওপর পড়ে থাকা রক্তাক্ত দেহ সরিয়ে পৃথিবীতে ফিরেছিলাম। মহান আল্লাহর রহমতে সেদিন আমি বড় ধরনের আঘাত ছাড়া অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলাম। কিন্তু কয়বার এভাবে রক্ষা পাবো— যদি একই অভিশাপে পা দেই বারবার বাধ্য হয়েই।
এ আট লেনের মহাসড়কে মানুষ হত্যার সফল পসরা সাজানো হয়েছে। এ মহাসড়কে চলাচলকারী গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জ/কাঁচপুরগামী বেপরোয়া ফিটনেসবিহীন (কতটা ভাঙাচোরা তা হয়তো কল্পনাও করতে পারছেন না) বাসগুলোতে কেউ তার শত্রুকেও স্বেচ্ছায় উঠিয়ে দিতে ভয় পাবেন। ঢাকা থেকে এ আট লেন ব্যবহারকারী গলাকাটা ভাড়ার লেগুনা, মিনিবাস, বাস চালাচ্ছে মাতাল কিশোররা। যাত্রী বোঝাই লেগুনা, বাস থামিয়ে প্রকাশ্যেই মাদক কেনা-বেচা করে তারা। অসহায় যাত্রীদের হাত-পা বাঁধা। বাড়িতে তো ফিরতে হবে, তাই নিশ্চিত কোনো না কোনো দুর্ঘটনা হবে জেনেই কলিজা হাতের মুঠোয় ভরে আল্লাহ আল্লাহ জপতে জপতে প্রতিদিন এ আট লেন পার করেন তারা। গণমাধ্যমে মাঝেমধ্যে শুধু ঘটনাস্থলে নিহত হলেই সংবাদ আসে। প্রতিদিনের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর চেয়ে কষ্টে থাকা অসংখ্য আহত এবং হাসপাতালের বিছানায় পচতে পচতে পৃথিবী থেকে নিঃশেষ হওয়াদের হিসাব কেউ রাখে না।
প্রত্যাশার এ আট লেনের চার লেনই থাকে ওই ফিটনেসবিহীন ভাঙাচোরা মৃত্যুযানগুলোর পার্কিং, ময়লা আর হকারের দখলে। যার ফলে ঈদের সময়ের বাড়তি চাপে সাইনবোর্ড থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত লেগে আছে তীব্র যানজট।
মহাসড়কের এ অবস্থা ঢাকা ছাড়ার সব রুটে একই রকম। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার জামুর্কী থেকে গাজীপুরের চন্দ্রা, আব্দুল্লাহপুর থেকে ঢাকা-সিলেট সড়ক, সাইনবোর্ড থেকে কাঁচপুর অবরুদ্ধ হয়ে আছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে আটকে আছেন ঈদে ঘরমুখো যাত্রীরা। আমি বলব, আটকে থাকাই ভালো। ত্রুটিপূর্ণ সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ির চাকা যখন ঘুরবে মাতাল, অদক্ষ, বিশ্রামহীন (জেলা সড়কগুলোতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ) চালকের ইশারায় তখন হয়তো আপনি বাড়ি ফিরবেন কিন্তু নিষ্প্রাণ হয়ে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের মার্চের হিসাব অনুযায়ী সড়ক ও মহাসড়কের ১৬ হাজার ৬২১ কিলোমিটারের ৬ হাজার ২০৬ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা নাজুক। তার মধ্যে ২৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ মহাসড়ক বেহাল এবং জেলা সড়কসহ ৩৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ সড়ক ভাঙাচোরা। এ ভাঙাচোরা সড়কেই নামছে ঈদ উপলক্ষে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি গাড়ি। গাড়ির চাপ সামাল দিতে অসহায় সরকার ঈদের আগে ও পরে তিন দিন করে মোট ৬ দিন মহাসড়কে পণ্যবাহী যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও সংশ্লিষ্টরা বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন চিরকাল।
মহাসড়কের এ পঙ্গপালের কোনো এক বাসে অসহায় অন্তরের বিষ নিয়েই নাড়ির টানে ছুটে চলা রাজধানীবাসী নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত গুনেই টিকিট কিনে চড়ে বসবেন গন্তব্যে ফেরার তাগিদে। যানজট সৃষ্টিকারী সড়কের সকল অব্যবস্থার পাশাপাশি বাসটি আটকে থাকবে বছরের অন্য দিনগুলোর মতো টোল প্লাজাগুলোতে গাড়ি থামিয়ে রেখে টোল আদায় করার দীর্ঘ জটে।
যানজটের যত ভয়ঙ্কর মূর্তিই আপনি দেখেন না কেন আপনি হাসতে পারবেন অনিচ্ছায় হলেও। কিন্তু আপনার কলিজার রক্তপ্রবাহ থেমে যাবে যদি গত বছরের ঈদুল ফিতরের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানের খোঁজ নেন। গত বছরের ঈদুল ফিতরে সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ১৯৬ জন। হাসপাতালের বিছানায় নিঃশেষ হওয়া এবং আহতদের কথা নাই-বা বললাম। হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু দিয়ে কী হবে যদি রাজপথে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকতে হয়?
সকল দুশ্চিন্তা, হতাশা, ভয়, অনিশ্চয়তা, ভোগান্তি, হয়রানি মাথায় নিয়ে শিকড়ে ঈদ করার প্রত্যাশায় কর্মস্থল ঢাকা ছাড়বেন হাজারো ঈদযাত্রী। জাবির রানা-আরাফাতকে যদি ঘাতক এ মহাসড়ক এক মাস আগে আসল শিকড় মাটিতে পৌঁছে না দিত হয়তো তারাও আজ এ ঝামেলা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিতেন। রানা-আরাফাতের পরিবার-পরিজন যেমনি অনিশ্চিত মৃত্যুর ভয় থেকে কোনো দিন মুক্তি পাবে না, তেমনি এবারের ঈদেও ঘরমুখো হাজারো নিষ্পাপ যাত্রী ঘাতকের চোয়ালে বসে বাড়ির পানে ছুটবেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে হয়তো হাসতে হাসতে বাড়ির উঠানে দাঁড়াবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এ হাসিগুলো থেমে যাওয়ার আগে আমাদের দিকে কি একটু তাকাবেন না? আপনার কঠোরতাই পারে কিছু অসহায়ের জীবন প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে।
n লেখক :শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/drishtikon/2017/06/22/204211.html