এপেক্সের ৯৭% জুতাই প্রত্যাখ্যান করেছিল জাপানিরা

Author Topic: এপেক্সের ৯৭% জুতাই প্রত্যাখ্যান করেছিল জাপানিরা  (Read 1597 times)

Offline Mrittika Shil

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 213
  • Test
    • View Profile
প্রথম ব্যাচে এপেক্সের ৯৭% জুতাই প্রত্যাখ্যান করেছিল জাপানিরা
Coolected from http://bonikbarta.net/bangla/magazine-post/1023/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A5%E0%A6%AE-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A7%87-%E0%A6%8F%E0%A6%AA%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A7%AF%E0%A7%AD--%E0%A6%9C%E0%A7%81%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%87-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%96%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A6%BF%E0%A6%B2-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A6%BE/

প্রথম ব্যাচে এপেক্সের ৯৭% জুতাই প্রত্যাখ্যান করেছিল জাপানিরা
২০:৩৯:০০ মিনিট, অক্টোবর ০৮, ২০১৭




Share26
 
প্রথম ব্যাচে এপেক্সের ৯৭% জুতাই প্রত্যাখ্যান করেছিল জাপানিরাপ্রথম ব্যাচে এপেক্সের ৯৭% জুতাই প্রত্যাখ্যান করেছিল জাপানিরা
সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, ব্যবস্থাপনা পরিচালক
এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড
দেশের রফতানিমুখী পাদুকা শিল্পের পথিকৃত্ এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড। স্রোতের বিপরীতে একটি অপ্রচলিত পণ্যকে রফতানি বাজারে নিয়ে যাওয়া, নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সেখানে সাফল্য অর্জন, দেশের পাদুকা শিল্পে শীর্ষ কোম্পানি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার ইতিহাস নিয়ে সম্প্রতি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়ার্টন স্কুলে অর্থনীতিতে স্নাতক শেষ করে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে কোম্পানিটির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। আর্থিক সেবা, ওষুধ, বিজ্ঞাপন, প্রকাশনা, বাজার গবেষণা খাতেও একজন সফল উদ্যোক্তা তিনি। চামড়া খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন এলএফএমইএবি ও মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন একাধিক মেয়াদে। আলোচনায় উঠে আসে স্কিল, কমপ্লায়েন্স, ব্যবসায় উদ্যোগ, বিনিয়োগসহ নানা বিষয়। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মাহফুজ উল্লাহ বাবু
বাংলাদেশে তৈরি জুতা বিদেশের বাজারে নিয়ে গেলেন কীভাবে? গল্পটি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করবেন?
এপেক্স মূলত ট্যানারির ব্যবসা করত। অনেক দেশে আমাদের চামড়া রফতানি হতো, এখনো হচ্ছে। ১৯৯০ সালে আমরা পাদুকা রফতানির সিদ্ধান্ত নিই এবং দিনে এক হাজার জোড়া জুতা উত্পাদনে সক্ষম একটি কারখানা করি। সে সময় ফিনিশড প্রডাক্টটি রফতানির জন্য প্রয়োজনীয় স্কিল, অভিজ্ঞতা কোনোটিই আমাদের ছিল না। তবে সম্ভাবনাটুকু মাথায় রেখেই রফতানির ব্যাপারে আমরা দৃঢ়সংকল্প হই। ভারতে বাটা কোম্পানির একজন সিনিয়র এক্সপার্ট আমাদের কারখানার দায়িত্ব নিলেন। আমার বস ছিলেন একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট।
তখন ভারতে বিদেশী ব্র্যান্ডগুলোর জন্য শুধু জুতার ওপরের অংশটুকু তৈরি করা হতো, পুরো জুতা না। চীন সবে শুরু করেছে, আর ভিয়েতনামে শুরুই হয়নি। এখন মাঝে মাঝেই মনে হয়, আমরা সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলাম, কিছুটা অপরিপক্বও।
