শিক্ষা আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন প্রয়োজন, "কালের কন্ঠ" ১১ অক্টোবর, ২০১৭ (পৃ.১৫)

Author Topic: শিক্ষা আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন প্রয়োজন, "কালের কন্ঠ" ১১ অক্টোবর, ২০১৭ (পৃ.১৫)  (Read 1060 times)

Offline kekbabu

  • Jr. Member
  • **
  • Posts: 78
  • Test
    • View Profile
    • https://daffodilvarsity.edu.bd/
শিক্ষা আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন প্রয়োজন ("কালের কন্ঠ" ১১ অক্টোবর, ২০১৭; পৃ.১৫)
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয়, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন কোনো মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, ঠিক তেমনি শিক্ষা ছাড়াও কোনো জাতি উন্নতি, উন্নয়ন ও অগ্রগতি লাভ করতে পারে না। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, একটি জাতি বা দেশকে ভালোভাবে এগিয়ে নিতে শিক্ষার কোনোই বিকল্প নেই। আর দেশের এই শিক্ষাব্যবস্থা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনা করার লক্ষ্যে অবশ্যই নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-রীতি তথা আইন-কানুন থাকা অত্যাবশ্যক। তা না হলে এ ক্ষেত্রে যে সহজেই হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হবে তা বলাই বাহুল্য। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে এত দিন পর্যন্ত শিক্ষা আইন ছিল না, ছিল কিছু শিক্ষানীতি। কিন্তু সুনির্দিষ্ট আইন ছাড়া শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা কঠিন কাজ। তবে আশার কথা হচ্ছে, সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবশেষে শিক্ষা আইনের একটা খসড়া চূড়ান্ত করেছে; যদিও অনেক আগে থেকেই দেশে এ ধরনের একটি আইনের প্রয়োজনীয়তা ছিল বেশ প্রকটভাবেই। গত বছর মে মাসে সরকার শিক্ষা আইনের একটি খসড়া প্রণয়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে আপলোড করে দেশের নাগরিকদের কাছ থেকে সুচিন্তিত মতামত আহ্বান করেছিল। সেখানে প্রায় ৩০০ মতামত জমা পড়ে এবং মত প্রদানকারীদের বেশির ভাগই প্রাইভেট, টিউশনি, কোচিং, নোট বই, গাইড বই ইত্যাদি নিষিদ্ধ করার পক্ষে সোচ্চার ছিল। পাশাপাশি তারা বেশ জোরালোভাবেই শিক্ষাক্ষেত্রের জন্য ক্ষতিকর এসব বিষয় চিরতরে বন্ধের সুপারিশ করেছে। দেশে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এসব প্রাইভেট, টিউশনি, কোচিং, নোট বই, গাইড বই ইত্যাদি ক্ষতিকর চর্চা স্থায়ীভাবে বন্ধ করার জন্য দেশের সচেতন জনগণের পক্ষ থেকে যে জোরালো জনমত রয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত শিক্ষা আইনের খসড়ার বিপরীতে জনগণের মতামতেই (ফিডব্যাক) তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কোচিং, প্রাইভেট, গাইড বই, নোট বই ইত্যাদি ক্ষতিকর প্রবণতা রোধ করার জন্য কোনো আইন নেই, আইন ছিল না। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে শিক্ষা আইনের একটা খসড়া ‘নমনীয়’ আকারে তৈরি করা হয়েছিল। আর এতে মূল পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি ‘সহায়ক বই’ বা ‘অনুশীলন বই’ প্রকাশ করার সুযোগ রাখার প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনির সুযোগ চালু রাখার উদ্দেশ্যে ওই আইনের খসড়ায় ‘ছায়া শিক্ষা’র কৌশল প্রস্তাব করা হয়েছিল, যা শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট সহায়ক ছিল। তখন ওই ধরনের একটি শিক্ষা আইনের খসড়া কাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে করা হয়েছিল, তা জনগণের বুঝতে বাকি নেই এবং বাকি থাকার কথাও নয়। তবে শেষ পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষাবিদসহ সচেতন মহলের তীব্র প্রতিবাদের মুখে শিক্ষা আইনের ওই খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ফেরত এনে পর্যালোচনা করা হয়। সেই পর্যালোচনার ভিত্তিতে প্রণীত শিক্ষা আইনের নতুন খসড়ায় কোচিং বাণিজ্য, প্রাইভেট, টিউশনি, নোট বই, সহায়ক বা অনুশীলন বই নিষিদ্ধ করার বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে—যা দেশের শিক্ষা খাতের জন্য, দেশের জনগণের জন্য এক সুসংবাদই বটে।

