চিকুনগুনিয়া জ্বর (CHIKUNGUNYA FEVER) : কারণ ও করণীয়
প্রফেসর ডা. হারুন-অর-রশিদ, ডিপার্টমেন্ট অফ পাবলিক হেলথ, ডি আই ইউ
কারণঃ
চিকুনগুনিয়া জ্বর একটি মশাবাহিত সংক্রামক রোগ। চিকুনগুনিয়া নামক ভাইরাসের সংক্রমণে রোগটি হয়। এ ভাইরাসের বাহক এডিস মশা। স্ত্রী মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাসটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। সংক্রমণের ৩ – ৭ দিনের মধ্যেই সাধারণত উপসর্গ দেখা দেয়। এ রোগটির মূল লক্ষণ জ্বর ও জয়েন্টে বা গিঁটে ব্যাথা।
সংক্রমণঃ
চিকুনগুনিয়া ভাইরাস প্রথমে রোগী থেকে মশায় এবং পরে মশা থেকে সুস্থ্য মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। একটি মশা একাধিক মানুষকে এ রোগে আক্রান্ত করতে পারে। এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলায় – খুব ভোরে এবং পড়ন্ত বিকেলে কামড়ায়। এ মশা পরিষ্কার পানিতে, অতি ক্ষুদ্র জলাশয়ে ডিম পাড়ে এবং বংশ বিস্তার করে। ডিম ছাড়ার ৭ – ১২ দিনের মধ্যে তা পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হয় এবং রোগ বিস্তার করতে পারে। একটি স্ত্রী মশা সাধারণত ২ – ৩ সপ্তাহ বেঁচে থাকে এবং ৩০০ টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে। এডিস মশার উড়ন্ত মণ্ডল ছোট পরিসরের হওয়ায় কোনো একটি এলাকায় রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। একই পরিবারের একাধিক ব্যাক্তি এ রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। এ রোগটির উপসর্গ দেখা দেয়ার ৭ (সাত) দিন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া ভাইরাস রোগী থেকে কামড়ের মাধ্যমে মশার শরীরে প্রবেশ করে এবং আক্রান্ত মশা সুস্থ্য মানুষকে কামড়ালে তার চিকুনগুনিয়া জ্বর হয়। বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী সময়ে এডিস মশার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং চিকুনগুনিয়া জ্বরের প্রকোপ দেখা দিতে পারে।
চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু জ্বরঃ
চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণের সাথে ডেঙ্গু জ্বরের যথেষ্ট মিল রয়েছে। তবে ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষতিকর প্রভাব চিকুনগুনিয়া জ্বর থেকে অনেকগুণ বেশি। তাই এ রোগ হলে ডেঙ্গু জ্বর হয়নি, সেটি নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। চিকুনগুনিয়া জ্বরের মাত্রা ডেঙ্গু জ্বর থেকে বেশি হয়ে থাকে। সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরে জয়েন্টে বা গিঁটে তীব্র ব্যাথা হয় না। তবে ডেঙ্গু জ্বরে মাংসপেশীতে প্রচণ্ড ব্যাথা হয়। রক্তপাত ডেঙ্গু জ্বরের একটি অন্যতম লক্ষণ। জ্বরের প্রথম সপ্তাহে রক্ত পরীক্ষা করে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত করা যায়।
কাদের ঝুঁকি বেশিঃ
চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত বয়স্কদের ( ≥ ৬৫ বৎসর), শিশুদের ( ≤ ১ বৎসর) এবং গর্ভবতী মহিলাদের ঝুঁকি বেশি থাকে। এছাড়াও যারা অন্যান্য অসংক্রামক ব্যাধিতে (যেমন উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ইত্যাদি) আক্রান্ত ও যাদের সংক্রামক ব্যাধি আছে (যেমন যক্ষা, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি) তাদের ঝুঁকি অন্য রোগীদের তুলনায় বেশি। সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা গেছে, যে এ রোগে পুরুষদের চেয়ে মহিলারা বেশি আক্রান্ত হন।