’৯০ সালেই বিদেশে বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে আমরা তাদের কাছ থেকে কাজ নেয়ার চেষ্টা করি। প্রথমে আমরা ইউরোপের কয়েকটি কোম্পানির ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন নিয়ে কয়েক চালান জুতা তৈরি করি এবং সেগুলো পাঠাই। সে সময় বেলজিয়ামের কাস্টমস আমাদের চালানটি আটকে দেয়। কারণ তাদের বিশ্বাস করানো যাচ্ছিল না, বাংলাদেশ থেকে জুতা রফতানি হয়। তারা জানে, এ দেশ থেকে বড়জোর চামড়া রফতানি হতে পারে। আমরা দেশে সরকারকে ফ্যাক্স করে বিষয়টি জানালাম এবং তাদের নিশ্চয়তা পেয়ে বিদেশের কাস্টমস পণ্যটি ছাড় করে।
ক্রেতা কোম্পানি প্রারম্ভিক চালানের জুতা খুবই পছন্দ করে। এরপর বলে, ওকে, তোমাদের নেক্সট ডিজাইন কী? আমরা একটি বড় ধাক্কা খেলাম। কারণ আমাদের কোনো ডিজাইন নেই, আমরা ডিজাইন করতে জানিও না। তখন বুঝলাম পাদুকা একটি ফ্যাশনপণ্য এবং এর আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো করতে হলে ফ্যাশন ও ডিজাইন-জগতের বিদ্যা আবশ্যক।
বিভিন্ন দেশে আমাদের ট্যানারি ব্যবসার গ্রাহকরা সবাই ছিল জুতা বা চামড়াজাত অন্যান্য পণ্যের ম্যানুফ্যাকচারার। তখন আমরা সেসব কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করি। তবে ডিজাইন স্কিল, বৃহদায়তন উত্পাদন সুবিধা না থাকা, সর্বোপরি জুতা রফতানিতে বাংলাদেশের ইমেজ গড়ে না ওঠার কারণে আমরা সুবিধা করতে পারছিলাম না।
তখন এপেক্সের বিষয়ে কিছুটা আগ্রহ দেখায় জাপানি একটি গ্রুপ মিজুসে। তারা কোরিয়ায় ম্যানুফ্যাকচার করে জাপানে জুতা বিক্রি করত। সেখানে মিউরা নামের এক ভদ্রলোক ছিলেন, যিনি ১৯৭৪ সালে প্রথম বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং এখানকার মানুষের প্রতি তার অনেক শ্রদ্ধাবোধ ছিল। তার উত্সাহেই মিজুসে কোম্পানি আমাদের এখানে জুতা তৈরিতে আগ্রহী হয়। জাপানিদের সঙ্গে কাজ শুরুটা এপেক্স ফুটওয়্যারের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ তাদের কাছ থেকেই আমরা শিখেছি, ‘মান’ কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
ফরমাল সু বেশি বিক্রি হওয়ায় জাপানের বাজারটি ইউরোপের মতো এতটা ফ্যাশননির্ভর ছিল না। তবে আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, মানের ব্যাপারে জাপানিরাই বিশ্বে সবচেয়ে সিরিয়াস। আপনার সঙ্গে একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করি, তাহলেই বুঝতে পারবেন। ইউরোপে আমাদের প্রথম চালানটিতে সিংহভাগ পণ্যই মানে উতরে যায়। তবে মিজুসে কোম্পানির জন্য প্রথম চালানে তৈরি করা ৯৭ শতাংশ জুতাই কোনো না কোনোভাবে মান পরীক্ষায় আটকে যায়। সেটি আমাদের কারখানাতেই। সে দিনটি আমার আজো মনে আছে। ফুটওয়্যার কারখানায় গভীর রাত পর্যন্ত আমরা সবাই জাপানিদের সঙ্গে কোয়ালিটি কন্ট্রোলে কাজ করছিলাম। ল্যাম্পটি সিলিং থেকে টেস্টিং টেবিলের ঠিক কয়েক ফুট উপরে নামিয়ে আনা হলো। মিস্টার মিজুসে আমাদের প্রতিটি জুতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখালেন এবং বুঝিয়ে দিলেন কোথায় সমস্যাটি কত সূক্ষ্ম। যাই হোক, আমরা মানের দীক্ষা নিলাম এবং মিজুসে সাহেবের চাহিদা পূর্ণ করতে সক্ষম হলাম। দ্রুতই আমাদের কারখানা পরিপূর্ণ হয়ে গেল। সম্প্রসারণের প্রয়োজন দেখা দিল। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই জাপানে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলো এবং মিজুসে কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেল। তবে আমাদের কারখানায় মিজুসে সাহেবের ছবিটি এখনো ঝুলছে।
আপনারা কি জাপানের বাজার থেকে সরে এলেন? অন্যান্য বাজারে কবে থেকে রফতানি শুরু হলো?