শিক্ষা আইনের পরিমার্জিত এই খসড়ায় জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে, এ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। শিক্ষা আইনের এ খসড়ায় কেউ প্রাইভেট, টিউশিন ও কোচিং করালে তাঁর ন্যূনতম ছয় মাস কারাদণ্ড অথবা দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীকে মানসিক ও শারীরিক শাস্তি দিলে শাস্তিদাতা ব্যক্তির ন্যূনতম তিন মাসের কারাদণ্ড অথবা ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হবে। পাশাপাশি নোট বই, গাইড বই ইত্যাদি প্রকাশ ও বিপণনের ক্ষেত্রেও কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে এ খসড়ায়। ফলে এ কথা স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, এই আইন জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের পথ উন্মুক্ত করবে এবং এই খসড়ায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সবার জন্য শিক্ষাকে একটি অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) এটিকে অষ্টম শ্রেণির পরিবর্তে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করা হলে অত্যন্ত ভালো হবে। খসড়াটি চূড়ান্ত করার সময় যেন এ বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়। বড় কথা হচ্ছে, এই যে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সংশ্লিষ্ট কোনো শিক্ষক কিংবা কেউ এসব কাজ করলে কারাদণ্ড, জরিমানা ও সরকারি চাকুরের ক্ষেত্রে চাকরিচ্যুতির বিধান করা হয়েছে। পাশাপাশি এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহি বাড়ানোর জন্য আট ধরনের অপরাধের দায়ে এমপিও বাতিল করা পর্যন্ত যেসব শাস্তির বিধান এই খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোও নিঃসন্দেহে যথার্থ।

সব দিক বিবেচনায় বলা যায়, শিক্ষা আইনের খসড়াটি নানা দিক থেকেই উপকারী হবে। তবে এই শিক্ষা আইনটি উচ্চশিক্ষার ফেরিওয়ালাদের রুখতে সহায়ক হবে কি না তা এখনো বোধগম্য হচ্ছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশে বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সরকারের নমনীয় অবস্থান তথা নমনীয় মনোভাবের কারণে এক শ্রেণির অসাধু লোক উচ্চশিক্ষা নিয়ে ফেরিওয়ালার মতো দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্য করে চলেছে। আবার উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে শিক্ষার্থী পাঠানোর নামে দেশের ভেতরে অবস্থিত প্রায় ৫০০ স্টুডেন্টস কনসালট্যান্সি ফার্ম শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লাগামহীনভাবে প্রতারণা করেই চলেছে। অথচ এ বিষয়গুলো দেখার যেন কেউ নেই। এসব স্টুডেন্টস কনসালট্যান্সি ফার্ম কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়, এরা শুধু একটি ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে যাচ্ছে। আর উচ্চশিক্ষার এসব ফেরিওয়ালা তথা এসব প্রতারকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দেশে স্পষ্ট তথা সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। শিক্ষা আইনে যদি এসব ব্যাপারে আলোকপাত করাপূর্বক দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রাখা হয়, তাহলে তা অবশ্যই মঙ্গলজনক হবে।

আশা করা যায়, শিক্ষা আইনের খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন পেয়ে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ও গৃহীত হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, শুধু আইন প্রণয়ন করাই যথেষ্ট নয়, প্রণীত আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটানোই বড় কথা, বড় বিষয়, বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, যেকোনো ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে একটি প্রাথমিক ধাপ বা পদক্ষেপ মাত্র। এরপর যা থাকে তা হচ্ছে, প্রণীত আইনের সুষ্ঠু তথা যথাযথ পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের কাজ। বিশেষত শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষতিকর চর্চাগুলো (যথা—প্রাইভেট, টিউশনি, কোচিং, গাইড বই, নোট বই ইত্যাদি) বন্ধ করতে হলে শিক্ষা আইনের অবশ্যই যথাযথ প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে হবে। কারণ প্রাইভেট, টিউশনি ও কোচিং শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকে গৌণ বিষয়ে পরিণত করেছে এবং নোট বই, গাইড বই ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের মূল পাঠ্য বইয়ের প্রতি বিমুখ করেছে—যা এ জাতির জন্য বড় ধরনের একটি অশনিসংকেত। শিক্ষাক্ষেত্রের এসব ক্ষতিকর চর্চা চিরতরে বন্ধ করতে শিক্ষা আইনের কঠোর প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই। সর্বোপরি জাতির বহুল প্রত্যাশিত শিক্ষা আইনের যেন যথাযথ ও সুষ্ঠু প্রয়োগ ঘটে, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাকেই ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ  ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
kekbabu@yahoo.com

http://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2017/10/11/552278
Dr. Kudrat-E-Khuda (Babu).
Associate Professor (Dept. of Law), Daffodil International University;
International Member of Amnesty International;
Climate Activist of Greenpeace International; Column Writer;
Mobile Phone: +8801716472306
E-mail: kekbabu.law@diu.edu.bd