প্রতিরোধঃ
চিকুনগুনিয়া জ্বর দিনের বেলায় এডিস মশার কামড়ে হয়ে থাকে। বাসা বাড়িতে মশা নিধনের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পেলেও, এ রোগের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং কর্মস্থলে মশা নিধনের প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেয়াও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ অনেক মানুষই দিনের অধিকাংশ সময় ঘরের বাইরে থাকেন। ঘরে ও বাইরে সকল স্থানে মশার বংশবিস্তার রোধ, মশা নিধন ও নিজেকে মশার কামড় থেকে রক্ষায় সকল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ চিকুনগুনিয়া জ্বর প্রতিরোধের প্রধান উপায়। এ ব্যাপারে যা করণীয়ঃ
১. ফুল গাছের টব, পরিত্যক্ত পাত্র, টায়ার, ডাবের খোসা, এসি ও ফ্রীজের নিচে বা অন্য কোন স্থানে পানি জমিয়ে না রাখা।
২. বাড়ির আঙিনা ও নির্মাণাধীন ভবনের পানির চৌবাচ্চা নিয়মিত পরিষ্কার রাখা।
৩. বাসার আশে পাশের ঝোপ-ঝাড় নষ্ট করা।
৪. মশা নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার।
৫. দিনে মশার কামড় থেকে রক্ষায় সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ।
৬. দিনের বেলায়ও ঘুমানোর সময় মশারী ব্যবহার।
উপসর্গসমূহঃ
১. উচ্চমাত্রার জ্বর ( ১০৪° – ১০৫° ফা.), যা হঠাৎ করে শুরু হয় এবং সাধারণ জ্বরের মত ঘাম দিয়ে ছাড়ে না। সাধারণত পাঁচ থেকে সাতদিন পর্যন্ত এ জ্বর থাকে।
২. একাধিক জয়েন্টে বা গিঁটে (শরীরের দু’পাশে) মাঝারী থেকে তীব্র ব্যাথা।
৩. জ্বরের প্রথম থেকে তৃতীয় দিনের মধ্যেই সাধারণত মুখ, ঘাড় এবং পিঠে র্যা শ হয়।
৪. মাথা ব্যাথা, মাংস পেশী ব্যাথা।
৫. বমি বমি ভাব ও খাবারে অরুচি।
৬. মুখে ঘা হতে পারে।
৭. অবসাদ ও অনিদ্রা।
৮. অন্যান্য লক্ষণ সমূহ উচ্চমাত্রার জ্বরের উপসর্গ হিসেবে দেখা দিয়ে থাকে।
চিকিৎসাঃ
চিকুনগুনিয়া জ্বর প্রতিরোধের কোন ভ্যাকসিন নাই। চিকুনগুনিয়া ভাইরাস নিরাময়েও কোন ঔষধ নাই, যে কারনে রোগটির চিকিৎসা উপসর্গ নির্ভর। যা করণীয়ঃ
১. সমস্যা তীব্র না হলে বাসায় চিকিৎসা করা যেতে পারে।
২. জ্বর নিয়ন্ত্রনে রাখার ও ব্যাথা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল খাওয়া যায়।
৩. প্রচুর পানি পান ও তরল খাদ্য গ্রহণ করা।
৪. শরীর ঠান্ডা পানিতে নিয়মিত মুছে জ্বরের মাত্রা স্বাভাবিক রাখা।
৫. গিঁটের ব্যাথা উপশমে ঠান্ডা পানির ছেক। হালকা ব্যায়াম উপকারী হতে পারে।
৬. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন।
৭. ডাক্তারের পরামর্শ ব্যাতিরেকে ব্যাথা নিরাময়ের জন্য এসপিরিন বা ব্যাথানাশক ঔষধ সেবন করা যাবে না।
কখন হাসপাতালে যাবেনঃ
১. রক্তচাপ কমে গেলে।
২. প্রস্রাবের পরিমাণ কম হলে।
৩. শরীরের কোথাও রক্তপাত শুরু হলে।
৪. চিকিৎসার পরেও প্রচণ্ড ব্যাথা থাকলে এবং জ্বর না কমলে।
৫. যদি রোগী বেশি ঝুঁকিতে থাকেন বা জটিলতা দেখা দেয়।
লক্ষ্যনীয়ঃ
১. চিকুনগুনিয়া জ্বর সাধারণত ৭-১০ দিনে ভাল হয়ে যায়।
২. জ্বর সেরে যাওয়ার পরেও জয়েন্ট বা গিঁটে ব্যথা থাকতে পারে।
৩. এ রোগে মৃত্যু ঝুঁকি খুবই কম।
৪. রোগ নির্ণয়ের জন্য রক্ত পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
৫. সমস্যা তীব্র হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
৬. এ রোগে একবার আক্রান্ত হলে, মানুষের শরীরে রোগটির প্রতিরোধ ক্ষমতার সৃষ্টি হয় তাই পুণরায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কম থাকে।