মান নিয়ন্ত্রণ শিখে যাওয়ার পর দেখলাম, জাপানই আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো বাজার। কারণ সেখানে নিত্য ডিজাইন পরিবর্তনের চাপটি নেই, বাজারের আকারও বড়, আবার দামও ভালো পাওয়া যায়।
সেখানকার জনবহুল বাজারে আমাদের পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল বেতনভুক্ত চাকরিজীবীরা। সে সময় তারা সবাই বছরের পর বছর একই রকম ফরমাল পোশাক ও জুতা পরত। ডিজাইন ও লুক পরিবর্তনের চেয়ে পরিধেয় পণ্যের মান নিয়ে তারা বেশি ভাবত। তবে দুর্ভাগ্যজনক বিষয়টি হলো, জাপানের অর্থনীতিতে ধস নামার পর সবার আগে চাপে পড়ে আমাদের জুতার ক্রেতারা। চাকরি হারায় বহু মানুষ। যাদের চাকরি টিকে থাকে, তারাও জুতা কেনা কমিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে সেখানে উঁচু মানের ফরমাল সুর বাজারটি সংকুচিত হতে থাকে। বিপরীতে ক্যাজুয়াল সুর চাহিদা বাড়তে থাকে। এর অর্থ হলো, ডিজাইনে মুনশিয়ানা ছাড়া সে বাজারে ভালো করা কঠিন। আবার মন্দার সময় দাম নিয়েও কিছুটা চাপ থাকে।
যাই হোক, মিজুসের কোম্পানি শেষ পর্যন্ত ব্যবসা বন্ধ করে দিলে আমাদের উত্পাদন আবার হোঁচট খায়। এদিকে এপেক্স এরই মধ্যে দেশের স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে। উদ্যোক্তা হিসেবে আমরা খুব চাপে পড়ে যাই। তখন আবার ইউরোপে যোগাযোগ বাড়াতে থাকি। সময়টা ’৯৪ সাল।
অনেক খরচ করে সেখানকার নানা প্রদর্শনীতে অংশ নিই। বাংলাদেশের একটি কোম্পানি; যার প্রোফাইল, পোর্টফোলিও, ক্যাপাসিটি কোনো কিছুই তেমন আকর্ষণীয় নয়। তাই সাড়া খুব কম। অনেক কোম্পানির সঙ্গে আমরা যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করি। এক মৌসুম ভালো যায় তো পরেরবার খারাপ। কিছু রফতানি করে কোনোমতে কারখানা চলছে। এমনই একটি পরিস্থিতিতে এপেক্স ফুটওয়্যারের জন্য টার্নিং পয়েন্ট হয়ে আসে ইতালির কোম্পানি এডেল্কি। এডেল্কি নামের ইতালীয় এক ভদ্রলোকের কোম্পানিটি বিভিন্ন কারখানায় দিনে ৬০-৬৫ হাজারের বেশি জুতা তৈরি করত। পূর্ব ইউরোপ, আলবেনিয়ায় তাদের ম্যানুফ্যাকচারিংগুলো বেশি হতো। আলবেনিয়ার গৃহযুদ্ধে তাদের কারখানা ধ্বংস হয়ে যায়। এডেল্কি সাহেবও বেশ চাপে ছিলেন। কারণ চাহিদার কারণে একদিকে তার উত্পাদন অব্যাহত রাখতে হবে, অন্যদিকে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের খরচটাও নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে।
এ অঞ্চলে তার অপশন ছিল চীন আর ভারত। ব্যক্তিগত কোনো অভিজ্ঞতার কারণে তিনি বাংলাদেশের প্রতিই বেশি আস্থাশীল ছিলেন। তিনি আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন। আমাদের কারখানায় তার টেকনিশিয়ানরা প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। তিনি ও তার কন্যা দুজনই ফুটওয়্যার এক্সপার্ট। তারাও আসতেন। প্রথম আমরা হাতে সেলাই করা বিখ্যাত মোকাসিন তৈরি করা শিখলাম। এটি খুব দক্ষতার ব্যাপার। এডেল্কি সাহেব আমাদের ওপর আস্থা রেখেছিলেন এবং আমাদের কর্মীরা নিজেদের প্রমাণ করেছে। অংশীদার হিসেবে তিনি আমাদের সঙ্গে বেশ আন্তরিক ছিলেন।
২০০৬ সালে এডেল্কির সঙ্গে আমরা কৌশলগত অংশীদারিত্বে গেলাম। তিনি আমাদের বোর্ডে যোগদান করলেন। কোম্পানির নাম বদলে হলো এপেক্স এডেল্কি ফুটওয়্যার। ম্যানুফ্যাকচারার হিসেবে বিদেশে আমাদের ইমেজও বাড়ল। এডেল্কির কাছ থেকে আমরা তিনটি জিনিস পেয়েছি, ডিজাইন, মার্কেটিং নেটওয়ার্ক ও নো হাউ। শুরুতে শুধু জুতার ওপরের অংশটুকু এখানে তৈরি করে ইতালিতে নিয়ে সোল সংযোজন করা হতো এবং এডেল্কির মোড়কে বিশ্বের নানা প্রান্তে সেগুলো ভালো দামে বিক্রি হতো। ধীরে ধীরে আমরা পুরো জুতা তৈরি করতে থাকি। একটা সময় এল, যখন ডিজাইন ছাড়া সবই বাংলাদেশে চলে এল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ক্রেতার কাছে জুতা শিপমেন্টও শুরু হয়। প্রতিটি ধাপেই বাংলাদেশে মূল্যসংযোজন বাড়তে থাকে এবং আমরা ম্যানুফ্যাকচারার হিসেবে এগোতে থাকি। বিশ্বের ৩৪টি দেশে ১১০টিরও বেশি কোম্পানি আমাদের ক্রেতার তালিকায় যুক্ত হলো। ২০০৭ সালে কারখানার দৈনিক উত্পাদন-সক্ষমতা ১০ হাজার জোড়ায় এবং পরের বছর ১৫ হাজার জোড়ায় উন্নীত হলো।
২০০৮ সালে পশ্চিমের আর্থিক বিপর্যয়ের পর খরচ নিয়ে ক্রেতা কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়তে লাগল। এরই মধ্যে চীন, ভিয়েতনাম শক্ত প্রতিযোগী হয়ে গেছে। আমরাও খরচ কমানোর চাপে পড়লাম। আমরা দেখলাম, বাংলাদেশে কর্মীদের বেতন-ভাতা ছাড়া আর কোনো খাতেই খরচ কমানোর সুযোগ নেই। সেটি আমরা করব না। খরচের একটি বড় খাত ডিজাইন। এডেল্কি সাহেবকে আমরা বললাম ডিজাইনের খরচই কমাতে হবে। এ বিভাগটি ইতালি থেকে বাংলাদেশে স্থানান্তর করলে তা সম্ভব। তিনি সেটাতে সম্মত হলেন না। তখন শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ২০১৩ সালে আমরা এডেল্কির কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। আবারো কোম্পানির নাম হলো এপেক্স ফুটওয়্যার। তবে এডেল্কি আমাদের কোম্পানির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হয়ে থাকবে।
এখন ডিজাইন ও অন্যান্য টেকনিক্যাল স্কিল কীভাবে সোর্সিং করছেন?
এখন বিশ্বের নানা প্রান্তে আমাদের মার্কেট রিসার্চ টিম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী ইতালীয় ডিজাইনাররা জুতা ডিজাইন করে দিচ্ছেন।  আমরা সবাইকে পে করছি। আমাদের নিজস্ব টিমের টেকনিক্যাল স্কিলও যথেষ্ট বেড়েছে। যতটুকু ঘাটতি আছে সেগুলোর জন্য পূর্ব এশিয়া, ভারত, ইউরোপ থেকে লোক নিতে হয়। আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন আমাদের দেশের মানুষই এসব কাজ করতে পারবে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশেষায়িত এসব স্কিলের কর্মী যথেষ্ট তৈরি করতে পারছে না। ইন্ডাস্ট্রি থেকে আমরা চেষ্টা করছি, তবে এটি যথেষ্ট না। কারণ আমাদের বিজনেস ফিজিবিলিটিটাও দেখতে হয়।
আমি যেখানেই সুযোগ পাই বলার চেষ্টা করি, আমাদের টেকনিক্যাল স্কিল বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে। সাধারণ বিষয়াদিতে লাখ লাখ স্নাতক আর স্নাতকোত্তর তৈরি করে একদিকে আমরা তাদের কাজে লাগাতে পারছি না, অন্যদিকে টেকনিক্যাল স্কিল আমদানির জন্য বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করছি। ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা বুঝে শিক্ষা ব্যবস্থায় সেগুলোর অন্তর্ভুক্তি দরকার। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি দরকার, আমাদের মানস কাঠামোয়। আমি বলব, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আর হোয়াইট কলার জবের প্রতি আমাদের সামাজিক মোহ অর্থনীতির অনেক ক্ষতি করছে। অথচ শত শত টেকনিক্যাল কাজ আছে, যেগুলোয় ডিপ্লোমা পর্যায়ের পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ পেলে আমাদের তরুণ-তরুণীরা নিজের একটি চমত্কার ক্যারিয়ার নিশ্চিত করতে পারবে, যা অর্থনীতিকেও অনেক এগিয়ে দেবে। টেকনিক্যাল কাজের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর শেষ সময়টা সম্ভবত চলে যাচ্ছে।
এপেক্স ফুটওয়্যারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানাবেন—
জাপানিদের জন্য প্রথম চালানে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল এখন তার ঠিক উল্টোটা। আমরা এখন মানের দিক থেকে অনেক এগিয়েছি।
ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে এক যুগ আগে আমরা স্থানীয় বাজারেও বিক্রি শুরু করি। মান ও দামের সমন্বয় করে আমরা দেশের ভোক্তাদের সেরাটা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রায় সব শহরেই আমাদের আউটলেট হয়েছে। দেশে এপেক্স একটি প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড। রফতানি বাজারেও আমাদের প্রবৃদ্ধি ভালো। তবে সেখানে আমরা এখনো চূড়ান্ত ব্র্যান্ড হয়ে উঠতে পারিনি। আপনারা জানেন, রফতানিতে তিনভাবে অংশ নেয়া যায়— ওইএম, ওডিএম ও ব্র্যান্ড। অরিজিনাল ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং বা ওইএমে ক্রেতা সবকিছু ঠিক করে দেবে আমরা শুধু ম্যানুফ্যাকচার করব, যেমনটি মিজুসে কোম্পানির সঙ্গে হচ্ছিল। পরের স্তর অরিজিনাল ডিজাইন ম্যানুফ্যাকচারার বা ওডিএম। সেখানে রফতানিকারক প্রডাক্ট ডিজাইন ও ডেভেলপ করে এবং ক্রেতা সেখান থেকে পছন্দ করে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের অনেক কোম্পানি ওইএম থেকে ওডিএমে উন্নীত হয়েছে। এডেল্কির সঙ্গে অংশীদারিত্বের সময়টায় আমরাও ওডিএমে উন্নীত হয়েছি। আমাদের তৈরি করা জুতাগুলো বিদেশে ক্রেতা কোম্পানির ব্র্যান্ডে বিক্রি হয়। এপেক্স নামে বিদেশে বিক্রি করতে হলে আমাদের অনেক দূর এগোতে হবে। অর্থনীতি ও ইন্ডাস্ট্রির একটা ইকোসিস্টেম ছাড়া সেটি সত্যিই কঠিন হবে।
যাই হোক, বর্তমানে এপেক্স ফুটওয়্যারের টার্নওভারের ৬০-৬৫ শতাংশ রফতানি থেকে আসে, আর বাকিটা স্থানীয় বাজার থেকে। দুটোই বর্ধনশীল। রফতানি ইউনিটের সক্ষমতা বাড়াতে আমরা নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছি।
সরকার চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যকে প্রডাক্ট অব দ্য ইয়ার ঘোষণা করেছে। আপনাদের ইন্ডাস্ট্রি কেমন চলছে?
সরকারের এ উদ্যোগ সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। রফতানি বহুমুখী করাটা আমাদের অর্থনীতির জন্য খুব দরকার। এরই মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। চামড়া শিল্পে আমাদের দুটি অ্যাডভান্টেজ আছে— স্থানীয় কাঁচামাল ও কর্মীর সহজলভ্যতা। একসময় রফতানির পুরোটাই ছিল কাঁচা-পাকা চামড়া। এখন ৬০ শতাংশের বেশি যাচ্ছে চামড়াজাত পণ্য এবং বাকিটা চামড়া। মূল্যসংযোজনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি অত্যন্ত ইতিবাচক। আর কর্মীর কথাটি এজন্য বললাম, দেখুন তিন মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে একজন কর্মীকে ফুটওয়্যার কারখানায় কাজে লাগানো যায়, যেটি সম্ভাবনাময় শিল্পগুলোর মধ্য শুধু তৈরি পোশাক খাতেই সম্ভব। সরকার চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে অ্যাড্রেস করেছে। ১৪০ কোটি ডলারের রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা দেখছি ইন্ডাস্ট্রির রফতানিও বাড়ছে।
তবে ৫ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আমাদের প্রতিবন্ধকতাগুলোও দূর করতে হবে। যেমন, তৈরি পোশাক শিল্পে কমপ্লায়েন্সের জন্য কিছু যন্ত্রপাতি আমদানিতে সরকার শুল্ক ১ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। একই যন্ত্রপাতি চামড়া ও অন্যান্য শিল্পের জন্য আমদানি করতে ৬৭ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে। পিছিয়ে থাকা সম্ভাবনাময় শিল্পগুলোকে উত্সাহ দিতে  তাদের অন্তত সমান সুবিধা দিতে হবে।
আমাদের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোও মাথায় রাখতে হবে। এখন বিশ্বে জুতা বিক্রি কমছে। অর্থাত্ সংকোচনশীল একটি বাজারে আমাদের শেয়ারটি বাড়াতে হবে। এজন্য দেশী উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বিদেশী ব্র্যান্ডগুলোর বিনিয়োগের পথটি অনেক মসৃণ করতে হবে, যেমনটি ভিয়েতনামে হয়েছে। সহজে ব্যবসা করার সুযোগ বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে সরকার কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে। অন্য সবার মতো আমিও আশাবাদী। সর্বোপরি ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন স্তরে স্থানীয়দের স্কিল বাড়ানোর একটি ব্যাপক কর্মসূচি দরকার।
আরেকটি বিষয়, রফতানি বাজারে কমপ্লায়েন্স প্রশ্নে উদাসীনতার কোনো সুযোগ নেই। সামাজিক ও আইনি কমপ্লায়েন্সের পাশাপাশি এখন পরিবেশগত কমপ্লায়েন্সও একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা দেখলাম, পরিবেশগত কারণে হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সেখানে আবার কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারটি কাজ করছে না। এখন ট্যানারি মালিকরা চাইলেও সেখানকার চামড়া উন্নত বিশ্বের রফতানি বাজারে কমপ্লায়েন্ট হবে না। লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সব বিষয়কেই অ্যাড্রেস করতে হবে।
উন্নত বিশ্বের রফতানি বাজারে আমাদের কত কমপ্লায়েন্স মানতে হয়, তার কিছু উদাহরণ দিই। একটি মার্কিন কোম্পানিকে আমি লিখিতভাবে আশ্বস্ত করেছি, আমাদের জুতায় অ্যামাজন অঞ্চলের কোনো প্রাণীর চামড়া ব্যবহার করা হয়নি। সেখানকার আরেকটি কোম্পানি চামড়ার ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট চায়। আরেকটি কোম্পানিকে লিখিত দিতে হয়, আমরা যেসব অ্যাকসেসরিজ ব্যবহার করছি, সেখানে মার্কিন প্রশাসনের কালো তালিকাভুক্ত কোনো দেশের কোনো কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়নি।
এপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আমি এখন মূলত চামড়ার সোর্সিং ও বিদেশের বাজারে কমপ্লায়েন্সগুলোই দেখাশোনা করি।
আমার বিশ্বাস, মানের প্রতিশ্রুতি ও কমপ্লায়েন্সই আমাদের ব্যবসাকে টেকসই করেছে। এটিকে আপাত চোখে খরচ মনে হলেও কার্যত তা বিনিয়োগ। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, বাংলাদেশের শ্রম আইনে কর্মীদের বীমা সুবিধা বাধ্যতামূলক হওয়ার আরো তিন বছর আগে আমাদের ফুটওয়্যার কারখানায় সেটি চালু হয়। আমি দেখেছি, কর্মীদের জীবনমান ও প্রতিষ্ঠানের দক্ষতায় এসবের সুফল অনেক।
আপনি মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। আপনাদের সাফল্য অনুসরণ করে দেশে অনেক তরুণই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তাদের উদ্দেশে কিছু বলবেন?
আমি বিশ্বাস করি, উদ্যোক্তাকে তার পণ্য ও সেবার ওপর ভালো দখল অর্জন করতে হয়। সাফল্যের জন্য বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবসায়িক দক্ষতা, কমিউনিকেশন, টিমওয়ার্ক এমন অনেক স্কিল দরকার হয়। এগুলো অর্জন না করে ব্যবসায় সর্বশক্তি নিয়োগের ভুলটি অনেক তরুণই করছেন এবং শেষ পর্যন্ত তারা ব্যবসায় ব্যর্থ হচ্ছেন। তাদের হতাশাটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এজন্য আমি বলব, ছাত্রজীবন থেকেই শেখার চেষ্টা শুরু করতে হবে। এরপর যথাযথ কর্মপরিবেশে প্রয়োজনে চাকরি করে হলেও নিজের অভিজ্ঞতা বাড়াতে হবে।
এপেক্স আমার পারিবারিক ব্যবসা, সত্য। তবে আমি বিদেশ থেকে ফিরেই এখানে এমডি হয়ে যাইনি। শুরুতে কারখানা করার সময় ইট-বালির হিসাব-নিকাশ করতাম। এরপর ফ্লোরে কাজ শিখেছি। ধীরে ধীরে ম্যানেজমেন্ট ও কমিউনিকেশনের কাজগুলোয় যুক্ত হই। পথটা নেহাত ছোট বলা যাবে না।
আপনার বক্তব্য এপেক্স ফুটওয়্যারের শেয়ারহোল্ডাররাও পড়বেন। তাদের উদ্দেশে কিছু বলবেন?
শেয়ারহোল্ডাররা ভালো-মন্দ সবসময়ে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ অনেক। একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, শেয়ারবাজারে মাঝে মাঝেই অনেক অযৌক্তিক বিষয় চলে আসে, যেগুলো থেকে সাবধান থাকতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, এপেক্স ট্যানারির কারখানা স্থানান্তরের সময় উত্পাদন বন্ধ রাখতে হয়েছিল। আমরা কোম্পানিটির আয়-ব্যয় নিয়ে বেশ চিন্তিত। এমন সময় হঠাত্ শেয়ারের দর বাড়তে থাকে। স্টক এক্সচেঞ্জে বলাবলি হচ্ছে, হাজারীবাগের জমি বেচে কোম্পানি নাকি শত শত কোটি টাকা মুনাফা করবে, উত্পাদন বন্ধ থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। অথচ তথাকথিত সে আয়ের ব্যাপারে আমার কিছুই জানা নেই।
আমি বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ নই। তবে শেয়ারহোল্ডারদের উদ্দেশে এটুকু বলতে পারি, একটি কোম্পানি দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসা কতটা এগিয়ে নিতে পারে— সেটিই বিনিয়োগের মূল বিবেচ্য হওয়া উচিত। স্পেকুলেশনের ফাঁদে পড়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না।
আপনাকে ধন্যবাদ
বণিক বার্তাকেও ধন্যবাদ।